আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় : বৃষ্টি ধারায় বর্ষা আসে
বৃষ্টি ধারায় বর্ষা আসে
আমি বর্ষা আসিলাম
গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে
মমতায় বর্ষপট ভরি
— সুফিয়া কামাল
বৃষ্টির নূপুর পরে রিমঝিম শব্দে ছন্দ তুলে বর্ষা আসে প্রকৃতিতে। গ্রীষ্মের গরমে শুকনো প্রকৃতিতে বর্ষার জল নিয়ে আসে নতুন প্রাণ। গাছে গাছে গজায় নতুন পাতা। এ সময়ের সবুজ প্রকৃতির মনভোলানো রূপ নিশ্চয়ই দেখেছ মনোযোগ দিয়ে। চলো, নতুন করে আমাদের পূর্বে দেখা সে গাছটি অবলোকন করি, স্পর্শ করে দেখি এই বর্ষায়। সেই গাছটির মধ্য দিয়ে আমরা দেখার ও অনুভব করার চেষ্টা করি আমাদের চারপাশের প্রকৃতিকে। বর্ষায় কী কী পরিবর্তন হয় প্রকৃতিতে তা এবার খুব মনোযোগ দিয়ে দেখব। জানব বর্ষার ফল, ফুল কোনগুলো । বর্ষায় খাল, বিল, নদী, পুকুরগুলো যখন পানিতে কানায় কানায় ভরে ওঠে তখন তা কেমন দেখায়।
এই অধ্যারে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞতা পেতে পারি-
- বর্ষার প্রকৃতি দেখে ছবি আকার বিভিন্ন উপাদান-আলো-ছায়া, আকার-আকৃতি, রং, দূরাভাস এবং ছবি আকার পরিসর সম্পর্কে জানতে পারি।
- মেঘ, বৃষ্টি ও আকাশ দেখে, শুনে ও অনুভব করে প্রকৃতির মধ্য থেকেই সংগীত ও নৃত্যের নানা উপাদান— তাল, লয়, রস ও মুদ্রার ধারণা নিতে পারি।
বর্ষার আগমনে প্রকৃতি চঞ্চল হয়ে ওঠে। যেন অবিরাম জলতরঙ্গ বেজে চলে চারদিকে। বৃষ্টিতে প্রকৃতিতে তৈরি হয় অপূর্ব সুর-মূর্ছনা। কখনো টিপটিপ করে ধীর গতিতে, কখনো মাঝারি গতিতে, কখনো দ্রুত গতিতে বা মুষলধারে। আবার বর্ষার মেঘের বিজলি চমক আর গুরুগুরু শব্দে মেঘের ডাকে কম্পিত হয় চারদিক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
বাদল-মেঘে মাদল বাজে
পুরুপুর গগন-মাঝে।
মাদল হোলো ঢোল বা মৃদঙ্গের মতো একটি বাদ্যযন্ত্র। বৃষ্টি ধারার সুরে আর মেঘ মৃদঙ্গের তালে প্রকৃতি জুড়ে এ যেন ভাল, মাত্রা, লয় আর ছন্দের খেলা।
আমরা সংগীতের আরও কিছু উপাদান সম্পর্কে জানব।
এবার আমরা জানব সংগীতে তাল, মাত্রা, লয় আর ছন্দ কাকে বলে :
তাল :
তাল শব্দের উৎপত্তি তালি থেকে। মাত্রার ছন্দবন্ধ সমষ্টিকে বলে তাল। যেমন- কাহারবা, দাদরা ইত্যাদি।
মাত্রা :
সংগীতে গতি বা লয় মাপার একককে বলে মাত্রা। যেমন- এক মাত্রা, দুই মাত্রা, তিন মাত্রা ইত্যাদি। প্রত্যেকটি মাত্রার মধ্যবর্তী ব্যবস্থান সমান হয়।
লয় :
সংগীতে গতিকে বলে লয়। লয়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়— ১) বিলম্বিত লয় ২) মধ্যলয় ৩) দ্রুতলয়।
ছন্দ:
নিয়মবদ্ধ মাত্রার সমাবেশই ছন্দ।
বর্ষায় আকাশের রূপটা কেমন হয় বলো তো? কখনো কালো মেঘে ঢাকা তো আবার কখনো মেঘের ফাঁকে একটু আলোর হাসি। এ যেন আমাদের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। আনন্দ, কষ্ট, হাসি, কান্নাসহ নানা রকম অনুভূতি যেমন আমাদের মুখের ভাবে প্রকাশ পায়, বর্ষার আকাশটিও যেন তেমন। আমরা এবার জানব—বিভিন্ন রকমের ভঙ্গির সঙ্গে সম্পর্কিত নাচের উপাদানগুলো কী কী-
রস এবং মুদ্রা নাচের দুটি উপাদান।
রস :
মুখভঙ্গির মধ্যদিয়ে অনুভূতির প্রকাশকে নাচের ভাষায় বলে রস।
মুদ্রা :
হাতের আঙুলের সাহায্যে অর্থবহ কোনো কিছু দেখানো বা বোঝানোকে বলে মুদ্রা ।
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কালচে নীল রঙে ছেয়ে থাকে বর্ষার আকাশটা। তার মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কোনাকুনি রেখার মতো অবিরত ঝরে পড়ে। তোমরা কি জানো, নীল রং হলো একটি মৌলিক রং। অন্য দুটি মৌলিক রং হলো লাল আর হলুদ। পূর্বে ‘পলাশের রঙে রঙিন ভাষায়’ আমরা দেখেছিলাম প্রকৃতি জুড়ে লাল রঙের ফুলের মেলা। বর্ষার গাঢ় নীল রঙের আকাশের পরে আমরা দেখতে পাব শরতের উজ্জ্বল নীল আকাশ আর হেমন্তে দিগন্ত জোড়া পাকা ধানের সোনালি হলুদ রং। রংকে আবার বর্ণ বলা হয়ে থাকে। সব বর্ণ মিলে একটা বর্ণচক্র হয়। তোমরা কি জানো, বর্ণচক্র কে আবিষ্কার করেছিলেন? বিজ্ঞানী নিউটন বর্ণচক্র আবিষ্কার করেছিলেন। এবার আমরা ছবি আঁকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রং/বর্ণ সম্পর্কে আরেকটু জানব।
রং আর পরিসর হল ছবি আঁকার আরও দুটি উপাদান—
রং:
রং এর উৎস হল আলো। আলো কোন বস্তুর উপর প্রতিফলিত হয়ে আমাদের দৃষ্টিতে যে বর্ণ অনুভুতি তৈরি করে তাকে রং বলে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে রং দু’রকমের- প্রাথমিক ও মিশ্র। লাল, নীল, হলুদেই তিনটি হলো প্রাথমিক রং। দুই বা ততোধিক প্রাথমিক রং মিলে হয় মিশ্র রং। বিজ্ঞান পড়ার সময় আমরা জানতে পারব, কিভাবে সূর্যের সাতরঙা রশ্মি বস্তুর উপর পড়ে এর কিছু রশ্মি শোষিত হয় এবং কিছু রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে রং হয়ে ধরা পড়ে। তবে প্রকৃতিতে আলোক রশ্মিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে বা মিলে মিশে যেভাবে রং তৈরি করে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তা অন্যভাবে ঘটে ।
পরিসরঃ
যে তলের উপর আমরা ছবি আঁকি তাকে পরিসর বলে। যেমন- কাগজ, ক্যানভাস, বোর্ড, দেয়াল ইতাদি। তাছাড়া আকার-আকৃতির চারপাশের সীমানা এবং মধ্যবর্তী দূরত্বকে ও বলে পরিসর। পরিসর দু’রকমের যথা- ধনাত্মক / বাস্তবিক, ঋণাত্মক/ বিপরীত ধর্মী।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষার আগমনে নদীগুলো পানিতে ভরে গিয়ে দুকূল উপচে পড়ে। ডুবে যায় ফসলের মাঠ। নষ্ট হয় ফসল। নদী ভাঙনে প্রতি বছর অনেক বসতবাড়ি আর ফসলের খেত ভেঙে তলিয়ে যায় নদীর গর্ভে। এর মাঝে নদীগুলো বয়ে নিয়ে আসে নতুন পলিমাটি। নতুন মাটিতে নতুন স্বপ্ন বোনে কৃষক। অঞ্চলভেদে চলে গানের আসর। নৌকায় চড়ে বেড়াতে যায় গ্রামের বধূ। আবহমান বাংলার এ দৃশ্যগুলো যুগে যুগে উঠে এসেছে শিল্পীর তুলিতে, কণ্ঠে আর কবি-লেখকদের কলমে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে আমরাও প্রাণ খুলে গাইতে পারি বর্ষার কোনো গান। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারি বৃষ্টির চঞ্চল রূপটিকে । মনের মতো আঁকতে পারি বর্ষার কোনো ছবি।
বর্ষা উৎসব
বর্ষার রূপ-সৌন্দর্য দেখে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্যকর্ম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে চঞ্চলা মেয়ের’ সাথে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সব ঋতুর মধ্যে বর্ষার গান লিখেছেন সবচাইতে বেশি। আমরা জানি, বাংলা বর্ষপঞ্জির তৃতীয় ও চতুর্থ মাস আষাঢ় ও শ্রাবণ জুড়ে হয় বর্ষা ঋতু। বর্ষায় নানা আয়োজনে উদ্যাপিত হয় বর্ষা উৎসব, যা বর্ষামঙ্গল বলেও পরিচিত। বর্ষার গান, কবিতা, নাচ, নাটক, আঁকা ছবি দিয়ে আয়োজন করা যায় বর্ষা উৎসব।
এই অধ্যায়ে আমরা যা যা করতে পারি-
- বর্ষার গান গাইতে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারি।
- পছন্দের গানের সাথে আমাদের অনুভূতি, আনন্দ, কষ্ট, হাসি, কান্নাসহ নানারকম অনুভুতি নাচের রস ও মুদ্রায় প্রকাশ করতে পারি।
- বর্ষার প্রকৃতি দেখে ছবি আকঁতে পারি।
- ভিন্নভাবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করতে পারি যেখানে প্রিয় বন্ধুকে উপহার দিব স্বপ্নবৃক্ষ।
আমরা এরই মধ্যে জেনেছি, গাছ আর পরিবেশের মধ্যে রয়েছে গভীর বন্ধুত্ব। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই যত বেশি গাছ লাগাব, ততই পরিবেশ বাঁচবে সাথে আমরাও বাঁচব। গাছ আর পরিবেশের এই নিবিড় বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ই জুন পালন করা হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও শুরু হয় জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান।
চলো, গাছ নিয়ে এবার এক মজার খেলা করা যাক। পরিবেশ বাঁচাতে গাছ লাগানোর এই অভিযানে আমরাও অংশ নেব এই খেলার মধ্য দিয়ে। এই খেলার নাম দিলাম ‘সবুজের স্বপ্ন পাখায়’।
এই অধ্যায়ে আমরা আরও যা করব –
- ‘সবুজের স্বপ্ন পাখায়’—খেলাটিতে আমরা বন্ধুদের উপহার দিব চারা গাছ এবং সাথে আমরা আমাদের একটি স্বপ্নের কথাও লিখে দিব।
- কাজটি করার জন্য প্রথমে আমরা পছন্দমতো একটি ফুল, ফল অথবা ঔষধি গাছের চারা জোগাড় করব। প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে অথবা বীজ থেকে চারা তৈরি করে অথবা পছন্দের গাছে কলম করে কিংবা নার্সারি থেকেও আমাদের চারাটি আমরা জোগাড় করতে পারি।
- মাটির হাঁড়ি, কাপ-বাটি/প্লাস্টিকের বোতল/পাত্রসহ ইত্যাদি যে কোনো ফেলনা জিনিস দিয়ে গাছটির জন্য একটি টব তৈরি করব। টবটির গা আমরা পছন্দমতো নকশা করে সাজাব । এবার গাছের উপযোগী মাটি দিয়ে টবটি ভরাট করে তাতে চারাটি লাগাব।
- কাপড় অথবা মোটা শক্ত কাগজ দিয়ে নকশা করে আমরা একটি ব্যাগ বানাব, যার মধ্যে আমরা স্বপ্নবৃক্ষের চারাটি বহন করতে পারি।
- এবার স্বপ্ন লেখার পালা। সুন্দর একটি কাগজে নিজের একটি স্বপ্ন লিখে তা আমরা গাছের ব্যাগটির ভেতরে রেখে দিব।
- এরপরে নির্দিষ্ট দিনে শ্রেণিকক্ষে আয়োজন করব ‘সবুজের স্বপ্ন পাখায়’ অনুষ্ঠানটি। শ্রেণিকক্ষটি সাজাব বর্ষার আঙ্গিকে। তারপর শুরু করব সে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নবৃক্ষ বিনিময়ের পর্ব। প্রথমে সহপাঠীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে যাব এবং প্রত্যেকটি দলের নামকরণ করব বর্ষার বিভিন্ন ফুলের নামে। এরপর লটারির মাধ্যমে আমরা ঠিক করব, দলের মধ্যে কে কার সঙ্গে স্বপ্নবৃক্ষ আর লিখিত স্বপ্নটি বিনিময় করব।
- উপহার পাওয়া স্বপ্নবৃক্ষটিকে আমরা আগলে রাখব পরম যত্ন আর মমতায়। কারণ এটি শুধু একটি চারা গাছ নয় ; বন্ধুর দেয়া তার স্বপ্ন যা প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে উঠবে চারা গাছটির সাথে। চারা গাছটিকে পছন্দের জায়গায় নিরাপদে স্থাপন করে তাতে নিয়মিত পানি ও সার দেয়ার ব্যবস্থা করব।
- গাছের নতুন পাতা গজানো, ফুল ফোটা, তাতে মৌমাছি, ফড়িং, পাখির উড়ে এসে বসা, কিচির মিচির বা সুর করে ডাকা অথবা গাছটিকে কেন্দ্র করে যদি আরও কোনো গল্প তৈরি হয় তার সবকিছু ধারাবাহিকভাবে এঁকে বা লিখে রাখব বন্ধুখাতায়।
স্বপ্নবৃক্ষটির বেড়ে ওঠার দিনলিপি, আঁকা ছবি, যদি সম্ভব হয় বড়দের সাহায্য নিয়ে মোবাইলে ধারণ করে ছবি, ভিডিও এবং বন্ধুর দেয়া লিখিত স্বপ্নটি আমরা প্রদর্শন করব ‘বিজয়ের আলোয় সুন্দর আগামী: বিজয় দিবস উদযাপন ও বার্ষিক প্রদর্শনীতে।
মূল্যায়ন ছক
বৃষ্টি ধারায় বর্ষা আসে
শিক্ষার্থীর নাম:
রোল নম্বর :
তারিখ:
শিক্ষক পূরণ করবেন: টিজিতে নির্দেশিত কাজ শেষ করে তার আলোকে প্রযোজ্য বিবৃতিতে টিক দিন
অভিভাবকের মন্তব্য ও স্বাক্ষর: তারিখ:
আরও দেখুনঃ