আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রজনীকান্ত সেনের স্বদেশচেতনার গান
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশচেতনার গান
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশচেতনার গান
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশপর্যায়ের গানের তালিকা
১ . তাই ভালো, মোদের
মায়ের ঘরের শুধু ভাত,
মায়ের ঘরের ঘি-সৈন্ধব,
মার বাগানের কলার পাত।
ভিক্ষার চালে কাজ নাই, সে বড় অপমান মোটা হোক,
সে সোনা মোদের মায়ের ক্ষেতের ধান।
সে যে মায়ের ক্ষেতের ধান!
মিহি কাপড় পরম না আর যেচে পরের কাছে
মায়ের ঘরের মোটা কাপড় পরলে কেমন সাজে
দেখতো পারলে কেমন সাজে।
ও ভাই চাষী, ও ভাই তাঁতী আজকে সুপ্রভাত;
ক’সে লাঙ্গল ধর ভাই রে ক’সে চালাও তাঁত।
ক’সে চালাও ঘরের তাঁত!
২ . জয় জয় জনমভূমি, জননী!
যাঁর, স্তন্যসুধাময় শোণিত ধমনী
কীৰ্ত্তি-গীতিজিত, স্তম্ভিত, অবনত,
মুগ্ধ, লুব্ধ, এই সুবিপুল ধরণী।
উজ্জ্বল-কানন-হীরক-মুক্ত- মণিময়-হার বিভূষণ-যুক্তা;
শ্যামল-শস্য পুষ্প-ফল পূরিত,
সকল দেশ জয়-মুকুটমণি !
সৰ্ব্ব-শৈল-জিত, হিমগিরি-শৃঙ্গে,
মধুর-গীতি চির-মুখরিত ভূঙ্গে,
সাহস বিক্রম বীর্য্য-বিমণ্ডিত,
সঞ্চিত পরিণত জ্ঞান-খনি!
জননী-তুল্য তব কে মর-জগতে?
কোটি কণ্ঠে কহ, “জয় মা! বরদে!”
দীর্ণ বক্ষ হ’তে, তপ্ত রক্ত তুলি,
দেহ পদে তবে ধন্য গণি ।
৩ . ভারতকাব্যনিকুঞ্জে-
জাগ সুমঙ্গলময়ী মা! মুঞ্জরি তরু,
পিক গাহি’, করুক প্রচারিত মহিমা।
তুলে লহ নীরবে বীণা, গীত-হীনা:
অতি দীনা:- হে ভারত,
চির-দুখ-শয়ন- বিলীনা
নীতি-ধর্ম-ময় দীপক মন্ত্রে,
জীবিত কর সঞ্জীবনমন্ত্রে জাগিবে
রাতুল চরণ তলে,
যত লুপ্ত পুরাতন গরিমা।
৪ . তব, চরণ-নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা,
ঊর্ধ্বে চাহ অগণিত-মণি-রঞ্জিত-নভো
নীলাঞ্জলা সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা,
শান্ত-কুশল-দরশা। দূরে হের
চন্দ্র-কিরণ-উদ্ভাসিত গঙ্গা,
নৃত্য-পুলক-গীতি-মুখর-কলুষহর-তরঙ্গা;
ধায় মত্ত হরষে সাগরপদ-পরশে,
কুলে কুলে করি’ পরিবেশন মঙ্গলময় বরষা।
ফিরে দিশি দিশি মলয় মন্দ, কুসুম-গন্ধ বহিয়া,
হাসিছে দিগ্বালিকা, কণ্ঠে বিজয়মালিকা,
নবজীবন-পুষ্পবৃষ্টি করিছে পুণ্য হরষা।
ওই হের, স্নিগ্ধ সবিতা উদিছে
পূৰ্ব্ব-গগনে কন্তোজ্জ্বল কিরণ বিতরি’,
ডাকিছে সুপ্তি-মগনে। নিদ্রালস-নয়নে,
এখনও রবে কি শয়নে ? জাগাও, ,
বিশ্ব-পুলক-পরশে, বক্ষে তরুণ ভরসা।
জাগন্ত বিশ্ব পুলক পরশে ব্যস্ত তরুণ ওরসা
৫ . নিষ্প্রভ কেন চন্দ্ৰ তপন, স্তম্ভিত মৃদু গন্ধবহন,
ধীর তটিনী মন্দ গমন, স্তব্ধ সকল পাখী।
সজল করুণা যত নয়ান, শুষ্ক মলিন নত বয়ান,
লক্ষ শোক নিহিত বক্ষে দুঃখ উঠিছে জাগি ॥
ত্যক্ত সকল সুখ-বিলাস, উষ্ণ বিফল দুখ-নিশাস,
“হা বান্ধব” উঠিছ ভাষ, অন্তর তল থাকি’।
বৃদ্ধ যুবক অর্থী নিঃস্ব, হা হা রবে পূরিল
বিশ্ব শোক-মুগ্ধ নিখিল বঙ্গ সৌম্য হে তর লাগি’।
৬ . মা বলে ভাই ডাকলে মাকে ধরবে টিপে গলা
তবে কি ভাই বাংলা হতে উঠবে রে ‘মা’ বলা?
মানে কি আর ‘মা’ উমা উজল ডাক ছাড়াতে পারি?
হাজার মারো, ‘মা’ বলা ভাই কেমন করে ছাড়ি?
৭ . সেথা আমি কি গাহিব গান ? যেথা,
গভীর ওঙ্কারে, সাম ঝঙ্কারে, কাঁপিত দূর বিমান।
যেথা, সুরসপ্তকে বাঁধিয়া বীণা,
বাণী শুভ্রকমলাসীনা, উমা উজল রোধি তটিনী-জল-প্রবাহ,
তুলিত মোহন তান ।
যেথা, আলোড়ি’ চন্দ্রালোক শারদ,
করি’ হরিগুণগান নারদ মন্ত্রমুগ্ধ
করিত ভুবন, টলাইত ভগবান ।
যেথা, যোগীশ্বর-পুণ্যপরশে মূর্ত রাগ উদল
হরষে মুগ্ধ কমলাকক চরণে জাহ্নবী জনম পান।
যেথা, বৃন্দাবন-কেলিকুঞ্জে, মুরলী-রবে পুঞ্জে পুঞ্জে,
পুলকে শিহরি’ ফুটিত কুসুম, যমুনা যেত উজান।
আর কি ভারতে আছে সে যন্ত্র,
আর কি আছে সে মোহন মন্ত্র,
আর কি আছে সে মধুর কণ্ঠ, আর কি আছে সে প্রাণ?
রজনীকান্ত সেনের আরাধনার গানে স্বদেশচেতনা
৮ . তিমিরনাশিনী, মা আমার ।
হৃদয় কমলোপরি, চরণ কমল ধরি
চিন্ময়ী মূরতি অখিল-আঁধার!
নিন্দি তুষার কুমুদ শশি-শঙ্খ,
শুভ্র বিবেক-বরণ অকলঙ্ক,
মুক্ত-শূন্য-ময়, শ্বেত, রশ্মি-চয়,
দূর করে তমঃ-তর্ক-বিচার।
ওই করিল করুণাময়ী দৃষ্টি,
সম্ভব হইল জ্ঞানময়ী সৃষ্টি।
৯ . জাগ রে দাসদাসি! জাগ রে প্রতিবাসি !
দেখ রে কাছে আসি’ ফেটে যে গেল বুক।
আয় রে আয় কাছে উমা উজল আর কি রাতি আছে!
রাজমহিষী হয়ে দেখে যা কত সুখ!
যাহারে পাব বলে বছরে ঘুম নাই, যাহারে বুকে পেলে,
নিখিল ভুলে যাই, যে চ’লে যাবে ভয়ে মরণ আগে চাই!
বিধাতা নেবে তারে, চাবে না মার মুখ
সয়েছি কত বার নূতন উমা উজল এই নয় আমার এ সহা-দুখ,
তথাপি নাহি সয়; প্রতি শরতে যেন ক্ষত নূতন হয়,
মায়ের প্রাণ ল’য়ে বিধির এ কৌতুক।
জাগ রে শুক সারি হংসি শিখি, ধেনু।
মাথায় নে রে তোরা, মায়ের পদ-রেণু; বরষ প’ড়ে আছে,
কে মরে, কেবা বাঁচে, বিদায় নিয়ে রাখ চেপে মনের দুখ।
কান্ত বলে, উমা উজল রাকা-শশী,
হাসিছে হিমগিরি- ভবনাকাশে বসি চকিতে
দশমীতে নয়ন পালটিতে পূর্ণগ্রাস করে সে রাহু পঞ্চমুখ।
১০ . জাগো জাগো, ঘুমায়ো না আর!
সুপ্ত চক্ষে আমি জাগরণ
(কহে) “ত্যাজ আলস্য ভার। ”
নব রবি জাগে, নব অনুরাগে, ল’য়ে নব সমাচার।
সুরভি-স্নিগ্ধ গন্ধ-বহন হরফ অলস
মন্দ গমন মৌন বিহগ প্রভাত-সঙ্গে জাগি;
বিলাইছে সুর তরঙ্গে, নব মঙ্গল শুভ বারতা- আশিস দেবতার।
এস ছুটে এস কৰ্ম্মক্ষেত্রে, উমা উজল চেয়ো না মুগ্ধ অলস নেত্রে,
এত দিন পরে, শুষ্ক অধরে হেসেছেন মা আমার।
ফুল্ল-কুশল-কমলাসনা, শুভ্র-পুণ্য ক্ষৌম-বসনা,
এসেছেন ফিরে, এস নতশিরে চরণ যুগলে নমি তাঁর।
১১ . আমায়, সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে
গর্ব্ব করিতে চুর, যশঃ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য
সকলি করেছে দূর।
ওইগুলো সব মায়াময় রূপে ফেলেছিল মোরে অহমিকা ৰূপে,
তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর আমায়,
সকল রকমে কাঙ্গাল করিয়া গৰ্ব্ব করিছে চুর।
যায়নি এখনো দেহাত্মিক মতি, এখনো কি মায়া দেহটার প্রতি,
এই দেহটা যে আমি, সেই ধারণার হয়ে আছি ভরপুর;
তাই, সকল রকমে কাঙ্গাল করিয়া গর্ব করিছে চুর।
ভাবিতাম, “আমি লিখি বুঝি বেশ
আমার সঙ্গীত ভালোবাসে দেশ, ”
তাই বুঝিয়া দয়াল ব্যাধি দিল মোরে,
বেদনা, কত না যতনে শিক্ষা দিতেছে গর্ব্ব করিতে চুর।
১২ . মোহ-রজনী ভোর হইলে,
জাগ নগরবাসী পূর্ব্ব গগনে সূর্য কিরণ,
দুঃখ-তিমির-নাশী।
আর্য্যকীৰ্ত্তি-মধুর গান,
বিহগ ঢালিছে অমিয় প্রাণ,
যশ-পরিমল পূর্ণ-পবনে কুসুম উঠিছে হাসি’।
পাশরি সকল দুঃখ প্রাণে প্রাণে মিলনানন্দ,
জাগ জাগ, হের জগৎ উৎসব অভিলাষী।
কত মরকত কাঞ্চনমণি
জ্ঞান ধরম নীতির খনি
কুণ্ঠিত নহ লুণ্ঠিত হেরি অতুল বিভব-রাশি।
অলসে ঘুমায়ে রহিও না আর, উৎসবে ঢালো প্রাণ তোমার,
হাসিছে বিশ্ব হেরি, তোমারে ক্ষণিক সুখ বিলাসী।
১৩ . জেগে ওঠ দেখি মা সকল
হের নব প্রভাতের নব তপন উজল,
শুন জন কোলাহল ভরা আজি ধরাতল।
এত কলরবে যদি না ভাঙ্গিবে ঘুম,
(যদি) এ উষায় না ফুটিবে শকতি-কুসুম
তবে জননী গো বল, (আর) কোথা পাব বল?
সীতা, সতী চিন্তা, দময়ন্তী, লীলা, খনা,
সাবিত্রী, অহল্যাবাঈ, দ্রৌপদী, জনা
মা গো, কোন্ দেশে আছে বল, হেন মণি নিরমল?
কেশ কেটে দিসনি কি ধনুকের ছিলা ক’রে?
‘মেরা ঝান্সি নেহি দেগা’-মনে কি পড়ে? মা গো,
কোন্ দেশে আছে বহু সতী প্রবেশে অনল?
শক্তিরূপিণী তোরা আত্ম-বিস্মৃতা হায় এই নব ব্রত ধর,
বর মাগো দেব-পায়; ঐ শকতি সম্বল ল’য়ে হইব সফল।
১৪ . তোর বদলে গেল দেহের আকর, বদলে গেল মন,
তবু নয়ন মুদে অচেতন।
যাদের খুসী ক’রবি ব’লে করলি জীবনপণ,
তারাই বলে, ‘বুড়ো, আর ঘুমুবি কতক্ষণ ?
যার কথা তুই নিসৃনি কানে, সারাটা জীবন,
সেই নিলাজ বিবেক আবার বলে, “শিয়রে শমন”।
যে মাকে তুই হেলা ক’রে ব’লতিস্ কুবচন,
সেই ক্ষমার ছবি বলছে কানে, “জাগরে যাদুধন !”
তোর একই কাতে রাহ্ পোহালো ভাঙ্গলো না স্বপন,
তোর জীবন-রাত্রি পোহায়, এখন ঊষার আগমন।
তোর বাল্য গেল ধুলো খেলায়, বিলাসে যৌবন,
কেমন ধীরে ধীরে ধরলো জরা, এর পরে মরণ।
কান্ত বলে হায়রে আমার অরণ্য
রোদন ডেকে ডুকে মেরে ঘুরে দেখলাম বিলক্ষণ ।
আরও দেখুন :