আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বৈদিকোত্তর যুগের বাদ্যযন্ত্র
বৈদিকোত্তর যুগের বাদ্যযন্ত্র
বৈদিকোত্তর যুগের বাদ্যযন্ত্র
ঐতিহাসিকদের মতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় হচ্ছে বৈদিকোত্তর যুগ। এ সময়ের মধ্যে আর্যরা ক্রমশ সমগ্র ভারতবর্ষের বুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। সম্ভবত মধ্য এশিয়া থেকে খাইবার পাস অতিক্রম করে আর্যরা এই উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। এরপর বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে দলে দলে গমন করে সৃষ্টি করেছিলেন নতুন নতুন জনপদ।
তাঁদের প্রভাবে নতুন সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ধারার বিকাশ ঘটে। সমগ্র উপমহাদেশে যে ধরণের গীত, বাদ্য ইত্যাদির প্রচলন ছিলো তা এই ভাঙা গড়ার মধ্যে অক্ষুণ্ণ থাকলেও রূপে বা গঠনে ও বিকাশে এর কিছু পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে মা সংগীতের বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পূর্ব প্রচলিত সামগানের পাশাপাশি মার্গ সংগীতের প্রচলন শুরু হয়।
পরবর্তীকালে গান্ধর্ব সংগীত কথাটির উৎপত্তি কোন কোন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও আসলে বিভ্রান্তির কোন কারণ নাই। কারণ, নাট্যশাস্ত্র রচয়িতা ভরত বলেছেন, গান্ধর্বদের প্রিয় বলে বৈদিকোত্তর মার্গ সংগীত গান্ধর্ব নামে পরিচিত।
গান্ধর্ব সামগানোত্তর হলেও এই সংগীতে সামগানের গুণ ও প্রকৃতি বিদ্যমান ছিলো। প্রকৃতপক্ষে সামগান ও গান্ধর্ব গান উভয়ই ছিলো উচ্চশ্রেণীর সংগীত, একেবারে ‘আমজনতার পক্ষে নৈপুণ্যলাভের উপযোগী নয়। নাট্যশাস্ত্রের ২৮শ অধ্যায়ে গান্ধর্ব গানের পরিচয় প্রসঙ্গে ভরত বলেছেন –
“যত্নতীগতং প্রোক্তং নানাতোদ্য সমাশয়ম্ ।
গান্ধর্বমিতি বিজ্ঞেয়ার স্বরতালপদাশ্রয়ম্।”
ভরত রচিত এই দু’টি পঙ্ক্তি থেকে বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়। যেমন “তন্ত্রী’ শব্দের দ্বারা বীণার কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বীণাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে স্বর, তাল, পদযুক্ত সংগীতের নামই গান্ধর্ব।
আর্যদের বিস্তারিত জীবনচিত্র পাওয়া যায় সে আমলে রচিত দুটি মহাকাব্য ‘রামায়ন’ এবং ‘মহাভারতে’। এ দুটি পুরানের রচনাকাল আনুমানিক ১০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ। যদিও নির্দিষ্ট কোন একটি সময়ে মহাকাব্যগুলোর রচনা শুরু এবং শেষ হয়েছে, দিন তারিখ উল্লেখ করে এমন কথা বলা যায় না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত নানা কাহিনী ক্রমান্বয়ে এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে দিনের পর দির এগুলোর কলেবর বৃদ্ধি করেছে।
প্রাচীন আমলে এসব পুরাণ আবৃত্তি করা হতো অথবা গাওয়া হতো। রামায়নে কুশীলব যে গান গাইতেন সেটি প্রকৃতপক্ষে গান্ধর্ব সংগীতই। এতে বেণু-বীণা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে। বালীকির দুই তরুণ শিক্ষা লব এবং কুশের ‘বীণা’ বাজিয়ে সংগীত পরিবেশন সেই সত্য বহন করে। মহাভারতেও গায়ক, বাদক, নর্তক প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। সেইসাথে শঙ্খ, বেণু, মৃদঙ্গ, নয়টি তত্ত্বীযুক্ত বীণা ইত্যাদির উল্লেখ আছে।
পুরাণ শ্রেণীভুক্ত এই সময়কার আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা ‘হরিবংশ’, যেখানে অনেকটা পরিমার্জিত সংগীত এবং নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে তুম্বী বীণা, বন্ধকী মৃদঙ্গ, সূর্য, ভেরী ইত্যাদির নাম লক্ষণ।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভারতীয় সংগীতের কী রূপ ছিল তা আমরা জানতে পারি যে দুটি গ্রন্থ থেকে তা হচ্ছে নারদ রচিত “শিক্ষা” এবং ভরত রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’। এই গ্রন্থ দুটি যদিও পুরোপুরি সংগীত সম্পর্কীয় নয়, তবুও উপমহাদেশের সংগীতের ক্রমবিকাশকে বুঝতে হলে গ্রন্থ দুটি অপরিহার্য।
আরও দেখুন :