আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় মধ্যযুগের বাদ্যযন্ত্র
মধ্যযুগের বাদ্যযন্ত্র
মধ্যযুগের বাদ্যযন্ত্র
১২০০ থেকে ১৩০০ সাল অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতক একটি বিশিষ্ট সাংগীতিক যুগ। এযুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্ম হচ্ছে শার্জদেব রচিত “সংগীত-রত্নাকর”।
“সংগীত-রত্নাকর”
গান্ধর্ব ও প্রাচীন ধারার সংগীত পদ্ধতিকে শাঈদের পূর্ণভাবে তাত্ত্বিক রূপ দান করেন তাঁর গ্রন্থে। “সংগীত-রত্নাকর” সাতটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। অধ্যায়গুলো হলো : স্বর, রাগ, প্রকীর্ণ, প্রবন্ধ, তাল, বাদ্য ও সম্বন্ধীয়।’ প্রত্যক্ষ সংগীত অভিজ্ঞতা ও শাস্ত্রীয় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত এই গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
উল্লিখিত সাতটি অধ্যায়ে সংগীতের বিভিন্ন দিকের গতিপ্রকৃতি ও কলারূপই তিনি শুধু ধরিয়ে দেন নি, বরং উত্তরকালের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি রেখে গেছেন। শাস্ত্রদেব তাঁর গ্রন্থে ‘একতন্ত্রী বীণা’কে তাঁর আমলে প্রচলিত যাবতীয় বীণার মধ্যে প্রধাণ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে দশ ধরণের বীণার নামোল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো – একতন্ত্রী, নকুলা, ত্রিতন্ত্রীকা, চিত্রা, বিপঞ্চী, যত্তকোকিলা, আলাপিনী, কিন্নরী (লঘু, বৃহৎ, মধ্যম), পিনাকী এবং নিঃশংক।
সংগীতোপনিষৎসারোদ্ধার
চতুর্দশ শতকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘সংগীতোপনিষৎসারোদ্ধার। রচয়িতা গুজরাটের অধিবাসী সুধাকলসা। বইটি রাগের শ্রেণীবিন্যাসে নতুন ধারণার সূত্রপাতের জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এছাড়া এতে তের ধরণের বীণার তালিকা পাওয়া যায়। তবে একটি বিষয় যা সংগীত গবেষকদের কাছে লক্ষণীয়, তা হলো সেতার নামক কোন যন্ত্রের কথা এ বইতে উল্লেখ নাই। ‘সংগীতোপনিষৎসারোদ্ধার’ গ্রন্থে উল্লিখিত বীণাগুলো হচ্ছে-
পিনাকী, কিন্নরী, আলম্বী, কচ্ছপী, বৃহতী, মহতী, কলাবতী, প্রভাবতী, ঘোষাবর্তী, বিপঞ্চী, কণ্ঠকুনিকা, বল্লকী এবং ব্রহ্মবীণা। ত
ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক অথবা তৎপরবর্তী যুগের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘সংগীতমকরন্দ’। এটির রচয়িতার নামও নারদ (ইনি আদি নারদ নন)। এই গ্রন্থে প্রায় উনিশটি বীণার নাম উল্লেখ রয়েছে। যেমন, কচ্ছপী, কুজিক, চিত্রা, বহন্তী, পরিবাদিনী, জয়া, ঘোষাবর্তী, জ্যেষ্ঠা, নকুলী, মহতী, বৈষ্ণবী, ব্রাহ্মী, রৌদ্রী, কুর্মী, রাবণী, সারস্বতী, কিন্নরী, সৌরস্ত্রী, ঘোষকা।
“তারিখ-ই-ফিরুজশাহী”
‘সংগীতমকরন্দ’-এর পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত “তারিখ-ই-ফিরুজশাহী” গ্রন্থটি। ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে বইটি রচনা সমাপ্ত হয়। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভারতবর্ষে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে এবং পরে এইসব যন্ত্রের ভারতীয়করণ ঘটে।
তাঁর গ্রন্থে যেসব বাদ্যযন্ত্রের নাম বলা হয়েছে তার মধ্যে রবাবের নাম উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে, সুলতান কায়কোবাদের রাজত্বকালে (১২৮৮-১২৯৫) গজল গানের সংগে রবার যন্ত্রের সঙ্গত চলত ।
আমীর খসরু এবং তাঁর গ্রন্থে উল্লেখিত সংগীত বিষয়ক প্রামাণ্য বিবরণ
মধ্যযুগের সংগীতের ইতিহাসে কিংবদন্তীর মত একটি নাম হচ্ছে হজরত (সম্মানসূচক উপাধি) আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫)। তুরস্ক থেকে ভারতে আগমনকারী একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা আমীর সাইফউদ্দিন মাহমুদ জাতিতে তুর্কী ছিলেন। সুলতান ইলতুভূমিশের আমলে তিনি মধ্য এশিয়ার বলখ থেকে ভারতের উত্তর প্রদেশের পাতিয়ালি রাজ্যে আসেন এবং তাঁর রাজসভায় সভাসদ হিসেবে যোগ দেন।
পাতিয়ালি রাজ্যে তিনি স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন এবং সেখানে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের যুদ্ধমন্ত্রী ইমাদুল মুলক-এর কন্যাকে বিবাহ করেন। আমীর সাইফুদ্দিন মাহমুদ দম্পতির তিন পুত্রের মধ্যে আমীর খসরু ছিলেন কনিষ্ঠ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন আমীর খসরু। একাধিক ভাষায় রচিত তাঁর গীতি এবং কাব্যসমূহ সংখ্যা এবং উৎকর্ষের দিক থেকে অনন্য।
তাঁর সংগীত জীবন নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিক বাদ্যযন্ত্রের নাম এসেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর সম্পৃক্ততা নাই এমন কোন কোন বিষয়েও তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কিছুটা বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা প্রাসঙ্গিক কারণে উল্লিখিত হলো। ব্যক্তিগত জীবনে আমীর খসরুর প্রতিভার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর হচ্ছে তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো।
তবে শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজী এবং আরো একাধিক রাজপুরুষের সভাসদ তথা সামরিক অফিসার। এতদসত্ত্বেও সংগীতবিদ্যায় তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন এবং ভারতীয় এবং পারস্য সংগীতরীতির মিশ্রণে বারো স্বপ্ন বিশিষ্ট সংগীতপদ্ধতির আবিষ্কার তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। ভারতীয় এবং পারস্য রাগের মিশ্রণে তিনি একাধিক রাগের সৃষ্টি করেছিলেন।
এছাড়া একাধিক বাদ্যযন্ত্রে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। সাহিত্যকর্মে যেমন ৰিপুল নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন, সংগীত বিষয়েও তেমনি অনেক লিখিত নিদর্শন তিনি রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু সম্ভবত রাজকার্যে এবং কাব্যসৃষ্টিতে ব্যস্ত থাকার কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে এই বিষয়ে তিনি বেশি সময় ব্যয় করেন নি। সংগীত বিষয়ে তাঁর সৃষ্ট কর্মের অধিকাংশ নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর রচিত ‘ইজাজ-ই-খসরুভী’ গ্রন্থে।
বইটিতে সংগীত গবেষকদের গবেষণাকর্মের প্রচুর উপাদান রয়েছে এবং ইতোমধ্যে প্রচুর গবেষণাকর্ম ও সাধিত হয়েছে। স্বীয় সৃষ্ট সংগীতকর্মের সবটুকু বর্ণনা এই বইতে পাওয়া যায়। বর্তমান গবেষণা কর্মের জন্য এর বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক বর্ণনাগুলো সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । আমীর খসরু উল্লেখ করেছেন যে, কন্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত উভয় বিষয়ে তাঁর খুব ভাল দক্ষতা ছিলো।
বিশেষ করে ‘চাঙ’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্রের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি এই যন্ত্রে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। চাঙ ছাড়াও আরো কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, যেমন, নাওয়ালিক এবং দাফ। শুধু বাদন নয়, এই যন্ত্রগুলোর নানা প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তা সারিয়ে তোলার কৌশলে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এছাড়া রুবাব এবং বারবাত যন্ত্রে তিনি নতুন ধরণের বাদনশৈলী উদ্ভাবন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
আমীর খসরুর রচনায় আরো যেসব বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। তার মধ্যে রয়েছে – তাম্বুর রুদ, নাঈ, আলাওয়ান, কিংরা, সাহনাই, মিসকাত, খিসতিত, সুফরি, আজব – রুদ, উদ, বৈত্র হিন্দী ইত্যাদি। গ্রন্থে এই সকল বাদ্যযন্ত্রের কাব্যসুষমামন্ডিত বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছে। সংগীত সম্পর্কিত তাঁর সকল কৃতকর্মের বিবরণ তিনি রেখে গেছেন তাঁর গ্রন্থে।
তবে একটি কথা উল্লেখযোগ্য, কোথাও সেতার নামক কোন যন্ত্রের নাম তিনি উল্লেখ করেন নি। যদিও লোক পরম্পরায় সেতার আবিস্কারের সাথে আমীর খসরুর নাম জড়িত বলে লোক সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত হয়ে গেছে। সেতার যন্ত্রের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৩৯ সালে লিখিত ‘মুরাক্কা-ই-দিল্লী’ নামক গ্রন্থে। এর আগে কোন বইয়ে সেতারের উল্লেখ পাওয়া যায় নি।
গবেষণা করে জানা গেছে বইটি যখন লেখা হয়েছে তার কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ মোগল আমলের শেষভাগে এই যন্ত্রের প্রচলন শুরু হয়। উল্লেখ্য আমীর খসরুর জন্ম ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে। সেতার আবিস্কারের প্রায় চারশ’ বছর পূর্বে আমীর খসরুর মৃত্যু হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লীতে খসরু খান বলে এক সংগীতজ্ঞর নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, সেতার তৈরিতে যাঁর অবদান রয়েছে বলে উর্দু, হিন্দী এবং ইংরেজি ভাষায় লিখিত সংগীত গবেষকদের গবেষণা থেকে জানা যায়। ইনি ছিলেন মিঞা তানসেনের জামাতা নৌবাৎ খাঁর ১৫ তম প্রজন্মের উত্তরসূরী। তবে কততম প্রজন্মের উত্তরসূরী এ বিষয়ে মতভেদ আছে।

‘সংগীত সুদর্শন’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে অষ্টাদশ শতাব্দীর আমীর খসরু সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। গ্রন্থে লেখক সুদর্শন শাস্ত্রী এই আমীর খসরুকে ‘ফকির’ বলে উল্লেখ করেছেন। লেখকের মতে খসরুর ছেলের নাম ফিরোজ খান এবং ফিরোজ খানের ছেলে মসিদ খান। এই মসিদ খান ছিলেন এক অসাধারণ সেতারবাদক এবং তিনিই ‘মসিদখানি গত’ নামে সেতারে বাজাবার উপযোগী বিলম্বিত গত প্রথম সৃষ্টি করেন।
প্রায় একই ধরণের তথ্য পাওয়া যায়। এল.ডি.যোশীর লেখা থেকেও। ১২ খসরুর বড় ভাই ছিলেন সে সময়কার সংগীতের এক দিকপাল নিয়ামত খান। ফকির খসরু যাঁকে বলা হয়েছে তাঁর আসল নাম সম্ভবত খসরু খান। কিন্তু কিংবদন্তীতুল্য কবি এবং সংগীতজ্ঞ হজরত আমীর খসরুর সাথে নামে মিল থাকায় এবং প্রথমোক্ত জনের প্রবল খ্যাতির প্রভাবে পরবর্তীতে তাঁর নাম আমীর খসরু হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়।
বিশিষ্ট গবেষক ড. ওয়াহিদ মির্জা, যিনি আমীর খসরুর জীবন ও কর্মের ওপর সুদীর্ঘ গবেষণা করেছেন এবং অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন, তাঁর ভাষ্যে, “সেতারের অবিস্কার খসরুর অবদান বলে একটি ধারণা সাধারণভাবে সকলের মধ্যে গৃহীত হয়ে গেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে খসরুর লেখার কোন স্থানে ‘সেতার’ নামের কোন চিহ্ন খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি, যদিও তাঁর সময়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পৃষ্ঠাভর্তি বিবরণ রয়েছে গ্রন্থে চতুর্দশ শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা বোঝা যায় যে, এ সময়ের মধ্যে পারস্য এবং তার আশেপাশের দেশসমূহ থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভারতবর্ষে এসে সেখানকার সংগীতাঙ্গনে নিজস্ব স্থান দখল করে নেয়।
শুধু তাই নয়, পূর্ব থেকে প্রচলিত বিভিন্ন বীনা গোত্রীয় যন্ত্রসমূহ, যেমন, চিত্রা বীণা, কচ্ছপী বীণা ইত্যাদি যন্ত্রের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে পরবর্তী যুগে বিবর্তনের ফলস্বরূপ বিভিন্ন নতুন ধরণের বাদ্যযন্ত্রের প্রচলণ ঘটতে থাকে এ দেশে।
“আইন-ই-আকবরী”
আমীর খসরু এবং তাঁর সমসাময়িক সংগীতজ্ঞদের পরবর্তী যুগের উল্লেখযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় আবুল ফজল রচিত “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে। “আইন-ই-আকবরী”র সংগীত অধ্যায় পরিসরে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সংকলনটি মূল্যবান। আবুল ফজলের অসামান্য সম্পাদন কৌশলে উত্তর ভারতীয় সংগীতের তথ্যগুলো উপযুক্ত বিণ্যাসে রক্ষিত হয়েছে।
আবুল ফজল এই অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন “সংগীত”। সংগীত শব্দের সংজ্ঞা নিরূপন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন — সংগীত হচ্ছে বিভিন্ন নাগমা (গীত), সাজ (বাদ্য) ও রক্স (নৃত্য) এবং এতদ্ব্যতীত অপরাপর বিষয় সম্পর্কিত বিদ্যা। এরপর তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই উদ্দেশ্যে সাতটি অধ্যায় পরিকল্পিত হয়েছে।
অধ্যায়গুলো হচ্ছে — স্বর অধ্যায় (অর্থাৎ আওয়াজ সম্পর্কিত তথ্য), রাগবিবেক অধ্যায়, প্রকীর্ণ অধ্যায় (অর্থাৎ আলাপ-এর রীতিনীতি সম্পর্কিত, নামটি সংগীত রত্নাকর থেকে গৃহীত), প্রবন্ধ অধ্যায়, তাল অধ্যায়, বাদ্য অধ্যায় এবং নৃত্য অধ্যায় ।
বাদ্য অধ্যায়ে বাদ্যযন্ত্রের প্রকারভেদ ও তৎসম্পর্কীয় আলোচনা এতে স্থান পেয়েছে। টীকাকার রাজ্যেশ্বর মিত্রের ভাবানুবাদ থেকে নিচের বিবরণ দেওয়া হলো–
বাদ্যযন্ত্র চার প্রকার, তত — যেগুলো তারে বাজানো হয়; বিতত হয়; ধন যেগুলো চর্মে আঘাত করে বাজানো দু’টি কঠিন বস্তু যাদের সংঘাতে আওয়াজ উৎপন্ন হয়; শুষির যেগুলো ফুৎকারযোগে বাজানো হয়। এই প্রত্যেকটির অনেকগুলো প্রকারভেদ আছে। আবুল ফজল এর কয়েকটি উল্লেখ করেছেন।
মিঞা তানসেন, তাঁর সংগীত জীবন এবং তাঁর বীশকার বংশের অবদান
সম্রাট আকবরের আকবরের রাজসভার সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ মিঞা তানসেন। কন্ঠ এবং যন্ত্রসংগীতে অসামান্য অবদান তাঁর জীবনকে কিংবদন্তীর ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তানসেনের জন্মকাল সম্বন্ধে বহু রকমের ধারণা প্রচলিত আছে, যেমন ১৪৯৩, ১৫০১, ১৫০৫-৬, ১৫১৬, ১৫২০ ১৫৩১ ইত্যাদি। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর সিংহাসনে আরোহন করেন।
এর সাত বছর পরে তানসেন আকবরের দরবারে স্থান লাভ করেন। ড. বিমল রায়ের মতে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ। এ প্রসঙ্গে দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, তানসেন যখন আকবরের দরবারে আগমন করেন তখন তাঁর পুত্রেরাও সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। দ্বিতীয়ত, তানসেন যখন আকবরের দরবারে যোগদান করেন তখন তিনি অতি বৃদ্ধ ছিলেন না।
কারণ তাঁর সংগীত প্রতিভা যদি একেবারেই নষ্ট হয়ে যেত তাহলে আকবরের দরবারে এসে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন না। আকবরের রাজত্ব শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবং তানসেন আকবরের দরবারে আসেন ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এ অবস্থায় তানসেনের জন্ম ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে হওয়ার সম্ভাবনা। তানসেনের উদ্ভাবনী শক্তি এবং মৌলিকতা ছিলো অসাধারণ।
তিনি প্রথমে ধ্রুপদ ও পরে প্রবন্ধ রীতিতে দক্ষতা অর্জন করেন। বাদ্যযন্ত্রেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিলো। বর্তমান পদ্ধতির আলাপ- স্থায়ী-অন্তরা- সঞ্চারী-আভোগ গান, স্বরের বৈচিত্র, কানাড়া-মল্লার-সারং-টোড়ী প্রভৃতি নতুন রাগ সৃষ্টি, দীপক রাগের নতুন রূপদান ইত্যাদি তাঁর চমৎকারিত্ব সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে। ‘
আইন-ই-আকবরী’ রচয়িতা আবুল ফজল বলেছেন, “তানসেনের মত গায়ক ভারতবর্ষে গত এক হাজার বছরে কেউ অন্যায় নি।” তিনি আকবরের দরবারে সকল সংগীতজ্ঞদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আকবরের রাজসভায় আসার আগে তানসেন রেওয়ার অন্তর্গত বন্ধগড়ের রাজা রামচাঁদ বাঘেলার রাজসভায় ছিলেন।
তাঁর দিল্লী আগমন সম্পর্কে আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা হয়েছে – “সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের ৭ম বর্ষে তানসেনের খ্যাতির কথা তিনি শুনতে পেলেন। তিনি আগ্রায় তানসেনকে নিয়ে আসবার জন্য একজন বাহককে (বাহকের নাম জালালউদ্দিন কুরচি) পাঠিয়ে দিলেন । আকবরের অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা রামচাদের ছিলো না।
তিনি বাদ্যযন্ত্র এবং অনেক উপহারসহ তানসেনকে আমায় পাঠালেন। তানসেন প্রথম রাজসভায় গান গেয়ে দুই লক্ষ টাকা ইনাম পেলেন। তিনি আকবরের সভায় থেকে গেলেন। তানসেন বৃন্দাবনের হরিদাস স্বামী এবং গোয়ালিয়রের শেখ মোহাম্মদ গাউস এই দু’জনের কাছে সংগীত শিক্ষা করেন। ফলে প্রথমোক্তজনের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং শেষোক্তজনের কাছ থেকে পারস্য সংগীতের উত্তরাধিকার লাভ করেন।
তাই তাঁর সৃষ্ট রাগগুলো ভারতীয় ও পারস্য সংগীতের চঙে মিশ্রিত। তানসেন একাধারে গায়ক, গীতিকবি, গায়নরীতির মৌলিক ধারার আবিষ্কারক, নতুন রাগ-রাগিনীর আবিষ্কারক, সংগীত শাস্ত্রকার এবং বাদ্যযন্ত্রবিশারদ ছিলেন। কিন্তু তাঁর গায়ক পরিচয়ের আড়ালে অন্য পরিচয়সমূহ ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। অথচ যন্ত্রসংগীতে তাঁর অবদান কম নয়। তাঁকে রবার যন্ত্রের উদ্ভাবক বলা হয়।
উদ্ভাবক এই অর্থে, সম্ভবত তিনি এই যন্ত্রটিকে নতুনভাবে ব্যবহার করার প্রথা শুরু করেছিলেন। রুদ্রবীণা নামে যে যন্ত্রটি তত্তালে প্রচলিত ছিলো এর বাঁ হাতে বাজানোর অংশটি (ফিংগার বোর্ড) বড় হওয়ার কারণে বাজাতে অসুবিধা হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য তানসেন একে নবরূপ দান করেন।
আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে কাসেম কোহবার নামক এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে রবাবের আবিষ্কর্তা হিসেবে। তবে সে যন্ত্রটির আকার অপরিশীলিত ছিলো। ধারণা করা হয় তানসেন এ যন্ত্রের আকারকে পরিশীলিত করেন এবং এই যন্ত্রে ভারতীয় সুরবৈচিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন। তার ফলে রবাব অন্যতম প্রধাণ সংগীতযন্ত্র হিসেবে পরিচিত হয়। হার্বার্ট এ. পপলি বলেছেন
“The Great Tansen played this instrument. It is a handsome instrument and has a very pleasing tone, somewhat fuller than that of the Sarangi.”
তানসেন রবাব যন্ত্রটিকে ধ্রুপদ অঙ্গের আলাপ বাজানোর উপযোগী করে তৈরি করেন। তানসেন একজন উচ্চমানের বীণাবাদক ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর পুত্রকন্যাদের মধ্যে এই বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার বিকাশ ঘটান। তাঁর কন্যা স্বরস্বতী সম্পর্কে নানা রকম কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। সমসাময়িক বীণকার মিশ্রি সিং (পরবর্তীকালে নৌবাৎ বা) এর সঙ্গে স্বরস্বতীর বিবাহ হয়। মিশ্রি সিং বীণে তানসেনের সহকারী সংগীতকার, দক্ষতায় অতুলনীয় বাদক ছিলেন।
নৌবাৎ খাঁর বংশধরেরা বংশপরম্পরায় বীণাবাদনে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। সেজন্য তানসেনের কন্যা বংশীয় শিল্পীরা যেমন বীণকার বংশ হিসেবে পরিচিত তেমনি তানসেনের সঙ্গে সম্পর্ক হেতু এই বংশ সেনী নামে পরিচিত এবং এই বংশের প্রচলিত ঘরানা সেনী ঘরানা হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করে।
তানসেনের পূর্বযুগের ধ্রুপদ রচয়িতাগন শব্দ ও ছন্দের ওপরে বিশেষ জোর দিতেন। তানসেন সুরের দিকে এবং সুরের মাধুর্যের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গোয়ালিয়রের সাধনার ফলস্বরূপ তাঁর ধ্রুপদে কথার বাহুল্যের পরিবর্তে তানের বাহুল্য এবং মীড়ের কাজের প্রয়োগ বেশি হয়েছে। তাঁর আলাপ পরিবেশনায় গভীরতা এবং আলঙ্কারিক প্রয়োগ বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
এই বিষয়টি পরবর্তীকালে তাঁর কণ্যাবংশীয় সেনী ঘরানার বীণকারদের বাদনে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মিঞা তানসেন এবং তাঁর বংশধরদের হাতে ‘আলাপ’ পরিপক্কতা লাভ করে, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট অবয়ব এবং কাঠামো লাভ করে। এ সময় থেকেই আলাপের পরিপূর্ন রূপ অর্থাৎ ‘দ্বাদশাঙ্গের আলাপ’ প্রচলিত হয়।
তানসেনের পুত্রকন্যাদের বিবরণ
তানসেনের কন্যা স্বরস্বতী ও জামাতা নৌবাৎ খাঁর বংশে বীণা বাদনের ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় প্রচলিত হয়ে যায়। অপরদিকে পুত্র বিলাস খাঁর বংশে রবাব যন্ত্রটি একটি প্রধান স্থান অধিকার করেছিলো। এ প্রসঙ্গে হার্বার্ট এ. পপলির মন্তব্য প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়।
“The disciples of Tansen divided themselves into two groups, the Rababias and the Binkars. The former used the new instrument invented by Tansen, the Rabab; while the later used the Bin, as the Vina is called in the North
নৌবাৎ খা একজন উঁচুদরের বীণকার ছিলেন। তাঁর আমলেই কিন্নরী বীণার সর্বাধিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। স্বরস্বতী বীণার বিবর্তনে নৌবাৎ বার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আকারের পূর্ণতা, স্বরের ব্যাপ্তি এবং অন্যান্য গুণাবলির বিকাশ সাধনের ফলে অন্যান্য বীণার চেয়ে এই স্বরস্বতী বীণা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। মীড়, গমক, ঘসিট, সুত এবং অন্যান্য আলঙ্কারিক পরিবেশনায় এটি একটি অনন্য বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয়।
ইতিহাসের এই পর্যায়ে ধ্রুপদ সংগীত শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করে এবং বীণা যন্ত্রটি এই ধারার সংগীত পরিবেশনের এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। তানসেনের বংশধরেরা কন্ঠ এবং বাদা, উভয় সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। শুধু পারদর্শী নন, তাঁরা অত্যন্ত প্রতিভাধর এবং নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী ছিলেন। তানসেনের পুত্র বংশে সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন সংগীতনায়ক ওস্তাদ বড়ে মুহাম্মাদ আলী খাঁ এবং তাঁর ছোট ভাই ওস্তাদ মুহাম্মাদ আলী খাঁ।
তাঁরা ধ্রুপদিয়া এবং রবাবিয়া ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর এই বংশের সমাপ্তি ঘটে। তানসেনের কন্যা বংশে সর্বশেষ উত্তরাধিকারদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সংগীতনায়ক ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ। তিনি ছিলেন ধ্রুপদিয়া এবং বীণকার। তাঁর পুত্র ওস্তাদ দবির খাঁ। এঁরাই ছিলেন কন্যা বংশের শেষ শিল্পী।
তবে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর শিষ্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ । ফলে সুরের পরম্পরা এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণার ধারাবাহিকতা চলমান থাকে এবং ভিন্ন পরিবেশে তা বিকাশ লাভ করে অবশেষে বিশ্বব্যাপি এদেশীয় বাদ্যযন্ত্রের পরিচিতি আনয়ন করে।
আরও দেখুন :