আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষার গুরুত্ব
বাংলাগানে স্বদেশপ্রেম বা চেতনা বিষয়টি মূলত নিধুবাবুর পর্বের পরে আলোড়িত হয়। নিধুবাবুর যেহেতু প্রেমের গানেই পদচারণা ছিলো, তাই স্বদেশপ্রেমের গানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তথাপি মাতৃভাষা বাংলার মহিমা নির্ভর তাঁর একটি মাত্র গান আজো অনন্য হয়ে আছে।
“নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা।
জাতীয় জাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ‘ব্রহ্মসংগীত’ ধারা প্রবর্তন করেন এবং তাঁর রচিত সেই ধর্মসংগীতেই আমরা সর্বপ্রথম ‘স্বদেশ’ কথাটির ব্যবহার দেখতে পাই। ব্রহ্মোপাসনার সাথে দেশমাতৃকার উপাসনার এক অপূর্ব সমন্বয় করেছেন তিনি, যদিও এমনটা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের কিছু গানেও অনুভূত হয়। রামমোহন রায় রচিত ব্রহ্মসংগীতে স্বদেশ কথাটির প্রকাশ পাই নিচের গানটিতে-
“কি স্বদেশে কি বিদেশে যথায় তথায় থাকি
তোমার রচনার মধ্যে তোমাকে দেখিয়া ডাকি ।
এরপরে আরোও বহু গুণিজনের লেখায় হিন্দুমেলা, সঞ্জীবনী সভা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে স্বদেশপর্বের গান রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্বে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। তবে মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সেসময়ে বিশেষ রচনা চোখে পড়ে না। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশে বহুবিধ বাংলা বই ও পত্র-পত্রিকার সাহাচার্য পেয়েই সন্তানরা বড় হয়েছে।
তাই রবীন্দ্রনাথেরও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা, বোঝাপড়া ও রসদদার হয়ে উঠার কারণ মূলত ঠাকুরবাড়িতে বাংলা চর্চা। সেইকালে বিদ্যালয়গুলোতে ও কর্মক্ষেত্রে ‘মাতৃভাষা’ প্রতিষ্ঠা লাভ না করলেও ভদ্রলোকদের বাড়িতে এর কদর ছিলো এবং গ্রন্থ ও সাময়িক পত্র মুদ্রণেরও উৎসাহ ছিলো ব্যাপক। কিশোর রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই মাতৃভাষাপন্থি হয়ে ওঠেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পড়ে তিনি বড় হয়েছেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন-‘যখন বঙ্গদর্শন প্রথম বাহির হয়েছিল, তখন আমি যুবা বা তার চাইতেও কম বয়সের… বাংলা ভাষা এখন অনেক পরিপূর্ণ; তখন নিতান্ত অল্প পরিসর ছিলো। এখানে প্রকাশ যে উনিশ শতকের সত্তরের দশকে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিলো না। বরং বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি কম প্রদর্শিত হতো।
যে কারণে গানে কবিতায় বা যেকোনো লেখনিতে ভাষার জন্য স্তুতি বন্দনা তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু কিশোর রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও দায়বোধের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। উনিশ শতকের শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মাতৃভাষা প্রচারে নিযুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে না বুঝে ও না দেখে বিজাতীয় ভাব ও ইংরেজি বাক্য মুখস্থকামী নির্জীব শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন।
এ থেকে বাঙালি ছাত্রদের মুক্তি প্রার্থনা করেছেন। সাধনাতে শিক্ষার হেরফের’ প্রকাশিত হলে বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে চিঠি লেখেন এবং বঙ্কিমচন্দ্র যে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা ও এর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো বিধায় ১৮৮৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত পরীক্ষার ফলাফল ছিলো হতাশাজনক।
এ বিষয়ে সিনেট সদস্যরা তাদের এহেন উদ্বেগের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। একজন সিনেটর হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র এই নৈরাশ্যজনক ফলাফলের কারণ হিসেবে অনুধাবন করলেন যে পাঠক্রমে বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত সংকুচিত অবস্থান। সেই সময় উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রবেশিকা পরীক্ষা থেকে এম এ পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরে মাতৃভাষার যথাযোগ্য পরিসর প্রদানের প্রস্তাব করেন।
যদিও বাংলা ভাষাপন্থিরা ১৭-১১ ভোটে হেরে যায়, তথাপি বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ স্ব স্ব ক্ষেত্রে মাতৃভাষা প্রচারকামী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনার অনেক ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার স্তুতি বন্দনা করেছেন। এই ভাষার গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁর স্বদেশপর্বের কতিপয় গানেও। কারণ স্বজাতি মাতৃভূমিকে মুক্তির প্রথম ও প্রধান শর্ত মাতৃভাষাকে রক্ষা করা।
নিজের ভাষা তথা মুখের বুলি হারিয়ে গেলে কোনো জাতি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই স্বদেশপর্বের ১নং গানে কবি মায়ের মুখের বাণীকে সুধার মতো অনুভূত করেছেন। কারণ নিজ ভাষার মতো এত মিষ্টি কোনো সুর হতে পারে না। মাতৃভাষাতে ভাব প্রকাশে যে আনন্দ তা ধার করা ভাষাতে কখনো সম্ভব হয় না। আবার ভারতবাসীর কাতর পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে স্বদেশপর্বের ১৬নং গানে তিনি বলেছেন-
“… দৈন্য জীর্ণ কক্ষ তার মলিন শীর্ণ আশা,
গ্রাসরুদ্ধ চিত্ত তার, নাহি নাহি ভাষা ।
ভাষাবিহীন কোনো জাতি বলিষ্ঠ হতে পারে না। পারে না পরাধীনতার অভিশাপ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে। তাই রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য। কারণ এরফলে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সকলক্ষেত্রে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার স্তুতি বন্দনা করেছেন স্বদেশপর্বে অন্তর্গত তাঁর প্রায় সকল গানে। তবে আলাদা করে বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে ঈশ্বরের কাছে বাঙালির মন, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষাকে সত্য যে প্রার্থনা তিনি করেছেন তা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে সকলের মুখে মুখে গীত হয় এবং সর্বস্তরের মানুষ এই গানটি গাইতে গাইতেই পথে নেমে আসেন।
হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে প্রত্যেকে প্রতিজনকে রাখি পরায় বাংলার মাটি, বাংলার জলকে পুণ্য করবার প্রয়াসে। কাহার সুধাময়ী বাণী মিলায়। অনাদর মানি/কাহার ভাষা হায় ভুলিতে সবে চায় / সে যে আমার জননী রে।
“জাতীয় সংগীত পর্বের অন্তর্গত এই গানটির মধ্যে দেশমাতার সুধাময়ী বাণী তথা মাতৃভাষার অবমাননার কথা বলেছেন কবি। দেশমাতার প্রতি ভীরু সন্তানের আচরণে শংকিত ও ব্যথিত কবি। কারণ নিজের ভাষার প্রতি যদি সম্মান না থাকে, মায়ের ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য ভাষাতে যে জাতি অভ্যস্ত হয়, সে জাতি কখনো সূর্যোদয় দেখতে পায় না। মাতৃভাষা স্বাধীনতা তথা মুক্তিকামী মানুষের মেরুদণ্ড স্বরূপ। তাই কবি চিন্তিত।
এই সকল গানের ভেতর দিয়ে তিনি স্বজাতির চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন বোধে জাগ্রত করবার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে-‘ব্রিটিশ আমলে ১৮৪৪ সালেই স্কুলে বাংলা ভাষার পড়া অধিকার সরকারি স্বীকৃতি পায়।
আরও দেখুন :