বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

 

বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

 

বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

বৈদিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে বৈদিক যুগ গড়ে উঠেছিলো। গীত, নৃত্য ও বাদা — সংগীতের তিনটি কলার উৎকর্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় এ যুগের ইতিহাস থেকে।

বেদকে ভিত্তি করে আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। আর্যজাতির প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ। মোটামুটিভাবে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কে বৈদিক যুগ বলা হয়ে থাকে। আর্যদের আগমনস্থলের উৎস সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশকাল নিয়ে সকলেই একমত।

বৈদিক যুগে বেদকে কেন্দ্র করে সংগীতের একটি ধারা বিকাশলাভ করেছিলো। বেদ চার ভাগে বিভক্ত ৪ ঋক, সাম,যজু এবং অথর্ব। প্রত্যেক বেদ আবার ‘সংহিতা’ এবং ‘ব্রাহ্মণ’ এই দুই অংশে বিভক্ত। সংহিতা ভাগ পদ্যে রচিত, ব্রাহ্মণ ভাগ গদ্যে রচিত। প্রতিটি শাখাকে অবলম্বন করেই বৈদিক গান বিকাশলাভ করে। প্রকৃতপক্ষে বেদের স্তোত্রগুলি সুরে পাঠ করা হতো। রুকমন্ত্র সুর দিয়ে গাওয়ার নাম সামগান এবং এই সামগানকেই সব গানের উৎস বলে মনে করা হয়।

বৈদিক গানের সঙ্গে থাকতো নৃত্য ও বাদ্য। বৈদিক যুগের সাহিত্যে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়। দুন্দুভি, ভূমিদুন্দুভি প্রভৃতি চামড়ার বাদ্য, বিভিন্ন ধরনের তন্ত্রীযুক্ত বীণা, বেণু প্রভৃতির উল্লেখ বেদে পাওয়া যায়। দুন্দুভি পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি হতো। ভূমিদুন্দুভি তৈরি করা হতো মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তের মুখ পশুর চামড়া দিয়ে আচ্ছাদিত করে।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

যুদ্ধে, বিপদাশঙ্কায় ও বিভিন্ন উৎসবে ঘোষণা করার জন্য দুন্দুভি ব্যবহার করা হতো। ঋগ্বেদে ( ১। ২৮ ৫) আছে : “যাচ্চিদ্ধি ত্বং গৃহে জয়তামিব দুন্দুভি”। ইহদামত্তমং বদ ঋগ্বেদে ‘গর্গর’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে। ৮ ৬৯ ৭৯ থকে আছে “অব স্বরাতি গর্গরো গোধা পরিসনিকা‍ পিঙ্গা পরি চ নিষ্কদদিন্দ্রায় ব্রহ্মোদ্যতম।” এই মন্ত্রে ‘গর্গর’ ছাড়াও ‘পিঙ্গ’ বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়।

টীকাকার রমেশচন্দ্র দত্ত উল্লেখ করেছেন “গর পর ধ্বণিযুক্ত বাদা ভয়ঙ্কর শব্দ করিতেছে…… পিঙ্গলবর্ণ ধনুকের জ্যা শব্দ করিতেছে .. ।” পিঙ্গ যন্ত্রটি এক ধরনের ধনুযন্ত্র। একে রাবণাস্ত্রও বলা হতো। ধনুযন্ত্র পিঙ্গল বা নীলাভ তাম্রবর্ণের পশুর অস্ত্র বা নাড়ী ( অধুনিক যুগে পাট স্ট্রিং নামে পরিচিত, গাট স্ট্রিংকে আধুনিক বাংলায় অস্ত্রী তার বলা হয়) দিয়ে তৈরি হতো বলে এর নাম ‘পিঙ্গ’। গবেষকদের ধারণা এই পিঙ্গ যন্ত্রটিই পরে রূপ পরিবর্তন করে বেহালায় রূপান্তরিত হয়।

 

বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

 

বেদে আঘাটি, ঘাটলিকা, কাণ্ডরীণা, নাড়ী, বনস্পতি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে। ১০।১৪।২ ঋকে আঘাটির বর্ণনা আছে এরূপ “আঘাটিভিরিবধাবয়ারণ্যানি মহীয়তে”। ‘নাড়ী’ নামক বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ ১০।১৩৫।৭ ঋকে পাওয়া যায় । “ইয়মসা ধমাতে নাড়ীরয়ং পীর্ভিঃ পরিকৃতঃ”। ঋগ্বেদে শততন্ত্রী বীণার উল্লেখ আছে।

এ থেকে বোঝা যায় ঋগ্বেদিক যুগে সামগদের ( সামগান পরিবেশনকারী) মধ্যে শততন্ত্রী বীণার প্রচলন ছিলো। ১৮৫।১০ ঋকে আছে ৪ “ধমস্তো বাণং মরুতঃ সুদানবোমদেসোমস্যরণ্যানি চত্রিরে”। বেদভাষ্যকার আচার্য সায়ন ব্যাখ্যা করেেছন ‘বাণ’ ছিলো শততন্ত্রী বীণার অপর নাম।

সামবেদেও নৃত্য, গীত ও বাদা এই তিনটি কলার যথেষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। যজুর্বেদেও একই ধরণের উল্লেখ রয়েছে। শুক্লযজুর্বেদে এবং কৃষ্ণময়ুর্বেদে একাধিকবার দুন্দুভি এবং ভূমিদুন্দুভির উল্লেখ আছে। বাজসনেয়সংহিতায় (৯১২) ‘বনস্পতি’ নামক বাদ্যযন্ত্রের বর্ণনা পাওয়া যায় ৪ “বনপতয়ো বিম্নচান্ধম”। বনস্পতি বলতে গাছের গুঁড়িতে গর্ত করে সেই গর্তের মুখে পশুর চর্ম আচ্ছাদিত করে তৈরি যন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে।

তাছাড়া তৈত্তিরীয় সংহিতায় দুন্দুভি, তুণব, বীণা প্রভৃতি যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে যে, বাক্ বা ধ্বনি (শব্দ) বনস্পতি, দুন্দুভি, তুণব, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ভেতর দিয়ে প্রেরিত হয়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৫১৫) পুরণারীরা যে কাণ্ডবীণা বাজাতেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাজসনেয়সংহিতায় (৩০:১০১৯) ‘অদম্বর’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে ৪ “শব্দয় অদম্বর ঘাতম্”।

 

বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত

 

অথর্ববেদেও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে, যেমন, কাম্পতি, দুন্দুভি ইত্যাদি। এছাড়াও ‘কর্করি’ এবং ‘বজ্র’ নামক আরো দু’টি বাদ্যযন্ত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আচার্য কর্ক তাঁর ভাষ্যে ‘গোধবীণা’ অর্থাৎ গোসাপের চামড়ায় আচ্ছাদিত বাদাযন্ত্র, ‘কান্ডবীণা’ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। বেদভাষ্যকার কাত্যায়নের ব্যাখ্যায় সমসাময়িককালে মদল, ভেরী, পটই ভ্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আরও দেখুন :

Leave a Comment