আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় মায়ার খেলা
মায়ার খেলা
মায়ার খেলা
এরপরই আসে বিখ্যাত রবীন্দ্রগীতিনাট্য ‘ময়ার খেলা’র কথা। সখীসমিতির জন্য এই গীতিনাট্যটি রচিত হয়েছিলো (১২৯৫)। মায়ার খেলা গীতিধর্মী রচনা। ৬৩টি কাব্যগীতির সমন্বয়ে এই নাটক রচিত। এর মধ্যে অনেকগুলো গান সুরে ও বাণীতে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ রচনার অন্তর্গত। এতগুলো দীর্ঘ গানের সন্নিবেশের ফলে মায়ায় খেলার নাট্যক্রিয়া অত্যন্ত শিথিল হয়ে গেছে।
তবে তার স্থলে পাওয়া গেছে আবেগ গভীরতা। এই নাটকে অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি প্রেমের গান, ঋতুসঙ্গীত পূর্বে পৃথক গান হিসেবে রচিত হয়েছিল। কিন্তু অতি অনায়াসেই সেসব গান এখানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। মানসী যে বাইরের ভুবনে নেই, সে থাকে অন্তরে, অন্তরের তার যথার্থ অবস্থান সে কথা অমর জানতনা, জানিয়ে দিলেন মায়াকুমারীগণ দ্বিতীয় দৃশ্যে:
মনের মতো কারে খুঁজে মর
সে কি আছে ভুবনে
সে যে রয়েছে মনে
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।
দ্বিতীয়-দৃশ্যে মায়াকুমারীগণ প্রস্থান করলে নেপথ্যপানে চেয়ে শান্তা গাইল:
আমার পরাণ যাহা চায়
তুমি তাই তুমি তাই গো
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে আর কিছু নাহি চাই গো ।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর কারে ভালোবাস
যদি আর ফিরে নাহি আস
তবে তুমি যাহা চাও তাও যেন পাও।
আমি যত দুঃখ পাই গো ।

এর ভেতর দিয়ে যেন বাংলার টপ্পার সেই বহুত কথাটিকেই নতুন করে শোনা গেল: বিরহেই প্রেমের গভীরতম উপলব্ধি, বা বিরহই প্রেমে: অনিবার্য পরিণতি। মায়ার খেলার প্রেমসঙ্গীত সমূহের প্রায় সবই বিষণ্ন গান, সব গানেই মনোবেদনার অশ্রুবাষ্পাকুল প্রকাশ।
তবে এই গান চিরন্তন মানবমানবীর শাশ্বত বিরহের সঙ্গীত নয়, এই নবযৌবনদৃষ্ট নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদ, এদের হৃদয়ের স্পন্দনও যেন এসব গানের মধ্যে ধ্বনিত হয়। মায়ার খেলায় এসব গানেরই এক অসামান্য সমারোহ, যেমন-
আমার পরান যাহা চায়,
সখী বহে গেল বেলা,
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান,
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি,
সুখে আছি সুখে আছি সখা আপন মনে,
দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি,
আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল,
অলি বার বার ফিরে যায়,
বিদায় করেছ যারে নয়নজলে, না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে,
মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে,
আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে
প্রভৃতি অসামান্য সব প্রেম ও প্রকৃতির গান এই গীতিনাট্যে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মায়ার খেলা পর্যায় থেকেই রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী প্রেম ও প্রকৃতিসঙ্গীত রচনার সূত্রপাত।
আরও দেখুন :