আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রজনীকান্ত সেনের স্বদেশভাবনা
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশভাবনা
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশভাবনা
দেশ জুড়ে চলছে দেশাত্মবোধ জাগরণের প্রস্তুতি। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আশ্চর্য সংগীত প্রতিভার স্পর্শে সর্বত্র স্বদেশপ্রেমের জাগরণী বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গানের লোকসুর আর দ্বিজেন্দ্রলালের রাগ-রাগিণীর সাথে লোক বা বিদেশি সুরের কোরাস বা সম্মেলক গানের ধরন স্বদেশি গানের ভাবনায় এক অভিনবত্ব নিয়ে আসে। নবপ্রজন্মসহ সকলের কাছে এই গান হয়ে ওঠে স্বদেশি আবেগের অনবদ্য এক হাতিয়ার।
একই ধারায় রজনীকান্ত সেনের সংযোজন হয় বাংলা সংগীতের ইতিহাসে যাঁকে আমরা চিনি তাঁর ঈশ্বর প্রেমের আরাধনার গানে। কিন্তু তাঁর স্বদেশি গান রচনার মধ্যদিয়ে স্বভাবসুলভ সহজিয়া ভাবের প্রকাশ ঘটে। যে উত্তাল সময়ের কথা বলছি তখন সকল কবি-সাহিত্যিকের মানবপ্রেম ও ঈশ্বরপ্রেম মিলিত হয়েছিলেন স্বদেশপ্রেমে। সকলকে এক করছিল মূলত দেশপ্রেম।
কি খ্যাত কি অখ্যাত, কি হিন্দু কি মুসলমান প্রত্যকেই যার যার অবস্থান ভুলে স্বদেশকে মুক্ত করবার প্রয়াসে নিজেদের তৈরি করছিলেন। যেমন- একই মায়ের দুটি সন্তান হিন্দু আর মুসলমান/একটি কুলে জন্ম মোদের একই বুকে দুগ্ধপান। এসময়ে শত শত নাম না জানা কবির লেখনিতে অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদের কথা ব্যক্ত হয়েছিল, উদ্বেলিত করেছিল স্বদেশের মানসচিত্তকে।
রজনীকান্ত সেন তাঁদের মধ্যে এক অতি পরিচিত নাম। যাঁর মানবপ্রেম, দেশপ্রেম এবং হাসির গান আমাদের কাছে পরিচিত হলেও মূলত তিনি ছিলেন ভক্তি গীতিতে এক অনন্য এবং অদ্বিতীয়। কবি ও সংগীতজ্ঞ পিতা গুরুপ্রসাদ সেনের সান্নিধ্যে তাঁর সংগীতময় জীবন গড়ে উঠেছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বহু সংগীত গুণিদের সাহচর্যে। রজনীকান্ত সেনের দেশপ্রেমবোধ সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতের দ্বারা আবৃত।
সেই উত্তাল সময়ে বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ নাটক, উপন্যাস, কাব্য বা গান সর্বত্রই দেশপ্রেম বোধের উপস্থিতি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নন কবি রজনীকান্ত সেনও। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো ভারতবর্ষের অতীত গৌবর স্মৃতিচারণ রজনীকান্ত সেনের গানের মূল বিষয়বস্তু। স্বদেশকে মাতৃরূপে গণ্য করে পরাধীন দেশবাসীকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছেন তিনি আপন সুরের মহিমায়।
যেমন-‘পরপদতল লেহনপটু স্বজন বন্ধু যারা/দৈন্য দুঃখ আনিল গৃহে, এমনি লক্ষ্মী ছাড়া।” রজনীকান্তের স্বদেশপ্রেমের গান অত্যন্ত বেদনা মাখা অভিমান ও ত্যাজদৃপ্তময়তার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত। এই বোধ থেকেই মূলত তাঁর স্বজাত্যবোধের শুরু। বি.এ পাশের পর রজনীকান্তের মানবিক পরিবর্তন আসতে থাকে।
হার্মোনিয়াম, তাস ও ফুটবল নিয়ে যে সময়টা কাটিয়েছে তা থেকে বেরিয়ে অর্থকড়ি উপার্জনের চিন্তা ভর করে। সেই প্রয়াশেই ওকালতি বিষয়ে পড়বার বাসনা স্থির করেন। বি এল পড়বার সিদ্ধান্তের প্রাক্কালেই মূলত তাঁর মনে স্বদেশের জন্য তৃষ্ণা জাগতে থাকে এবং তিনি রচনা করলেন-
“জয় জয় জনমভূমি, জননী ।
যাঁর, স্তন্যসুধাময় শোণিত ধমনী;
কীৰ্ত্তি-গীতিজিত, স্তম্ভিত, অবনত,
মুগ্ধ, লুব্ধ, এই সুবিপুল ধরণী। ”
রজনীকান্তের স্বদেশ বন্দনার গান বা কাব্যাংশের মূল বৈশিষ্ট্য অতীতের গৌবরময় পটভূমিকে ফুটিয়ে তোলা। এদিক থেকে দ্বিজেন্দ্রলালের কাব্যগীতির চিত্রকল্প ও ভাষারীতিকে স্মরণ করায়। যদিও এই সকল গান বা বাক্যাংশ বর্তমানে বহুল প্রচলিত নয়। বরং তাঁর সহজ সুরের, সহজ কথার স্বদেশি গানই মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন গড়েছেন। দেশমাতৃকার রূপ বর্ণনাময় যুক্তাক্ষর বিশিষ্ট-ধ্বনি ব্যঞ্জনাময় শব্দভাণ্ডারের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো-
১. “ধূর্জটিবাঞ্ছিত হিমাদ্রি মণ্ডিত, সিন্ধু গোদাবরী মাল্যবিলম্বিত অলিকুলগুঞ্জিত সরসিজ রঞ্জিত” (বাণী, ‘ভারতভূমি’)
২. “পীযূষসিঞ্চিত, সমীর চঞ্চল, কাঞ্চন অঞ্চল দোলেরে সংশয় নিরসন, ধী স্মৃতিবিতরণ, চরণে জনমন ভোলেরে” (বাণী, “বাণী”)
৩. “কীর্তি-গীত জিতম্ভিত-আনত মুগ্ধ এই ধরণী উজ্জ্বল কানন হীরক মুক্তা, মণিময় হার বিভূষণ যুক্তা শ্যামল শস্য পুষ্প ফল পূরিত, সকল দেশ হয় মুকুটমণি” (বাণী, ‘জন্মভূমি’)
৪. “দক্ষিণে সুবিশাল জলধি, চুম্বে চরণতল নিরবধি মধ্যে পুত জাহ্নবী জল ধৌত শ্যামল ক্ষেত্র সংঘ” (বাণী, ‘বঙ্গমাতা’)
৫. “হে ভারত চিরদুখ শয়ন বিলীনা নীতি-ধর্মময় দীপক মন্ত্রে, জীবিত কর সঞ্জীবনী মন্ত্রে জাগিবে রাতুল চরণতলে, যত লুপ্ত পুরাতন গরিমা।” (বাণী, ‘উদ্বোধন”)
৬. “ওই নীলসিন্ধু জল, চিরগর্বিত চঞ্চল তীব্র আবেগে কহিছে গ্রহত, বধির দুয়ার তোর বলে ‘জাগ জাগ নতুবা ডুবে যা, অতলগর্ভে মোর” (শেষদান, ‘উত্তিষ্ঠিত’)
৭. “লক্ষ-পুরাতন সন্ধিসমর ইতিহাস বিমিশ্রিত এ বিপুল নীর দীনে দান কত করিনু অকাতরে, সম্পদ লয়ে গর্বিত নৃপতির।” (বাণী, ‘সিন্ধু সংগীত’)
কান্ত কবির স্বভাবের ছায়ামূলক সহজ কথা ও সুরের গানগুলোই মানুষের অন্তলোকে ধাবিত, ঠিক যেমনটি দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশ পর্যায়ের গানে। দেশপ্রেম বোধটি ছিলো সেই যুগের কবি-সাহিত্যিক বা গীতিকবিদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই ধারায় রজনীকান্ত সেনও প্রবাহিত ছিলেন। স্বদেশের জন্য তাঁর অন্তরে এক সুগভীর কোমল অনুভূতি সদাজাগ্রত ছিলো এবং চটজলদি গান রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন তিনি।
রাজশাহীর লাইব্রেরির সভা অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে গান লিখতে বললে মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অসাধারণ স্বদেশ বন্দনার গান লিখে দেন তিনি। জলধর সেনের লেখায় এর বিশদ বর্ণনা পাই-
“অক্ষয় বলিল, ‘রজনী ভায়া, খালি হাতে সভায় যাইবে। একটা গান বাঁধিয়া লও না।’ রজনী যে গান বাঁধিতে পারিত, আমি জানিতাম না। আমি জানিতাম যে সে গান গাহিতেই পারে। আমি বলিলাম, ‘এক ঘণ্টা পরে সভা হইবে, এখন কি আর গান বাঁধিবার সময় আছে।’ অক্ষয় বলিল, রজনী একটু বসিলেই গান বাঁধিতে পারে। রজনী অক্ষয়কে বড় ভক্তি করিত।
সে তখন একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া অল্পক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া থাকিল। তাহার পরেই একখানি গান লিখিয়া ফেলিল। আমি তো অবাক। গানটি চাহিয়া লইয়া পড়িয়া দেখি অতি সুন্দর রচনা। গানটি এখন সর্বজন পরিচিত ‘তব চরণনিয়ে উৎসবময়ী শ্যামধরণী সরসা। সেই সময়ে প্রত্যেক লেখনির অন্তরালে ছিলো স্বজাতিকে মুক্তির প্রতীক্ষা। এক একজন কবির আপন বৈশিষ্ট্যে উচ্চারিত হলেও মূল উদ্দেশ্য স্বদেশমাতাকে শৃঙ্খল মুক্ত করা।
পরাধীনতার শৃঙ্খলে ওষ্ঠাগত প্রাণের পিপাসা নিবারণে রচিত সকল স্বদেশপ্রেমের গানে রয়েছে স্বদেশের সৌন্দর্য বন্দনা, ঐতিহাসিক বিবরণসহ গভীর আবেগের প্রকাশ। এদিক থেকে রজনীকান্তের গানে পাই কোমল মায়াভরা সুরের পুনরাবৃত্তি। সঞ্চারি বর্জিত স্থায়ী ও কতিপয় অন্তরার সহজ অবয়বে কবি ব্যক্ত করেছেন স্বদেশের প্রতি প্রেম-অনুরাগ, স্বজাতির প্রতি তাঁর দায়িত্ব।
নারী জাগরণমূলক বিভিন্ন সভা সেমিনারেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন, রচনা করেছেন নারী জাগরণী গান। এ কেবল একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকই পারে। তিনি জেনেছিলেন পরাধীনতার অন্ধ কারাগার থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মায়ের সকল সন্তানের আত্মিক জাগরণ।
তিনি রচনা করেছেন হাসির গান। দ্বিজেন্দ্রলালের লেখনীর অনুপ্রেরণায় চিরসত্য বাণীকে মানুষের অন্তরে সহজে ধাবিত করবার পন্থাও পেয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং রজনীকান্ত প্রত্যেকেই সাহিত্যের আসরে পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশবাসীর মুক্তির প্রয়াসে ব্যক্ত করেছেন স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যের উচ্চারিত বাণী। সকলেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো এক ও অভিন্ন।
রজনীকান্ত সেনের স্বদেশচেতনার গানে উত্তেজনা ও উন্মাদনার থেকে প্রকাশ পায় অন্তরের মিনতি ও স্বদেশের প্রতি কাতরতা যা সর্বজনীন এবং মর্মস্পর্শী।
“রজনীকান্তের স্বদেশবিষয়ক গানে এমনই ব্যক্তিগত সুরের চেয়ে ফুটে উঠেছে সর্বজনীন স্বদেশানুভূতির সুর। তিনি আমাদের জীবনতন্ত্রীর ঠিক তন্ত্রীটিতে ঘা দিয়ে সঠিক সুরটিকে বাজিয়ে তুলেছিলেন। স্বদেশ কাব্যের কথা নয়, ইতিহাসের রোমান্স নয়, সম্ভ্রমের বস্তু নয়, স্বদেশ আমাদের দীন জননীরূপে একান্ত আপনার হয়ে দেখা দিলেন। এইজন্যই রজনীকান্তের স্বাদেশিক সুরটি এত মর্মস্পর্শী।”
আরও দেখুন :