ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

 

ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

 

ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

সংগীতের উদ্দেশ্যেই যে ভাব প্রকাশ করা এ কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় জানিয়েছেন বার বার। ‘সংগীত সুরের রাগরাগিনী নহে, সংগীত ভাবের রাগরাগিনী’- এই বিশ্বাস তাঁর কুড়ি বছর বয়সের। তাঁর প্রথম জীবনের রচনা ‘রুদ্রচন্ড’ নাটকের গানে রাগরাগিনীর নির্দেশ আছে, আছে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর প্রথম সংস্করণে, ‘নলিনী’তে, ‘রাজা ও রানী’র প্রথম সংস্করণে, ‘শারদোৎসব’-এ এবং প্রায়শ্চিত্তের কোনো কোনো গানে।

কিন্তু এই নির্দেশ অনেক সময় আমাদের সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তরুতলে ছিন্নবৃত্ত মালতীর ফুল’ গানটিকে মিশ্র গৌড়- সারং বলা হয়েছে, কিন্তু স্বরলিপিতে দুটি গানেই মিশ্র-গৌড় সারং রাগের নাম আছে। অন্যদিকে, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকের প্রথম সংস্করণে ঝিঁঝিঁট-স্বাজের গান ‘হ্যাদে গো নন্দরানী’ স্বরবিতানে মিশ্র ভৈরবী গান বলে পরিচিত।

এই নাটকেই এবং স্বরবিতানেও ‘বুঝি বেলা বহে যায়’ গানটি সম্পর্কে নির্দেশ আছে মূলতান রাগের, কিন্তু এই গানের সুরের বিন্যাসে মূলতান রাগের পূর্ণরূপটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না আমাদের কাছে। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ভূপালি রাগে নির্দেশিত “বধুয়া অসময়ে কেন হে প্রকাশ’ গানটি স্বরবিতানে এমন রাগের নির্দেশ আছে।

নিশ্চয়ই গানগুলির সুর পরিবর্তিত হয়েছে কোনো সময়। এর উত্তর জানা নেই আমাদের। কিন্তু এটুকু সত্য যে রাগরাগিনীর নামের চেয়ে আমাদের কাছে অনেক সত্য হয়ে ওঠে গানের ভিতরকার অনুভব, যেমনটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালে ইন্দিরাদেবীকে; গানের কাগজে রাগরাগিনীর নাম না থাকাই ভালো। নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে, রূপের মধ্যে না ।

কোন রাগিনী গাওয়া হচ্ছে বলবার কোনো দরকার নেই। কী গাওয়া হচ্ছে সেইটেই মুখ্য কথা, কেননা তার সত্যতা তার নিজের মধ্যেই চরম। বস্তুত এইসব নাটকের মধ্যে একমাত্র শারদোৎসব’-এই গানের রাগরাগিনীর সঙ্গে নাটকের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়, আর সে যোগও কবির দৃষ্টি দিয়েই ব্যাখ্যা করা চলে। আমাদের দেশে ঋতুবৈচিত্রের সঙ্গে রাগরাগীনির সম্বন্ধ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন;

‘ঋতুর রাগরাগনী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীতশাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুর জন্যই। কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব, কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার, আর বর্ষার মেঘ মল্লার, দেশ এবং আরও বিস্তার।

শরৎ-হেমন্তের প্রকাশ যে রাগরাগিনীতে নেই এর কারণ সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, এই ঋতুর উৎসবে বাস্তব ব্যস্ত হইয়া আসিয়া মাঠ-ঘাট জুড়িয়া বসে।’ আর ‘বাস্তবের সভায় সংগীত নুজরা দিতে আসে না, যেখানে অখন্ড অবকাশ সেখানেই সে সেলাম করিয়া বসিয়া যায়। কিন্তু আমাদের মনে হয় শরতের শাস্ত্রসম্মত রাগরাগিনী থাক বা না-ই থাক, রবীন্দ্রনাথ শরৎ ঋতুকে পেয়েছেন প্রভাতের সুরে। তাঁর চোখে, শরৎ একেবারে নবীন।

বর্ষার গর্ভ হইতে এইমাত্র জন্ম লইয়া দরদী ধাত্রীর কোলে শুইয়া সে হাসিতেছে। তার কাঁচা দেহখানি, সকালে শিউলিফুলের গন্ধটি সেই কচি গায়ের গন্ধের মতো, আকাশে আলোকে গাছ-পালায় যা-কিছু রঙ দেখিতেছি, সে তো একেবারে তাজা।’ এই রঙ তিনি দেখেছেন ধানক্ষেতের সবুজে, আকাশের নীলে, প্রভাতের কাঁচা সোনা রঙের রোদে। শারদোৎসবের পুরোহিত সন্ন্যাসীর কাছে শুনি, শরতের উৎসব সেই আলো সেই আকাশের সঙ্গে মিলনের উৎসব;

 

ভাবই সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর মূল উদ্দেশ্য

 

বাইরে যে আজ সোনা ঢেলে দিয়েছে। তারই সঙ্গে আজ অন্তরে বাইরে মিলে যেতে হবে তো, নইলে এই শরতের উৎসবে আমরা যোগ দিতে পারব না, আজ এই আলোর সঙ্গে আকাশের সঙ্গে মিলব বলেই তো উৎসব। এ নাটক একান্তভাবে প্রভাতেরই পটভূমিতে রচিত, আর সেই কারণেই গানগুলি বাঁধা হয়েছে নিম্নের প্রভৃতি প্রভাতী সুরে-

ভৈরবী – আজ বুকের বসন ছিড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি

সিন্ধুবৈরবী – আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান

বিভাস – মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,

ললিত – তোমার সোনার খালায় সাজাব আজা

রামকেলি – নবকুন্দধবল সুশীতলা

মিশ্র রামকেলি – আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ

আশহিয়া – আমার নয়নভুলানো এল

(নাটকে লেখা আছে আলেয়া)

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব প্রকৃতি ভাবনার ছেঁয়ায় গান যেমন পরিবেশ রচনা করছে ‘শারদোৎসব’ বা ‘ঋণশোধ’ নাটকে, গানের ভিতর দিয়ে ঠিক সেইরকম পরিবেশ রচিত হয়েছে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে, একটু ভিন্নভাবে। বসন্ত ঋতুর অনুষদে যে রাগ রাগিনীর উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তার কিছু স্পর্শ আছে ‘রাজা’ নাটকের

‘আজি দখিন দুয়ার খোলা,

“আজি কমলমুকুলদর খুলিল’,

‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ প্রভৃতি গানে,

কিন্তু ‘ফাল্গুনী’র গানে বড়ো হয়ে উঠেছে বসন্তের রূপ, যে রূপে কবি দেখেছেন ‘প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব’। বসন্ত তাঁর কাছে আনন্দের উল্লাসের ঋতু, সে নাড়া দেয় আমাদের বাহির মহলের যৌবনকে’।

ফাল্গুনী’তে রেণুবনের গানে – ‘ওগো দখিন হাওয়া’

পাখির নীড়ের গানে – ‘আকাশ আমার ভরল আলোয়

নবযৌবনের গানে – ‘আমরা নূতন প্রাণের চর’

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

বসন্তের হাসির গানে———- ওদের ভাব দেখে যে পায় হাসি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে সেই আনন্দ, সেই চঞ্চলতার সুর। যুবকদলের উচ্ছলতার গান (‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ কিংবা চন্দ্রহাসের বসন্তের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে তোলার কথাটি রূপ পেয়েছে অন্ধ বাউলের যে গানে- ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা’, তার সুরও সেই একই অনুভবের প্রকাশ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment