আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্র কবিতায় স্বদেশ
রবীন্দ্র কবিতায় স্বদেশ
রবীন্দ্র কবিতায় স্বদেশ
শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষা ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায়, তেমনি আবার ঐক্যের জন্য আহ্বানও করেছেন। তবে ইংরেজ উপনিবেশবাদী জাতিকে যতই আহ্বান করা হোক না কেন তারা কখনোই ভারতকে তাদের স্বদেশ ভাবতে পারেনি। ভারত তীর্থ’ কবিতায় সেই আহ্বানের সাড়া পাই। তেমনি ১৮৯৪ সালের এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় উদ্দীপনার সুর পাই, পাই স্বদেশচেতনার উদ্বেগ।
তাঁর বহুবিধ কবিতার বিষয়বস্তু ভিন্ন হলেও অন্তরের বাণী মূলত একভাবেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে অর্থাৎ শাসকবিরোধী ও অন্যায় বিরুদ্ধ বক্তব্য, যেমন তাঁর নৈবেদ্য’ কবিতায় ভক্তিবান ও তপোবন সংস্কৃতির পাশাপাশি এমন প্রতিবাদী ইঙ্গিত পাই। তাছাড়া বঙ্গভঙ্গ বিরোধ আন্দোলনকালে রচনা করে ‘স্বদেশবন্দনা’সহ বহু প্রতিবাদী কবিতা। তাঁর ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় রয়েছে স্বদেশের জন্য আত্মদানের আহ্বান। যেমন-
“নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।”
মানবতাবাদ ও জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনার সাথে মিশ্রিত ছিলো, তারই উদাহরণ পাই পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের ‘বক্সাদুর্গন্থ রাজবন্দীদের প্রতি’ কবিতাটিতে-
“নিশীথের লজ্জা দিল অন্ধকারে রবির বন্দন।
পিঞ্জরে বিহঙ্গ বাঁধা, সংগীত না মানিল বন্ধন।
এখানে উল্লেখ যে, ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলের বিপ্লবী পত্রিকা ‘ধূমকেতু’-র জন্য কবিতা পাঠান। তাঁর সেই আশিবাণী কাব্যগ্রন্থে রয়েছে স্বাদেশিকতা সচেতনতার বাণী-
“জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।

তাঁর কণিকা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘স্বদেশী’ কবিতায় পাই একই রূপকতার ইঙ্গিত-
“কেঁচো কয়, নীচ মাটি, কালো তার রূপ।
কবি তারে রাগ ক’রে বলে, চুপ চুপ !
তুমি যে মাটির কীট, খাও তারি রস,
মাটির নিন্দায় বাড়ে তোমারি কি যশ!
১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারাপ্রহরীরা গুলি করে বন্দী শিবিরের কয়েকজন বিপ্লবীকে হত্যা করেছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকটাই অসুস্থ ও বয়সের ভারে জীর্ণ, তবুও তিনি থেমে থাকেননি। তিনি লিখেছিলেন প্রতিবাদী কবিতা ‘প্রশ্ন’-
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে,
আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।…
রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানে, গল্প-উপন্যাসে, নাটক-প্রবন্ধের বহু ক্ষেত্রে প্রতিবাদী ভূমিকা দেখা যায়। কারণ এটি মূলত তাঁর শৈশবের হিন্দুমেলা ও সঞ্জীবনী সভার প্রভাব। স্বদেশভক্তি তথা স্বাদেশিকতার বীজ, স্বদেশভাবনা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথের সন্ধান মেলে তাঁর বাল্যকাল থেকে। কেবল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদের বাহন বদলেছে, বদলছে এর ধরন।
‘মানবী’ (১২৯২) ও ‘দুরন্ত আশা’ (১৮৮৮) কবিতার আলস্য বিলাসী বাঙালি সমাজের প্রতি তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবি গীতাঞ্জলির (১৩১৭) ১০৮ সংখ্যক কবিতায় ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ-এ ভারতের অভিজাতশ্রেণির প্রতি সমালোচনা করেন। ‘প্রশ্ন’ কবিতাসম্পর্কে পুনরায় ব্যক্ত করছি প্রতিকার শব্দের অপবাদে যেখানে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে ( পরিশেষ কাব্য, ১৩৩৯)।
বলাকা কাব্যের (১৩২৩) ‘শঙ্খ (১৩২১) কবিতায় বিশ্বসভ্যতার শত্রু অসভ্য নির্লজ্জের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান কবি। তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্য’ (১৩৪৫) কবিতায় স্বদেশের একই ভাবনা প্রতিধ্বনিত হয়। স্বদেশের বহুবিধ দুঃখ লাঞ্ছনা অপমানের গ্লানি রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করত। অভ্যন্তরীণ এ সকল দৈন্যতা থেকে মুক্ত হতে প্রতিবাদের আহ্বান করেন কবি। প্রতিবাদই প্রতিকার এ মর্মবাণী বারবার তাঁর রচনার নানা ধাপে ব্যক্ত করেছেন।
আরও দেখুন :