আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথের নৃত্যচর্চা
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যচর্চা
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যচর্চা
১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কবি সঙ্গীত, অভিনয় এবং চিত্রকলাকে শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৃত্য শিক্ষা ও চর্চার সুযোগ প্রথমাবস্থায় সৃষ্টি করতে না পারলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য যে সব নাটক বা ঋতুনাট্য রচনা করেছেন তাতে নিজেও নেচেছেন ছাত্রদেরও উৎসাহ দিয়েছেন নাচতে।
বিশিষ্টজনদের স্মৃতিকথায় আমরা এ সন্বন্ধে জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট অনুরাগী ভক্ত ডঃ কালিদাস নাগের স্মৃতিকথার জানতে পারি-
১৯১১ সালে কবির ৫০ বর্ষ পূর্তির উৎসবে তাঁর ‘রাজা অভিনয় যখন আমি দেখি তখন তিনি শুধু সঙ্গীতের মাধুর্যে এবং অভিনয় নপুণ্যেই আমাদের মুগ্ধ করেননি। প্রত্যেকটি গীতাভিনয়ের সঙ্গে নৃত্যব্যঞ্জনা যে জাগিয়েছিলেন সে কথা আজ স্পষ্ট মনে পড়ে; ঘুর লেগেছে তাধিন তাধিন গানটি নাচের জন্যই রচিত; ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা কোরাস গাইবার সময় কবি এবং ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ গানে দীরেন্দ্রনথ গীতের মধ্যে নৃত্যের আভাস দিয়েছিলেন।
তারপর অচলায়তন (১৯১২) অভিনয়ে অপাংক্তেয় শোণপাংশুরা, ভরতমুনির উপযুক্ত পুত্রদের মতোই পায়ে পায়ে নৃত্যভাষ্য রচনা শুরু করে কবির শিক্ষারই ফলে। পরলোকগত বন্ধু উইলি পিয়ারসন ১৯১৩-১৪ সালে পাশ্চাত্য ছাঁদের নৃত্য অচলায়তনের মধ্যে অবাধে চালিয়ে দেন কবির “অভয় লাভ করে’, সেটাও দেখেছি। ১৯১৬ সালে পিয়ারসন ফাল্গুনীর মধ্যেও নেচেছিলেন; এবং সেই সুপ্রসিদ্ধ অভিনয়েই কবি নিজে প্রকাশ্যে প্রথম নাচের কবিশেখরের অপূর্ব ভূমিকায়,
‘চলিগো চলিয়া,
“আমায় ক্ষেপিয়ে বেড়ায়’
প্রভৃতি গানের অভিব্যক্তি তিনি নতুন মাধুর্য্যে সাক করেন। ১৯১১ সালে ছাত্র ও শিক্ষকেরা মিলে যখন রাজা অভিনয় করেন তখন কলকাতার অনেকেই এসেছিলেন। এদের মধ্যে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা দেবীর স্মৃতিকথায় জানতে পারি।ছেলেদের গানগুলি অতি সুন্দর হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যবর্তী ঠাকুরদা রূপী কবিবরের নৃত্য দেখিয়ে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলাম। তিনি অতি সুন্দর নৃত্য করিতে পারেন।
১৯১৫ সালে শান্তিনিকেতনে এবং পরের বছর কলকাতায় ফাল্গুনী নাটকের অভিনয় হয়। এর গানের সঙ্গে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ খুবই দক্ষতার সঙ্গে নেচেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ এবং নন্দলাল বসুর আঁকা দুটি ছবিতে সেই নচের পরিচয় অমর হয়ে আছে।
শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিচারণায় জানতে পারি ১৯১৯ সালের পূজার ছুটির আগে শারদোৎসব নাটকে প্রথম ছেলেরা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনায় সারিবেঁধে গানের ছন্দে মিলিত পদক্ষেপে মঞ্চপরিকল্পনা করে। তাদের হাতে ছিল শিউলী ও কাশফুলের ডালা।
“আমার নয়ন, ভুলানো এলে,
“বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
প্রভৃতি গানের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপে মঞ্চ প্রদক্ষিণের পরিচালক ছিলেন কবি স্বয়ং। নাটক এবং ঋতুনাট্যে আঙ্গিকাভিনয়ের রীতিতে কবির নিজের নৃত্য এবং নৃত্য পরিচালনার উৎস ছিল কবির প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা। ১৭ বছর বয়সে কবি প্রথম বিলেতে যান এবং ছিলেন প্রায় দেড় বছর। এই সময় বেশ কিছু বিলেতি সামাজিক নাচ শেখার সুযোগ তার
হয়েছিল।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম যুগে কোনো ধ্রুপদী নৃত্যপদ্ধতি চর্চা শুরু হবার পূর্বে কবি তার এই বিলেতী নৃত্যের অভিজ্ঞতাকেই আঙ্গিকাভিনয়ের রীতিতে, ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপে, লীলায়িত দেহভঙ্গিমায়, নৃত্যের আভাস রচনার কাজে লাগিয়েছিলেন। তার নিজের লেখনিতে জানতে পারি
‘গত মঙ্গলবার আমরা ওমুকের বাড়ীদের নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। নাচ আরম্ভ হল।… আমি নতুন লোকের সঙ্গে বড় মিলে মিশে নিতে পারিনে, প্রতিপদে ভুল হয়।… যাদের সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ আছে, তাদের সঙ্গে নাচতে আমার মন্দ লাগে না। মিস অমুকের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ ছিল, আর তাকে বেশ দেখতে, তার সঙ্গে আমি নেচেছিলুম, তাই জন্যে তাতে আমার ভুল হয়নি।
কিন্তু মিস অমুকের সঙ্গে আমি lancer নেচেছিলুম, তার সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। আর তাকে অতি বিশ্রী দেখতে। তার সঙ্গে নাচতে গিয়ে যতপ্রকার দোষ হওয়া সম্ভাব ঘটেছিল। নাচ ফুরিয়ে গেলে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।’
শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের জীবনে কবি এই বিলেতী নাচের আঙ্গিকেই নিজের মত নুতন নাচ তৈরী করে নিজে নাচতেন এবং আশ্রম বালকেরা কবির এই নাচ অনুকরণ করে নাচার- চেষ্টা করতো। এ কথা আমরা শান্তিদেব ঘোষের লেখায় জানতে পারি।
আরও দেখুন :