রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁদের সংগীতভাণ্ডারকে ও সুরের বহুতাকে যেমন অভিনব করে তুলেছিলেন, তেমনভাবে অতুলপ্রসাদের গানে ঠুমরির সূক্ষ্ম কারুকাজ আর নজরুল সম্পূর্ণটাই বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী। সেদিক থেকে সমকালীন এই সকল গীতিকবিদের মধ্যে কান্তকবি ছিলেন একান্ত ঘরোয়া ও তুলনামূলকভাবে বৈচিত্র্যহীন। বহির্জগতের বৈচিত্র্যতা রজনীকান্তকে কখনোই আকৃষ্ট করেনি।

এমনি নিরাভরণ বৈশিষ্ট্য রজনীকান্তের স্বদেশপর্বের গানের সুর রচনাতেও পরিলক্ষিত হয়। বাল্যকালে যেহেতু সংগীতশিক্ষার তেমন সুযোগ রজনীকান্ত সেন পাননি তাই সুর নিয়ে বহু গবেষণা তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গ্রহণ-বর্জনের অবকাশটি তাঁর গানে বিরল। আত্মপ্রচার বিমুখ রাজশাহীর গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা শান্ত স্বভাবের কান্তকবির সকল গানে তাঁর চরিত্রের ছাপটি স্পষ্ট।

তাঁর অন্তরের সুর বোধেই তাঁর সংগীতের জগৎ পরিবেষ্টিত। বাল্যকালে বাবা গুরু প্রবাদ সেনের দেওয়া সংগীতের সহপাঠ। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ও কাঙাল হরিনাথের প্রভাব তাঁর গানের সুর রচনায় যতটুকু বিস্তার ফেলে। অবশ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে পরিচয় হলে তাঁর সংগীত দ্বারাও খানিক প্রভাবিত হয়েছিলেন রজনীকান্ত সেন।

অত্যন্ত মেধাবী এবং মজলিসী মানুষ ছিলেন রজনীকান্ত সেন। রাজশাহীর ‘উৎসবরাজ’ বলেও খ্যাত ছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য, অনায়াসে গান বাঁধতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তাঁর। রাজশাহী লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত কোনো এক সভায় যাবার মাত্র এক ঘণ্টা আগে রজনীকান্ত অসাধারণ সেই দেশপ্রেমের আবেগদীপ্ত, তব চরণ নিম্নে উৎসবময়ী’ গানটি রচনা করেন। তাছাড়া বিশেষ কোনো ঘটনার গুণে অনুকরণ করেও তিনি তৎক্ষণাৎ গান রচনা করতে পারতেন।

রজনীকান্ত সেনের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণে যেমন সরলতা পরিলক্ষিত হয়, তেমনি তাঁর গানের সুর সৃষ্টির ভাণ্ডারেও পাই সারল্য ও সহজ সাদামাটা অবয়ব। তাঁর সুর সাধনায় কখনোই বিলেতি সুরের প্রভাব বা একাধিক রাগমিশ্রণের উদাহরণ পাওয়া যায় না। প্রচলিত রাগের বিশুদ্ধ রূপটিই তিনি গ্রহণ করেছেন। তাই ভাঙা-গড়ার খেলা তাঁর গানের সুরের একান্তই বিরল।

সুর রচনাতে তিনি সাধারণত ভৈরবী, হাম্বীর, ইমন, বেহাগ, খাম্বাজ, কেদারা, কাফি, মিশ্র কানাড়া, মিশ্র বেহাগ, ঝিঁঝিট, মিশ্র ভূপালি প্রভৃতি রাগের আশ্রয় নিতেন। যদিও সুর রচনাতে তিনি বেহাগ, ভৈরবী, ইমন, ঝিঁঝিট, খাম্বাজ রাগ- রাগিণীকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। রাগমিশ্রণ তাঁর গানে খুব কম দেখা যায়, যেমন মিশ্র ঝিঁঝিট মিশ্র ভূপালি, মিশ্র কাফি, সিন্ধু খাম্বাজ, মিশ্র ইমন প্রভৃতি রাগ গ্রহণের কতিপয় উদাহরণ পাওয়া যায়।

এখানে কেদারা রাগে একটি উদ্দীপনামূলক গানের সুরের অবকাঠামোটি তুলে ধরা হলো,

জাগাও পথিকে, ও যে ঘুমে অচেতন।

বেলা যায়, বহু দূরে পাছ-নিকেতন।

থাকিতে দিনের আলো,

মিলে সে বসতি, ভালো,

নতুবা করিবে কোথা যামিনী যাপন?”

 

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

রাগ কেদারে আরোহে ঋষভ গান্ধার বর্জিত হওয়ায় ষড়জের পর সরাসরি মধ্যমের প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাছাড়া আরোহে ‘ না ধা পা’, অবরোহে ধা মা বা ধা পা সা’, ‘মা রা সা’ প্রভৃতি স্বরসংগতি প্রয়োগে রাগরূপ স্পষ্ট হয়। উক্ত গানে সা মা ও ধা পা মা এর সুনিপুণ প্রয়োগ হতে দেখা যায়। এই গানটিতে রজনীকান্ত সেনের রচিত গানের আরও একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

তা হলো তাঁর অনেক গানে সঞ্চারীর অনুপস্থিতি। এই গানটি সঞ্চারীবর্জিত দুটি অন্তরাতেই একই রকম সুরে রচিত যা কেদারা রাগে ও চার চার ছন্দে আবদ্ধ। যেকোনো সচেতন সুরকার নিজের মুন্সিয়ানা প্রকাশে অন্তরা ও আভোগ অংশে প্রায় একই ধরনের সুর দিলেও সঞ্চারীর সুরটিকে আলাদা সুর প্রয়োগ করেন গানের ভাবকে ঘনিভূত করবার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু রজনীকান্ত সেন এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। সঞ্চারীর সুর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি সুর পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেননি, বরং সুরের সারল্যই তাঁর গানের সুরের ভাব প্রকাশে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এমনই তাঁর স্বদেশপর্যায়ের গানের সুর রচনাতেও সঞ্চারী অনুপস্থিতি লাভ করা যায়

“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;

দীনদুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।

ওই মোটা সুতোর সঙ্গে, মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই।

আমরা এমনি পাষাণ, ভাই ফেলে ঐ পরের দোরে ভিক্ষে চাই।”

 

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

রজনীকান্ত সেনের গানে বরাবর কথার প্রাধান্য বেশি, সুরের নয়। তাঁর সামগ্রিক রচনাভাণ্ডার থেকে দৃষ্ট যে সুরের বৈচিত্র্য সৃষ্টির দিকে তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন না। তাঁর স্বদেশপর্বের গানও তাই। রজনীকান্ত সৃষ্টি গানের সুর মূলত রাগভিত্তিক। রাগের আশ্রয়েই রচিত তাঁর স্বদেশপর্বের গানসমূহ।

রজনীকান্তের সামগ্রিক গানের সুর সৃষ্টিতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ প্রয়োজন যে বিভিন্ন রাগে কয়েকটি সুরের বারবার ব্যবহার। কল্যাণ ও ভূপালী রাগের স্বর (সা ধা সা রা গা) রজনীকান্ত সেনের গানে অধিক ব্যবহৃত সুর। এই স্বরগুলোর ব্যবহারের কারণ হয়তো এরমধ্যে একপ্রকার করুণতা রয়েছে। সেই কাতরতা পরিলক্ষিত হয় তাঁর স্বদেশপর্ব থেকে প্রায় সকল গানে।

রাগ-রাগিণীর বিশুদ্ধতার উপর যে খুব বেশি দৃষ্টিপাত করেছেন কবি তা নয়। মূলত স্বরগুলোর করুণ রস তাঁকে বেশি মোহিত করেছে। সুরের সরল নিরলঙ্কার চলনকে রজনীকান্ত সেন তাঁর গানের অবয়ব করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির ধারাকে তিনি আশ্রয় করেছেন এর নিরাবরণ অলংকরণে। তাঁর গানে বাউল, রামপ্রসাদী ও কীর্তনের সুরও রয়েছে, যা কেবল শুদ্ধ আবেগের রসবোধে পরিপূর্ণ।

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

মূলত সরলতা, করুণভাব এবং আত্মনিবেদনের স্বাতন্ত্র্যভঙ্গি রজনীকান্ত সেনের গানের সুর প্রয়োগের মূল বৈশিষ্ট্য। অত্যন্ত সহজ সরল কাঠামোতে রজনীকান্ত সেনের স্বদেশপর্বের গানের সুর বিন্যস্ত। তাঁর গানে যেমন তাল বা লয়ের বৈচিত্র্যতা নেই, তেমনি নেই রাগ-রাগিণী নিয়ে মিশ্রণরীতির প্রকাশ।

রাগ- রাগিণীর ব্যবহারেও সর্বত্র একটি করুণ সুরে অবিন্যস্ত রজনীকান্ত সেনের গান। তাঁর বহুল ব্যবহার্য ভৈরবী, ইমন, বেহাগ, খাম্বাজের সহজ সরল উপস্থাপন মূলত তাঁর গানের সুরের মূল বৈশিষ্ট্য। রজনীকান্ত সেনের গানের কোনো নির্দিষ্ট ভঙ্গি বা কাঠামো গড়ে উঠেনি, বা তিনি চাননি গড়তে। সুরের সরল প্রকাশ এবং বাহুল্যবর্জিত সহজ পথের অনুসন্ধানী ছিলেন তিনি। আত্মভাবে পূর্ণ শুদ্ধ সুরের সরল রূপ প্রকাশ কান্তকবির স্বদেশপর্বের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

আরও দেখুন :

Leave a Comment