রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে ক্ষুদ্র ভূখন্ডের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বচেতনায় তাকে দেখেছেন। তিনি সবদিক থেকে দেশকে পরিপূর্ণ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, চিন্ময়।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

 

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিষয়টি বেশ জটিল। সেখানে রয়েছে নানা মাত্রিক ভাবনার মিশ্র চরিত্র, তাতে স্ববিরোধিতারও অভাব নেই। তাঁর স্বদেশভাবনা যেমন রাজনৈতিক চিন্তা, তেমনি সমাজভাবনা-নির্ভর। সেখানে যুক্ত হয়েছে ভারতবর্ষীয় ইতিহাসের উপলব্ধি – যে-উপলব্ধির মধ্যমণি প্রাচীন ভারত, সনাতন ভারত। যে-ভারতের চরিত্র সমাজপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান নয়। আবার সে-সমাজভাবনায় একপর্যায়ে এসে যুক্ত হয়েছে পল্লিপুনর্গঠন ও উন্নয়ন বিষয়ক আধুনিক চেতনা।

 

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

স্বাদেশিক রবীন্দ্রনাথের পরিচয় মেলে তাঁর গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও গীতিনাট্যে। জাতিধর্ম- গোত্র-সম্প্রদায় ভেদাভেদ ও প্রকৃত শিক্ষার অপ্রতুলতা মানুষের মানবিক সংকীর্ণতার মূল কাণ্ডারী। এইভাবনাটিই তিনি নানাভাবে তাঁর প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, ভাষণ ও গানে চিহ্নিত করেছেন । জাতীয়তাবোধের অন্তরীক্ষে দানা বাঁধা অপশক্তি দূর করতে চলেছে তাঁর অন্তহীন প্রয়াস।

মানুষে মানুষে মিলন, ঐক্য ও সংহতি রবীন্দ্রনাথের রচনায় রসদ জুগিয়েছে বারংবার। মানুষকেই তিনি সর্বাগ্রে গণ্য করেছেন, সমন্বরে আহ্বান করেছেন আনন্দ পথযাত্রায়। সেখানে স্থান পায়নি ধর্ম-শ্রেণির ভেদাভেদ। তাঁর কাছে স্বদেশের মাটি ও মানুষের মূল্য সবচেয়ে বেশি। তাদের কথা না ভেবে কেবল শহুরে স্লোগানমুখর আন্দোলনকে তিনি যথার্থ প্রতিরোধ মনে করতেন না কখনো।

স্বাদেশিকতার অর্থ আগে মাটিকে ভালোবাসা এবং সেই মাটির মানুষকে পরম আত্মীয়ের মতো আগলে রাখা। সেই মনোবাঞ্ছাকেই তিনি যথার্থ রূপ দিলেন জমিদারির কাজে যখন গ্রাম বাংলার মানুষের সান্নিধ্য প্রাপ্তির সুযোগ হলো। সর্বহারা কৃষকদের কষ্টে তিনি ব্যথিত হন, জমিদারি দায়িত্বে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ কৃষিনির্ভর শ্রমিকদের অপমান ও কষ্টাতুর জীবন থেকে পরিত্রাণ ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বিনির্মাণের জন্য তাঁর জমিদারি এলাকায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

অভিজাত পরিবারে জন্মেও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট মোচন, সার্বিক শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পথঘাট সংস্কার, শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, কৃষকসহ গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন এমনকি গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থাও তিনি স্থাপন করলেন পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে। এ সবই তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ তথা স্বদেশচেতনার বহিঃপ্রকাশ।

দরিদ্র ও নিচু বর্ণের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তিই তাঁর মূল স্বাদেশিক স্বপ্ন ছিলো। গতানুগতিক স্বাদেশিক আলোচনা থেকে রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার ভাবনা আগাগোড়াই ভিন্নতর। প্রতিবাদের থেকে তাঁর কবিতা ও গানে প্রাধান্য পেয়েছে ঐক্য ও সংহতির কথা। পুরোনো ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে বেরিয়ে আসার, আত্মমুক্তির সংকল্পের কথা।

ইংরেজ বিতাড়ন আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ রক্ষায় তাঁর আত্ম-উপলব্ধির সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ইংরেজের আবির্ভাব ব্যাপারটি মূলত বহুরূপী একটি বিষয়। আজ তা ইংরেজের মূর্তিতে আবির্ভূত, কাল সে অন্য কোনো বিদেশির মূর্তিতে আসবে এবং পরে নিশ্চয়ই নিজের দেশি লোকের মূর্তিতে আরো কঠিনরূপে দেখা দিবে। এই বাণীর সত্যতা প্রতিটি বাঙালির কাছে আজ স্পষ্ট।

ইংরেজেদের থেকে মুক্তির পর, শুরু হলো পাকিস্তানের শাসনামল, সে যুদ্ধেও স্বাধীন হয়েছে দেশ, জাতি হিসেবে পেয়েছে নিজ অস্তিত্বের নাম “বাংলাদেশ’। যদিও আজও শঙ্কা ঘরে, ঘরের বাইরে। যুদ্ধ ধর্মের সাথে ধর্মের। দৃশ্যত প্রকাশ্য শত্রুর থেকেও ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু। যে সাবধান বাণী রবীন্দ্রনাথ করে গিয়েছিলেন, আজ যেন সেই সত্যের বাস্তবরূপ দৃশ্যমান।

 

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

 

জাতি হিসেবে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারিনি, আত্মমুক্তি তথা আত্মশক্তির দীক্ষা নিতে পারিনি বলেই বারবার পরাধীনতা এ জাতিকে গ্রাস করে। অপমানিত হয় আমাদের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা। স্বজাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিই পারে যেকোনো প্রতিকূলতায় স্বদেশ রক্ষার জন্য সকল প্রজন্মকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে স্বদেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করতে ও স্বাধীনতাকে নিজ সত্তায় ধারণের মানসিকতা সৃষ্টি করতে।

তাই স্বাধীনতার চেতনা প্রতিনিয়ত চর্চার অভ্যাস করতে হবে নানাবিধ জাতীয় আয়োজনে, শিক্ষা ও পারিবারিক বলয়ে। প্রাণে ধারণ করতে হবে রবীন্দ্রনাথের উদ্দীপনার বাণী-

“চলো যাই, চলো, যাই চলো যাই-

চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে-

চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রবিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয় গ্রন্থ থেকে সনজীদা খাতুনের উক্তি উদ্ধৃত প্রাসঙ্গিক বোধ করি— পহেলা বৈশাখে ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও গেয়ে আমরা মনের উপরের ধূলির আস্তরণ ধুয়ে নেবার প্রার্থনা জানাতাম। এ প্রার্থনা অনন্ত হোক। ‘আনন্দ ধ্বনি জাগাও গগনে গেয়ে আমরা বলতাম চলো যাই কাজে, মানব সমাজে চলো বাহিরিয়া জগতের মাঝে।

এ প্রার্থনা চিরন্তর হোক। নিজের সঙ্গে, পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিরলস যুকে আমরা যেন দেশবাসী সকলকে সঙ্গে নিয়ে মানুষ হয়ে উঠতে পারি। সংস্কৃতিকর্মীদের নিরন্তর যাত্রা বাঙালিকে নিয়ে চলুক মানুষ মানবতার তীর্থে। জাতীয়তাবোধে ব্যতিক্রমী স্বতন্ত্র সংকল্পই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনাকে অন্য সকল স্বদেশি আন্দোলন থেকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে।

যে কারণে ১৯২০ সালে গান্ধীজী প্রবর্তিত স্বদেশি আন্দোলনের সময় ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন তিনি। বাহ্যিক আন্দোলন থেকে আত্মশক্তি সংগঠনের প্রতিজ্ঞাকে রবীন্দ্রনাথ বেশি জোরালো মনে করেছেন। গান্ধীজীর সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি এবং পৃথিবীতে মানবিকতা প্রতিষ্ঠাই রবীন্দ্র-স্বাদেশিকতার মূলমন্ত্র।

সে লক্ষ্যেই তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনায় ইউরোপীয় যুদ্ধ-বিরোধী মনীষীদের সাথে একাত্ম হয়ে সোভিয়েত পরিদর্শনে গিয়ে স্বদেশের মানুষের উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু দেশীয় মনীষীরা ইংরেজ বিতাড়নকেই প্রধান লক্ষ্য মনে করতেন, ইংরেজ হঠলে মানুষের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে এই বিশ্বাসে। তাদের ভাবনা সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ দূর না হলে পৃথিবীতে শান্তি আসবে না, এমন কি ভারতও মুক্ত হবে না।

 

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

 

রবীন্দ্রনাথ এ ভাবনার বিরুদ্ধে সকলকে একমত করতে পারলেন না, বরং নিজেকে সরিয়ে নিলেন। তবে প্রত্যক্ষ স্বাদেশিক আন্দোলনে মতবিরোধ থাকলেও তাঁর রচনায় নানা ইঙ্গিতে শ্রী অরবিন্দ, গান্ধীজী বা সুভাষ চন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং তাঁদের মতোই ইংরেজ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তাঁর রচনার সর্বক্ষেত্রে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment