আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রজনীকান্ত সেনের গানে স্বদেশচেতনা
রজনীকান্ত সেনের গানে স্বদেশচেতনা
রজনীকান্ত সেনের গানে স্বদেশচেতনা
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের কবি রজনীকান্তের গানে স্বদেশের প্রতি চেতনার উন্মেষ কতটা তা আত্মকরণে তাঁর রচিত সকল স্বদেশ পর্যায়ের গান পর্যালোচনা প্রয়োজন। তাঁর রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানের নির্ধারিত সংখ্যা বলা যেমন মুশকিল তেমনি মুশকিল এই গানগুলোর রচনাকালসহ প্রেক্ষাপট নিরূপণ করা। তাঁর সামগ্রিক রচনার প্রায় ৩০টি গানে স্বদেশানুভূতি পরিলক্ষিত হয় যা স্বদেশ, নারীজাগরণ, হাসির গান আবার কখনো ঈশ্বর আরাধনা সম্পর্কীয়।
এর প্রায় সকল গানেই কবির আত্মনিবেদনের ভঙ্গিমাটি পরিলক্ষিত হয়। রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম সৌর্যদীপ্ত সোনালি দিন নয় বরং শ্যামলা বরণে বটবৃক্ষের কোমল ছায়া-যা মনকে শান্ত করে, অন্তরকে ব্রতী করে আত্মত্যাগের মহিমায়। রজনীকান্তের স্বদেশ চেতনার গান স্বদেশের প্রকৃতি ঐশ্বর্যে পরিবেষ্টিত এক চিরায়ত বাংলা মায়ের রূপ-যেখানে কোনো অহংকার নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, আছে কেবল আত্মনিবেদনের করুণ আকুতি।
দেশমায়ের তরে নিজেকে বিলীন করবার নীরব প্রত্যয়। রজনীকান্তের ব্যক্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই তাঁর স্বদেশানুভূতির গানগুলোতে পরিলক্ষিত। স্বদেশি আন্দোলনের বহু পূর্ব থেকেই তাঁর হৃদয়ে দেশের দুর্দশায়, দেশের মানুষের করুণ অবস্থায় আন্দোলিত হয়ে উঠতো। তাঁর গান ও কবিতার মধ্যদিয়ে দেশমাতৃকার জন্য বিচলিত মনের আকুতি ব্যক্ত করতেন।
কবির কবিতা ও গান নিয়ে রজনীকান্তের অজান্তেই অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয় ছাপার ব্যবস্থা করেন এবং সেই গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ‘বাণী’ এটিই তাঁর প্রথম বই এবং এই বইয়ের গান ও কবিতা মানুষের অন্তরকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে রজনীকান্তের গান-কবিতার কদর বৃদ্ধি পায়। যখন ‘বাণী’ প্রকাশিত হয় তখনো স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়নি। অথচ সেই বইতে আমরা পাই ‘ভারত মাতা’কে জাগ্রত করবার কবির আকুতি,
“ভারতকাব্যনিকুঞ্জে—
জাগ সুমঙ্গলময় মা!
মুঞ্জরি তরু, পিক গাহি’,
করুক প্রচারিত মহিমা।
ভারতমাতাকে কবি অবলোকন করেছেন চির দুঃখ-শয়ন বিলীনা বলে যার বীণা তো আছে কিন্তু সে বীণার গান আর বাজে না। কবি এই গানটির শুরু এবং শেষে ভারতমাতার এই লুপ্ত গরিমাকে জাগিয়ে তুলবার প্রয়াস পেয়েছেন। দুখিনী ভারতমাতার এতো ঐশ্বর্য তবুও লুপ্ত এর আভা। কবি এর পুরাতন লুপ্ত গরিমাকে গীতিধর্মময় দীপক মন্ত্রে জাগিয়ে তুলতে স্বদেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।
সুমঙ্গলময়ী মা জেগে উঠলেই ভারত বীণা বেজে উঠবে। সে বীণার সঞ্জীবনী মন্ত্রবলে মায়ের সম্মানকে স্বর্গ জ্ঞানে সকলে পথে নেমে গাইবে এর গীতসুধা। এমনি জন্মভূমির গৌরবগাঁথা স্তুতি বন্দনা গেয়েছেন। কবি নিচের গানটিতেও
“জয় জয় জনমভূমি, জননী !
যাঁর, স্তন্যসুধাময় শোণিত ধমনী;
কীৰ্ত্তি-গীতিজিত, স্তম্ভিত,
অবনত মুগ্ধ, লুব্ধ, এই সুবিপুল ধরণী।
কবি এই গানে জন্মভূমির জয়গান গেয়েছেন। এই জন্মভূমির স্তুতি বন্দনায় মুগ্ধ ধরণী। শ্যামল-শস্য- পুষ্প আর ফলে পরিপূর্ণ এ ভূমি সকল দেশের রাণী। অপরূপ বাণীর সংযোজনে স্বদেশপ্রেমের গানের এক অন্য রূপ পরিলক্ষিত হয় এই গানটিতে। জন্মভূমির প্রকৃতির নানাদিক তুলে ধরে কবি গানটির মধ্যদিয়ে মায়ের সন্তানদের গৌরবান্বিতের অনুভূতিতে সিক্ত করতে চেয়েছেন। স্বদেশের শ্যামলা রূপের আচ্ছাদনে মুগ্ধ কবি। এমনই উদাহরণ রয়েছে তাঁর বহু গানে,
“তব, চরণ-নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা,
ঊর্দ্ধে চাহ, অগণিত-মণি-রঞ্জিত-নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা, শান্ত-কুশল-দরশা।
আর্যগরিমা এবং কীর্তিকাহিনিতে মুগ্ধ রজনীকান্ত স্বদেশবাসীকে মুগ্ধ করবার প্রয়াসে তাঁর প্রায় সকল স্বদেশি গান ঐতিহাসিক পটভূমিসহ দেশমাতার নদী, পাহাড় ও প্রকৃতির ঐশ্বর্যমণ্ডিতরূপে পরিপূর্ণ। রজনীকান্ত সেনের স্বদেশপ্রেমের গানের উপমায় অন্যরকম এক শব্দযোজনা রয়েছে যা সমসাময়িক অন্য কবিদের গানে অনুপস্থিত।
তবে রজনীকান্তের সহজ শব্দের গান মানুষের মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। কবি মূলত সংস্কৃত সাহিত্যের বিচিত্ররূপে স্বদেশমাতার রূপটি আপন মনে চিত্রায়ন করেছিলেন। এবং সেই কল্পনার সূক্ষ্ম ও নিপুণ রূপটি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন বারবার। কবির ভাষায়-
“তবু ভাঙ্গে না ঘুমের ঘোর,
দ্যাখ হয়েছে যামিনী ভোর।
ওই নবীন তপন মহাজাগরণ
আনে না নয়নে তোর!
এই গানটিতে কৰি তীব্র আবেগের মধ্যদিয়ে সকলকে জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন। এতোসব প্রাকৃতিক মহিমা এবং ঐতিহাসিক বীরগাঁথা থাকা সত্ত্বেও অন্ধ হয়ে আছে ভারত মায়ের সন্তানেরা। কবি এ সকল সন্তানদের মায়ের অতল গর্ভে ডুবে মরতে বলেছেন। রাতের অবসান হয়েছে, এবেলা জেগে না উঠলে সকলই বৃথা যাবে। কৰি এ গানটিতে ‘জাগ জাগ’ বলে মহাজাগরণে সকলকে এক হতে আহ্বান করেছেন।
তেমনি মায়ের ঘরে শুধু মোটা ভাত, ঘি আর কলার পাতায় খুশি থাকার সম্মান। প্রসাদ ভিক্ষা গ্রহণের থেকে অনেক বেশি আত্মতৃপ্তির বলে প্রকাশ করেছেন কবি। তাঁর ভাষায়, ‘তাই ভালো, মোদের মায়ের ঘরের শুধু ভাত / মায়ের ঘরের ঘি-সৈন্ধব, মার বাগানের কলার পাত। এই গানটির মধ্যে কবির সেই বিশ্বখ্যাত জনআন্দোলিত গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটির অনুরণন শুনতে পাওয়া যায়।
নিজের দেশের খেতের মোটা ধানে যে সম্মান তা ভিক্ষা করা চালে নেই। নিজের খেতের ধান সোনার মতো খাঁটি। যেচে আনা মিহি কাপড়ে শুধু লজ্জা বাড়ে আর প্রকৃত সম্মান দেয় নিজের বোনা মোটা কাপড়ে। কবি এ সকল উপমায় নিজের দেশের চাষী, তাঁতীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছেন লাঙ্গল ধরতে, তাঁত চালাতে। নিজের দেশকে সমৃদ্ধ করতে আর অন্য কোনো পথ নেই।
তাই ভিক্ষা বৃত্তি নয় নিজের যা আছে তাই নিয়ে শুরু করতে বলেছেন কবি। এই গানেরই আরেকটি ভাষ্য রজনীকান্ত সেনের মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি। যে গানে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;/ দীনদুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।
এই গানটির মধ্যদিয়ে রজনীকান্ত সেনের নাম বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির প্রাণের কবি হয়ে ওঠেন তিনি। বাঙালির কণ্ঠে এ গান ধ্বনিত হয় প্রাণের নিঃসৃত উচ্চারণ হয়ে। বাঙালির বহুদিনের ঘুম ভাঙানিয়া যাদুমন্ত্র যেন এই গান। অলস এবং আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য এ গানটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করলো। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের বোঝা বহন করা যে প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব।
তাই কবি এই গানটির মধ্যদিয়ে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুল-কলেজের ছাত্র- ছাত্রী থেকে শুরু করে সকলের কাছে এই গানটির মধ্যদিয়ে এক অন্য রজনীকান্তের প্রকাশ পায়। রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম এই গানটির মধ্যে স্বদেশমাতার যে মমতাময়ী রূপ অবলোকন করিয়েছিলেন কবি, তাতে বাঙালি মনের ভক্তি বিগলিত হয়, নতজানু হয় স্বদেশ মাতৃকার স্নেহভরা অনাবিল মহিমায়। কবি নিজে ‘২১শে বৈশাখ শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বক্সী মহাশয়কে লিখেছিলেন,
“আমার মনে পড়ে, যে দিন মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় গান লিখে দিলাম, আর এই কলিকাতার ছেলেরা আমাকে আগে করে (শোভাযাত্রা) বের ক’রে এই গান গাইতে গাইতে গেল, সে দিনের কথা মনে করে আমার আজও চক্ষে জল আসে।
এই গানটির রচনার ইতিহাস নিয়েও জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কোন সেই মাহেন্দ্রক্ষণে গানটি রচিত হয়েছিল তা জানবার কৌতূহল অযৌক্তিক নয়।
এ প্রসঙ্গে শ্রী জলধর সেনের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, “তখন স্বদেশীর বড় ধুম। একদিন মধ্যাহ্নে একটার সময় আমি ‘বসুমতী’ আফিসে বসিয়া আছি, এমন সময় রজনী রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম এবং রাজসাহীর খ্যাতনামা আমার পরম শ্রদ্ধেয় হরকুমার সরকার মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান অক্ষয়কুমার সরকার আফিসে আসিয়া উপস্থিত। রজনী সেই দিনই দার্জিলিং মেলে বেলা এগারটার সময় কলিকাতায় পৌঁছিয়া অক্ষয়কুমারের মেসে উঠিয়াছিল।
মেসের ছেলেরা তখন তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে একটা গান বাঁধিয়া দিতে হইবে। গানের নামে রজনী পাগল হইয়া যাইত। তখনই গান লিখিতে বসিয়াছে। গানের মুখ ও একটা অন্তরা লিখিয়াই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। সকলেই গানের জন্য উৎসুক; সে বলিল, এই ত গান হইয়াছে, চল জলদার ওখানে যাই। একদিকে গান কম্পোজ হউক আর একদিকে লেখা হউক। এই জন্য তাহারা সেইবেলা একটার সময় আসিয়া উপস্থিত।
অক্ষয়কুমার আমাকে গানের কথা বলিলে রজনী গানটি বাহির করিল। আমি বলিলাম, “আর কৈ রজনী?” সে বলিল, “এইটুকু কম্পোজ করিতে দাও, ইহারই মধ্যে বাকিটুকু হইয়া যাইবে। ” সত্য সত্যই কম্পোজ আরম্ভ করিতে না করিতেই গান শেষ হইয়া গেল। আমরা দুই জনে তখন সুর দিলাম। গান ছাপা আরম্ভ হইল; রজনী ও অক্ষয় ৩০/৪০ খানা গানের কাগজ লইয়া চলিয়া গেল। তাহার পর তাহাদের দলের অন্যান্য ছেলেরা আসিয়া ক্রমে (ছাপা) কাগজ লইয়া গেল ।
সন্ধ্যার সময় আমি সুকবি শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী মহাশয়ের বিডন স্ট্রীটের বাড়ীর উপরের বারান্দায় প্রমথবাবু ও আরও কয়েকজন বন্ধুর সহিত উপবিষ্ট আছি রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম, এমন সময় দূরে গানের শব্দ শুনিতে পাইলাম। গানের দল ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইল। তখন আমরা শুনিলাম, ছেলেরা গাইতেছে-“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই।
এইটি রজনীকান্তের সেই গান- যাহা আমি কয়েক ঘণ্টা আগে ছাপিয়া দিয়াছিলাম। গান শুনিয়া সকলে ধন্য ধন্য করিয়াছিল; তাহার পর ঘাটে, মাঠে, পথে নৌকায়, দেশ-বিদেশে কত জনের মুখে শুনিয়াছি।
এ গান প্রসঙ্গে বঙ্গসাহিত্যের অকপট ও নিষ্ঠাবান সেবক সুরেন্দ্রচন্দ্র সমাজপতি মহাশয়ের উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য-
“কান্তকবির ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ নামক প্রাণপূর্ণ গানটি স্বদেশী সঙ্গীত-সাহিত্যের ভালে পবিত্র তিলকের ন্যায় চিরদিন বিরাজ করিবে। বঙ্গের এক প্রাপ্ত হইতে আর এক প্রাপ্ত পর্যন্ত এই গান গীত হইয়াছে। ইহা সফল গান। যে সকল গান ক্ষুদ্র-প্রাণ প্রজাপতির ন্যায় কিয়ৎকাল ফুল- বাগানে প্রাতঃসূর্য্যের মৃদুকিরণ উপভোগ করিয়া মধ্যাহ্নে পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া যায়, ইহা সে শ্রেণীর অন্তর্গত নহে।
যে গান দেববাণীর ন্যায় আদেশ করে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর মত সফল হয়, ইহা সেই শ্রেণীর গান। ইহাতে মিনতির অশ্রু আছে, নিয়তির বিধান আছে। সে অশ্রু, পুরুষের অশ্রু- বিলাসিনীর নহে। সে আদেশ যাহার কর্ণগোচর হইয়াছে, তাহাকেই পাগল হইতে হইয়াছে।
স্বদেশীযুগের বাঙ্গালা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আমার দেশ’ ভিন্ন আর কোন গান ব্যাপ্তি, সৌভাগ্য ও সফলতার এমন চরিতার্থ হয় নাই, তাহা আমরা মুক্তকণ্ঠে নির্দ্দেশ করি।স্বদেশীয় সূচনার কালে লোকান্তরিত পশুপতিনাথবাবুর বাড়ীতে যে দিন এই গান প্রথম শুনিলাম সেই দিন মুহূর্তে এই অগ্নিময়ী বাণীর আদেশ শিরোধার্য্য।
সেই উত্তাল সময়ে এই গান শুনে রোমাঞ্চিত হয়নি এমন ব্যক্তি বিরল। কান্তকবির এই গানটির মধ্যদিয়ে বাঙালি হৃদয়ে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মায়ের ঘরের তাঁতে বোনা কাপড়ে যে অপার স্নেহ মায়ের ঝিমিয়ে পড়া ঘুমিয়ে থাকা সন্তানদের মাঝে কৰি দেখতে চেয়েছিলেন।
স্বর্গীয় আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এ গান প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ১৩১২ সালের ভাদ্র মাসে বঙ্গব্যবচ্ছেদ ঘোষণার কয়েকদিন পরে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট ধরিয়া কতকগুলি যুবক নগ্নপদে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান গাহিয়া যাইতেছিল। এখনও মনে আছে, গান শুনিয়া আমার রোমাঞ্চ উপস্থিত হইয়াছিল ।
এই গানের এমনই এক শক্তি ছিলো। দেশের ও দশের মঙ্গল কামনায় যখন সুবাতাস বইতে লাগলো সকলের মনে, দেশীয় শিল্প, স্বদেশজাত পণ্য ও বস্ত্র ব্যবহারের আকুলতা দেখা দিল সর্বত্র। সভা- সমিতিসহ সর্বত্র দেশি পণ্য ব্যবহারের আনন্দ জোয়ার বইতে থাকে। বোম্বাই আহমেদাবাদে সাধারণ বাঙালির জন্য মোটা কাপড় বয়নের ব্যবস্থা করা হল।
কিন্তু সকল বাঙালির মনে বিশেষ করে মিহি সুতোয় অভ্যস্ত বাঙালির পক্ষে অত সহজে মোটা সুতোয় অভ্যস্ত হওয়া সহজ ছিলো না। বরং অনেকেই মোটা কাপড়ের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। এ যেন সকল আয়োজন বৃথার উপক্রম! ঠিক সেই সময় চারিদিক মুখরিত করে রাজশাহীর কবি রজনীকান্ত সেন গেয়ে ওঠেন বাঙালির আত্ম- শুদ্ধির গান। তিনি খালি গায়ে কাঁধে হার্মোনিয়াম নিয়ে পথে পথে এই গানটি গেয়ে চলেন।
প্রথমে দুই- এক জন, পরে ধীরে ধীরে কাতারে কাতারে ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলে যুক্ত হয় সে পদযাত্রায়। সকলের কণ্ঠে একই গান। ছিটকে পড়া মোহগ্রস্ত বাঙালির চিত্ত জাগানিয়া সেই গান মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নেরে ভাই, দীন দুখিনি মা যে তোদের, তাঁর বেশী আর সাধ্য নাই’। এই গানের শক্তি এতো বেশি ছিলো যে জাতিগত ভাবনায় আবেগের জোয়ার বইয়ে দিলেন কবি।
এমনিভাবে এই গানের মধ্যদিয়ে দেশের তাঁতীদের আবার জাগতে বলেছেন, দেশবাসীকে দোকান সাজাতে বলেছেন দেশি পণ্যে। কারণ কবি জানেন মায়ের সাত কোটি সন্তান জেগে উঠলেই ‘মা’-কে কলঙ্ক মুক্ত করা সম্ভব নচেৎ নয়, ‘আমরা, নেহাৎ গরীব, আমরা নেহাৎ ছোটো /তবু, আজি সাত কোটি ভাই, জেগে ওঠ !
কবি এই গানটির মধ্যদিয়ে হাসির ছলে ভারতবর্ষের তৎকালীন চির সত্যকে তুলে ধরেছেন। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যে বাণিজ্য ঘাটি বানিয়েছিল ভারত মায়ের কোলে, তা শোষণ করে নিচ্ছিল এ মায়ের কোমলতা, মধুরতা। রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম তাই কবি নিজের দেশের কোনো পণ্য বিদেশে পাচার না হতে দিতে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। কারণ নিজের শয্য পণ্য বিদেশে পাঠিয়ে নিজেরা উপবাস করা আত্মহননের সামিল।
নিজের পণ্য বিদেশে পাঠিয়ে বিদেশি পণ্যে মায়ের সন্তানকে অভ্যস্তে বাধ্য করছিল। শোষকশ্রেণি। কবি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। নিজের মায়ের ঘর শূন্য হওয়া থেকে বাঁচাতে সকলকে এক হতে আহ্বান করেছেন এই গানটির মধ্যদিয়ে। কারণ গরিব হলেও সংখ্যাতো সাত কোটি। মায়ের সকল সন্তান এক হলে কোনো প্রতিকূলতাই মায়ের সন্তানদের শক্তির কাছে টিকবে না।
এমনি আহ্বান শুনতে পাই কবির এই গানটিতেও, ‘রে তাঁতী ভাই, একটা কথা মনে লাগিয়ে শুনিস্:/ঘরে তাঁত যে ক’টা আছে রে, তোরা স্ত্রী-পুরুষে বুনিস ॥
এক অপূর্ব বাস্তববাদী চিত্র তুলে ধরেছেন কবি এখানে। তিনি স্ত্রী-পুরুষ সকলকে কাজে হাত লাগাতে বলেছেন। তাঁতে বোনা কাপড় কলের কাপড়ের তুলনায় কমও হয় তবুও কবি মাকু চালাতে বলেছেন । নিজের দৈন্যতা, হীনতা দূর করবার এর থেকে উৎকৃষ্ট পন্থা আর নেই। ঈশ্বর ভক্ত কবির এ এক ব্যতিক্রমী অনুপ্রেরণার বাণী। অবচেতনে জাতির বোধ জাগাবার এমনি নিরলস প্রচেষ্টা কবির। বঙ্গভঙ্গের পর সকল বাঙালির মনে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে।
হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব সকলে এক হয়ে তখন ভারতবর্ষের এই কালিমা ঘুচাতে সংঘবদ্ধ হন। এই ঐক্যবদ্ধতা শাসকশ্রেণির মনে শঙ্কা সৃষ্টি করে। তাই তারা প্রতিনিয়ত নানা কৌশলে রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম, রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম শাসকযন্ত্রের নানা আয়োজনে বাঙালির ঐক্যের এই শক্তি ভাঙতে প্রচেষ্টা চালায়। এই গানটির মধ্যে কবির অন্তরের গভীর দেশপ্রেম ব্যক্ত হয়েছে-যা বাস্তব অবস্থার বলিষ্ঠ উচ্চারণ।
“বন্দে মাতরম’ গানটি আইনের চোখে অপরাধ ঘোষিত হলে সর্বসাধারণের মনে এক হাহাকার রবের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি প্রদান করা হলো,
“The months that followd the 16th October, 1905, were months of great excitement and unrest. The policy of the government especially that of East Bengal under Sir Bampfylde Fuller, added to the tension of the situation…
The partition was followed by a policy of repression which added to the difficulties of the Government and the complexities of the situation. The cry of Bande-Mataram, as I have already observerd was forbidden in the public streets and public meetings in the public places were prohibited.”
সেই সময়ে আরো দুটি গান বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল। গান দুটি হলো ‘তব চরণ নিয়ে উৎসময়ী শ্যামধরণী দে সরসা’ এবং ‘সেথা আমি কি গাহিব গান।’ দেশপ্রেমের গভীর অনুরাগে রজনীকান্তের হৃদয় ছিলো পরিপূর্ণ। তেমনি আবেগভরা বাণীর সম্মিলন সেই সময়ের রচিত গানসমূহ,
সেথা আমি কি গাহিব গান?
যেথা, গভীর ওঙ্কারে, সাম ঝঙ্কারে,
কাঁপিত দূর বিমান
কবি এই গানটিতে ভারতবর্ষের অতীত গরিমার বর্ণনা করেছেন। তুলে ধরেছেন প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের মুগ্ধতার কথা। এতো যার শোভা, এতো যার ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভূমি সে ভারতমাতা আজ অতীতের প্রাণশূন্য। পাখির মধুর কণ্ঠ, মোহনমন্ত্র দূর বিমানের হুঙ্কারে বিরস, মলিন, শোভাহীন। তাই কৰি অন্তরের গ্লানি, আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এই গানটিতে।
এমনি আরো একটি অপরূপ গানের কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ‘নীল সিন্ধু ওই গর্জে গভীর:/ ভৈরব রাগ-মুখর করি’ তীর।
সংস্কৃতপ্রেমী রজনীকান্ত সেন অদ্ভুত বাণীর দ্যোতনায় সাজিয়েছেন সিন্ধু ও ভূমিখণ্ডের অভূতপূর্ব বিপরীত সৌন্দর্যকে। কবি সমগ্র গানটি জুড়ে জলভাগ, ভূমিখাত ও চন্দ্রের অপরূপ শোভার বর্ণনা করেছেন এক নিপুণ সমীকরণে।
এতোসব কঠিন বাণীর গান যেমনি রচনা করেছেন রজনীকান্ত, তেমনি রয়েছে একান্ত চেনা সহজ সরল সুরের গান। যে সুরের মধ্যদিয়ে সাধারণের অন্তপুরে প্রবেশ করা সহজতর হয়। রজনীকান্তের নিজগ্রাম ভাঙ্গাবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর কবি স্বদেশচেতনা জাগাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। একবার পাশের গ্রামে গিয়ে করি হতবাক হয়েছিলেন।
যেখানে কৰি সকলকে মোটা কাপড়ে উদ্বুদ্ধ করতে ছুটে চলেছেন সেখানে উচ্চ সম্প্রদায়ে চলছে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে রেষারেষি। কবি এ দৃশ্যে খুবই আহত এবং বিব্রত হলেন। রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেম যেখানে অন্তরের সংকীর্ণতার কারণে একজন অন্যের ধর্ম বা দীক্ষাকেই শ্রদ্ধা করতে পারছে না, সেখানে কী করে কবি তাদের স্বদেশমাতার ব্রতে এক করবেন। কবি চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে এলেন এবং রচনা করলেন, ‘ভেদ-বুদ্ধি, ছাড়, ‘দূর্গা’, ‘হরি’, দুই তো নয়, একেরি দুই পরিচয়।
কবি গ্রামের পথে পথে গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে এই গানটি গেয়ে শুনাতে লাগলেন। সহজ কথার ও সহজ সুরের সত্য উপলব্ধির এই গান সকলের অন্তরে ভাবের সঞ্চার করে এবং উভয় সম্প্রদায়ের লোক গভীর আবেগে রজনীকান্তের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেন। তিনি সকল ভেদাভেদ ভুলে এক হবার পথ দেখালেন এবং তাঁর ‘মোটা কাপড়ের মন্ত্রে সকলকে দীক্ষিত করলেন। কবির ভাষায়,
“তিমিরনাশিনী, মা আমার।
হৃদয়-কমলোপরি, চরণ কমল ধরি
চিন্ময়ী মূরতি অখিল-আঁধার !
এই গানটিতে ঈশ্বর প্রেমের কবি ভারতমাতাকে দেবী তুল্য প্রণতি জানিয়েছেন। এই ভারতেই কালিদাসের মতো মহাকবি, বাল্মীকি মুণির মতো অক্ষয় কীর্তির জন্ম হয়। জ্যোতিষ, গণিত বা বাক্য সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে এ ভারত অনন্য। এ ভারত যেমন এর বাহ্যিক রূপের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তেমনি এর জ্ঞান-গরিমা ও অতীত ঐশ্বর্যে নিখিল বিশ্বকে কানায় কানায় পূর্ণ করেছে। কবি তাই এই ভারতমাতাকে ভগবতি ভারতী সমাসনে প্রণতি জানিয়েছেন।
‘নমো নমো নমো জননী বঙ্গ! উত্তরে ঐ অভ্রভেদী / অতুল বিপুল, গিরি, অলঙ্ঘ্য। দক্ষিণে সুবিশাল জলধি । অপরূপ রূপের আঁধার এ বঙ্গ জননী। উত্তরের অতুল-বিপুল গভীর গিরিশৃঙ্গ আর দক্ষিণে সুবিশাল জলধি এ বঙ্গ জননীকে এর বৈভবে পরিপূর্ণ করেছে।
বনে বনে প্রজাপতির মেলা, অমৃত ধারার কোটি নদ-নদী আর সবুজের আবরণে ফুল-ফল শস্যভারে শোভিত এ বঙ্গমাতার ভাণ্ডার। তাই কবি এ বঙ্গ জননীকে বারংবার প্রণতি জানিয়েছেন। মাথা নত করেছেন এর অমৃত সুধা ধারার স্নিগ্ধ আঁচলের মায়া- ছায়া তলে।
আরও দেখুন :