রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

 

রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

 

রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু প্রবন্ধে ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত বক্তব্য রেখেছেন। মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে এ সকল প্রবন্ধের ভূমিকা অতুলনীয়। বহুবিধ রূপক ও সংকেতের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিবাদের চিহ্ন রেখে গেছেন।

এ ক্ষেত্রে তাঁর “পূর্ব-পশ্চিম” প্রবন্ধ সম্পর্কে আহমদ রফিকের উক্তি উল্লেখযোগ্য- পূর্ব ও পশ্চিম (১৯০৮ খ্রি.) প্রবন্ধটি যেন তাঁর ভারতবর্ষ বিষয়ক ইতিহাস ভাবনার প্রতিফলন। এখানে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে প্রত্যাশী। কিন্তু পশ্চিম বলতে এখানে তিনি ইংরেজকেই বুঝিয়েছেন।

এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঐক্যের কথা বলেছেন। তিনি তাঁর ‘মহাভারত’ বিষয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান এমনকি ইংরেজকেও বাদ রাখতে রাজি নন। কারণ তিনি ইউরোপের উন্নয়নের ধারাকে অগ্রাহা না করে বরং তা থেকে ভারতবর্ষকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। মুক্ত করতে চেয়েছিলেন অভ্যন্তরীন জরাজীর্ণতা থেকে।

যদিও ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কলম কখনো থেমে থাকেনি বরং ভারতে অবস্থানকারী ‘ছোট ইংরেজ’দের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তেমনি ইংরেজরা যখন বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা হরণের পূর্বশর্ত বাকস্বাধীনতা হরণ এবং সেই উদ্দেশ্যে ভারতবাসীর বাকস্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করতে মিডিশন বিল’ প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কণ্ঠরোধ’ প্রবন্ধটি লেখেন এবং কলকাতা টাউন হলে তা পাঠ করেন।

তেমনি ১৩২২ সালে ‘বহুরাজকতা’ প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। সেখানেও রয়েছে বিদেশি শোষণের নিপীড়নের কথা। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ ভাবনার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ (১৯০৪) প্রবন্ধে এবং এরই সম্পূরক রচনা ১৯০৫ সালে প্রকাশ করেন ‘অবস্থা ও ব্যবস্থায়’ নামে। রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটির পাঠ শুনতে ভীষণ ভীড় হয়েছিল।

জানা যায় যে প্রায় সহস্র ব্যক্তি এর প্রথম সভায় সভাগৃহে স্থান না পেয়ে ফিরে যায় এবং পরে এ কারণে রবীন্দ্রনাথকে অসুস্থ শরীরে জ্বর নিয়ে ২য় সভায় এই প্রবন্ধ পুনরায় পাঠ করতে হয় এবং ২য় সভার জন্য ৪ ঘণ্টায় ১২০০ টিকিট বিতরণ করা হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়। স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধ সম্বন্ধে সভাপতি রমেশ দত্তের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :

“সভাপতি শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় বলিলেন, রবীন্দ্রবাবুর প্রবন্ধের ন্যায় উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ তিনি কখনও শুনিয়াছেন বলিয়া তাঁহার স্মরণ নাই। একটি কথা এই যে, কেবল রাজনীতি বা কেবল সামাজিক বিষয় লইয়া কোন জাতি উন্নত হয় না। উন্নতি সমস্ত দিক হইতেই হইয়া থাকে।

কোন গাছ বৃদ্ধি পাইবার পূর্বে যদি নিয়ম বাধিয়া দেওয়া হয় উহা একদিন শুধু লম্বা হইতে থাকিবে কিংবা একদিন শুধু চওড়া হইতে থাকিবে, তাহা যেরূপ অস্বাভাবিক একসঙ্গে লম্বা ও চওড়া হইয়া বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ম সেইরূপ। জাতীয় উন্নতি চতুর্দিক হইতে হইয়া থাকে, শুধু সমাজনীতি বা রাজনীতি লইয়া থাকা এক দেশদর্শিতা। ভাগীরথী যেমন রাজমহল হইতে শতধারায় সমুদ্রাভিমুখী।

গতি লইয়াছে, আমাদের চেষ্টাও সেই রূপ শতমুখী হইয়া উন্নতির পথে প্রবাহিত হইবে। ঐক্য অবলম্বন করিয়া যে কোন বিষয়ে কাজ করা যায় তাহাতেই স্বার্থকতা হইবে। এই সুফল আমাদের রাজার হাতে ততটা নহে যতটা আমাদের হাতে। ১৯
রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধে সমাজভাবনার মধ্যদিয়ে মূলত রাজনৈতিক চিন্তাটিই প্রবাহিত।

শুধু তাই নয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন রচনায় যেমন- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে চিন্তার ঐক্য, ভাষার ঐক্য, ভাবের ঐক্য এবং সাহিত্যের ঐক্য সাধনের মধ্যদিয়ে বাঙালির জাতীয় ঐক্য সাধনের কথা বলেছেন, সাথে চালিয়ে গেছেন তাঁর সরকার বিরোধী ভাষণ-বক্তৃতা। বক্তব্যের মূল বিষয় মূলত স্বনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এ প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাধি ও প্রতিকার প্রবন্ধটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

১৯৩৭ সালে তাঁর প্রচলিত দণ্ড বিধি প্রবন্ধে তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের দণ্ড প্রয়োগের রূপকে বর্বরতা এবং শাসকশ্রেণিকে বর্বর বলে চিহ্নিত করেন। তখন তিনি লিখলেন :

“দামামা ঐ বাজে,

দিন বদলের পালা এল

ঝোড়ো যুগের মাঝেঝ।

শুরু হবে নির্মম এক নূতন অধ্যায়

নইলে কেন এত অপবায়,

আসছে নেমে নিষ্ঠুর অন্যায়,

অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরই ভূত।

ভবিষ্যতের দূত, কালান্তর-এ সংকলিত প্রবন্ধেও তাঁর শাসক বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহতা ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বিষয়সমূহ প্রাধান্য পায়। ১৯০৪ সালে সফলতার সদুপায় প্রবন্ধে তিনি লিখলেন :

“ক্ষুধিত ইম্পীরিয়ালিজম স্বার্থজাল বিস্তার করাকেই মহত্ত্ব বলিয়া বিবেচনা করিতেছেন। ….ইস্পীরিয়ালতন্ত্র নিরীহ তিব্বতে লড়াই করিতে যাইবেন, আমাদের অধিকার তাহাদের খরচ যোগানো, সোমালিল্যাণ্ডে বিপ্লব নিবারণ করিবেন, আমাদের অধিকার প্রাণ দান করা, উষ্ণ প্রধান উপনিবেশে ফসল উৎপাদন করিবেন, আমাদের অধিকার সপ্তায় মজুর যোগান দেওয়া। বড়োয়, ছোটোয় মিলিয়া যজ্ঞ করিবার এই নিয়ম।

যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রেনেসাঁসের ভক্ত সেই পরে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাঁর তীব্র প্রতিবাদী উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করে ‘কালান্তর’-এ বলেন, ‘ইউরোপের বাইরে ইউরোপীয় সভ্যতার মশালটি মূলত আলো দেখাবার জন্য নয়, বরং আগুন লাগাবার জন্য। পারস্য, চীন ও মায়া সভ্যতার উদাহরণে তিনি সাম্রাজ্যবাদী রেনেসাঁসের ভয়ঙ্কর রূপটি তুলে ধরেন। তাঁর ন্যাশনালিজম গ্রন্থটি থেকে এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধসমূহে স্বদেশ রূপান্তরিত হয় বিশ্বভাবনায়। কারণ উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ মূলত বিশ্বশাসনের বিশাল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়। তাই জীবন সায়াহ্নে রচনা করেন সভ্যতার সংকট প্রবন্ধটি। যেখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার মহামারী রূপের প্রতি ঘৃণা ও অভিশাপ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার এই ঘাতক চরিত্রের সমালোচনা ও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে ড. মানস মজুমদারের রবীন্দ্রনাথ নানা প্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথের যে সকল প্রবন্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্তরূপ তুলে ধরা হলো-

“স্বদেশ ও সমাজের নৈকর্ম ও ভীরুতা যদি ধিকৃত হয় ‘কালান্তর’ (১৩৪৪) এর ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম (১৩২৪) প্রবন্ধে তো ইংরেজ শাসককুলের দমননীতি নীচতা আর শঠতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপিত হয় ‘রাজা প্রজা’র (১৩১৫) ‘কন্ঠরোধ’ (১৩০৫) এবং কালান্তরের ছোট ও বড়ো’তে (১৩২৪)। আবার বিশ্বসভ্যতার সংকটলগ্নে সংকটসৃষ্টিকারীদের নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করেন কালান্তরের ‘সভ্যতার সংকট’ (১৩৪৮) প্রবন্ধে, শ্লেষক্ষুব্ধ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় তাঁর লেখনীতে।

প্রত্যাশা করেন সংকট ত্রাতা মহামানবের। নানা রচনার ভেতর দিয়ে তাঁর প্রতিবাদপ্রবণ মানসিকতাটিকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। সমগ্র বিশ্বব্যাপী শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা রবীন্দ্রনাথের মর্মবেদনার কারণ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা রূপান্তরিত হয় বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদস্বরূপ। চীন, পারস্য ও মায়া সভ্যতার উদাহরণে তিনি তুলে ধরেন সাম্রাজ্যবাদী রেনেসাঁসের ভয়ঙ্কর রূপের বর্ণনা।

 

রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্বদেশ

 

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে শিলাইদহের পদ্মা তীরে বসেও তিনি বিশ্ব হাহাকারের অমানবিকতায় শান্তি খুঁজে পাননি। “শিলাইদহে পদ্মাতীরে বসে ১৯ শতকের শেষ দিনে সূর্যাস্ত শোভা তাঁর জন্য সৌন্দর্য্য উপভোগ ছিলো না, ছিলো যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। আফ্রিকায় বিট্রিশ বাহিনীর নির্মমতার সংবাদে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ লেখেন বহুখ্যাত কবিতা যার সূচনা পঙক্তি- শতাব্দী সূর্য আজি রক্ত মেঘ-মাঝে/অস্ত গেল।’ গোটা কবিতাটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদে সাগ্নিক।

আরও দেখুন :

Leave a Comment