রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

 

রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

 

রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকালব্যাপী সৃষ্টি করেছেন বহুমুখী বিস্ময়কর ও বিচিত্র সাহিত্যসম্ভার। সংগীত, প্রবন্ধ, নাটক, কাব্য, গল্প, গদ্য ও চিত্রকলায় বিপুল ঐতিহ্যে ঐশ্বর্যশালী রবীন্দ্রনাথের সংগীতেই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম অবস্থান বলে সর্বজন স্বীকৃত। এক সংগীতেই জীবনের সকল প্রকার আবেগের মহাসমারোহ সুস্পষ্ট, যা তিনি স্থান দিয়েছেন গীতবিতানের ছয়টি পর্যায়ে।

রচিত দ্বি-সহস্রাধিক গানে পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক পর্যায়সমূহের বৈচিত্র্যতায় জীবনের বহুবিধ দিক-নিদের্শনা পাই তাঁর দার্শনিক ভাবনায়। অনন্য সাধারণ এই গানসমূহের মধ্যে তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও সহজ সুর ও ছন্দে রচিত এই গানসমূহের বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে এর বৈশিষ্ট্যে ও স্বকীয়তায়।

উজ্জীবনী বাণীর সংযোগে সহজে অনুধাবনযোগ্য স্বদেশ পর্যায়ের এই গান রচনার মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত এই ছিলো- জনমনে তৎকালীন সামাজিক সংকট সম্পর্কে বোধ জাগ্রত করা। সেই মহান উদ্দেশ্যই দেশ জাতি ও সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এক দর্শন এবং স্বদেশবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত-

“ঊনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত সুব্যাপ্ত সেই মহাজীবন প্রায় সপ্ত দশক কালের সর্বাশ্রয়ী ভাব সৃষ্টি, অমোঘ কর্মসাধনা ও দুর্বার আত্মজাগরণের মন্ত্রে জাতির চৈতন্য-মূলকে আন্দোলিত করেছেন। বিস্ময়কর ভাবয়িত্রী ও কারয়িত্রী প্রতিভা এবং দেশ ও বিশ্বহিতৈষণার কর্মরত দিয়ে নবজাগরণের স্বর্ণদুয়ারে চালনা করেছেন আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁস ভক্ত রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে নবজাগরণের যাত্রায় অগ্রজের ভূমিকা পালন করেছেন। কখনো রাজপথে, কখনো তাঁর অনন্য সৃষ্টিতে, যার সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে তাঁর রচিত সংগীতেও। স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশীয় মানুষের প্রতি প্রেমের চেতনা তথা জনকল্যাণের আকাঙ্ক্ষা শৈশবকাল থেকেই তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে সাহিত্য, সংগীতচর্চা ও ঠাকুরবাড়ির বড় দাদাদের কর্মসংগঠনের সাথে যুক্ত হন ও কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রেখে হয়ে ওঠেন তৎকালীন মনীষীদের সমকক্ষ।

সংস্কারমুক্ত, বাস্তববাদী ও তেজস্বী রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ ব্রতে ছিলেন নির্ভীক প্রতিবাদী। মানুষের আত্মসম্মান, মনুষ্যত্ববোধ, আত্মশক্তির জাগরণ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা, গ্রামোন্নয়ন ভাবনাসহ রাজনৈতিক অস্থির মুহূর্তে স্বদেশপ্রেমের গান প্রেরণা জুগিয়েছে, শক্তি দিয়েছে দেশমাতৃকাকে কলঙ্কমুক্তির প্রতিজ্ঞায়। ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি যথার্থ দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দেশের চরম ক্রান্তিকালে দেশবাসীকে প্রেরণা জোগাতে ও উদ্বেগী করতে স্বদেশভাবনায় রচিত গানসমূহ অন্যতম বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তাতে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানের অবদানই সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। দেশ-গৌরবী সংগীতসমূহের সৃষ্টি উপলক্ষ্য কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সেদিক থেকেবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সংগীত রচনার তুলনায় স্বদেশপর্বের গান স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল।

স্বদেশি গান বিষয়ক আলোচনার সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের (১৯০৫) সময়টাকে মধ্যবর্তী পর্ব ধরে, এর আগের সময়কালকে পূর্ববর্তী ও বঙ্গভঙ্গের পরের সময়কে স্বদেশ গান রচনার পরবর্তী সময় এই সমান ভাগে বিভক্ত করে অগ্রসর হওয়া যুক্তি সাপেক্ষ।

অর্থাৎ কালানুক্রমিকভাবে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গান রচনার শুরু কিশোর কাল থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ চলাকালীন সময় তাঁর বয়স আনুমানিক ৪৪ বছর, সেই সময়ের রচনা ও এর পরবর্তী ৪৫ বছর বয়স থেকে শেষ স্বদেশি গান লেখা পর্যন্ত সময়কালকে মোটামুটি তিনটি পর্বে ভাগ করলে-এই তিনটি পর্বে রচিত তাঁর স্বদেশী গানের সংখ্যা প্রথম পর্বে ২৩টি, দ্বিতীয় পর্বে ২৫টি ও তৃতীয় ও শেষ পর্বে ১৬টি অর্থাৎ মোট ৬৪টি স্বদেশপর্বের গান পাই।

বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মোট গানের সংখ্যা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও তাঁর জীবনকাল প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গবেষণালব্ধ মোট গানের সংখ্যা ২২৩২টি; যদিও এই বিশাল গানের সংখ্যার তুলনায় স্বদেশপর্বের তথা দেশ ও জাতীয়তাভাবোদ্দীপ্ত গানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

যদিও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ভাবের অনুষদ রক্ষা করে গানগুলিকে যে পর্যায়ভিত্তিক করেছেন তাতে তিনি ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের গানের সংখ্যা রেখেছিলেন ৪৬টি। অর্থাৎ ২টি গান গীতবিতানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধানের পর আরো বর্জিত ১৬টি স্বদেশপর্বের গান সংকলন করা হয় ‘জাতীয় সংগীত’ শিরোনামে গীতবিতানের তৃতীয় খণ্ডে তাতে স্বদেশপর্বের গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২টি।

সুধাংশু শেখর শাসমলের ‘রবীন্দ্রসংগীতে স্বদেশচেতনা ধারা ও রাগান্তর’ শীর্ষক জার্নালের আলোকে এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচি’র সহযোগিতায় এই পর্বের আলোচনায় অগ্রসর হতে অনুপ্রেরণা পাই। হিন্দুমেলা, সঞ্জীবনী সভা ও পারিবারিক উৎসাহে স্বদেশ উদ্দীপনায় রচিত তাঁর কবিতা-প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধে পূর্বেই আলোচনা হয়েছে ‘পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ ভাবনা’ ও ‘রচনার বিভিন্ন আঙ্গিকে রবীন্দ্র স্বদেশ ভাবনা’ বিষয়ক পরিচ্ছেদে।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্যায়ের গান বিষয়ক বিশ্লেষণই মূল আলোচ্য বিষয়। তেরো বছরের বালক রবীন্দ্রনাথ বিনা নামে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটকে লিখলেন বীরুদ্দীপনার গান ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ। ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত এই ১০ বছরে বিভিন্ন বিষয়ের ৩০৭টি গান রচনা করেন, তাতে স্বদেশি গানের সংখ্যা ৯টি।
১৬ বছর বয়সের রচনা :

“তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ তোমারি তরে, মা, সঁপিনু প্রাণ।

তোমারি শোকে এ আঁখি বরষিবে, এ বীণা তোমারি গাহিবে গান

এটি ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় ১২৮৪ সালে এবং ১২৯২ বৈশাখে প্রকাশিত প্রথম গীত সংকলন রবিচ্ছায়াতে। ‘জাতীয় সংগীত’ শিরোনামে যে ৬টি গান গৃহীত হয়েছিল তারমধ্যে এই অনন্য সুন্দর গানটিও রয়েছে। সঞ্জীবনী সভার জন্য গানটি রচিত হয়েছে বলে অনুমান করা যায় এবং এই গানটিই সম্ভবত স্বদেশভাবনার প্রথম রচনা। রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম রচিত স্বদেশবন্দনার গানেই দেশকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন।

দেশমাতৃকার জন্য যে প্রাণ উৎসর্গ করা যায় কিশোর বালক রবীন্দ্রনাথ তা নিজে উপলব্ধি করে সকলের মাঝে এ বীণা সুধা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। দেশকে দেবী বলে, মাতা বলে সম্বোধন করে আত্ম নিবেদনের যে গভীর ভাবনা পোষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত প্রথম স্বদেশপর্বের গানে তা অভিনব। তাই এ গানটি সে সময় যথেষ্ট সমাদৃত হয়। এ গানটি জয়জয়ন্তী রাগে ও চৌতালে নিবদ্ধ করা হয়। ১৭ বছর বয়সের রচনা :

“অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী, গা লো সেই সব পুরানো গান

বহুদিনকার লুকানো স্বপনে ভরিয়া দে-না লো আঁধার প্রাণ ॥

“ঢাকো রে মুখ, চন্দ্রমা, জলদে।

বিহগেরা থামো থামো আধারে কাঁদো গো তুমি ধরা। ২

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরু বিক্রম’ নাটকের জন্য অসাধারণ একটি স্বদেশ পর্বের গান লেখা হয়েছিল। বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ১৩১১ সালে গানটিতে খানিকটা পরিবর্তন আনা হয় অর্থাৎ “বন্দে মাতরম্’ শব্দটি যুক্ত করে এর ছন্দের গতি বাড়ানো হয় এবং সুর বাড়িয়ে তাতে বীর রসপূর্ণ সমবেত সংগীতরূপে গাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা এবং আনন্দ মঠ উপাখ্যানের অন্তর্গত। তিনি এর সাথে মিল্লার রাগ ও কাওয়ালী তালের কথাটিও সংযুক্ত করে দেন। কিন্তু তাঁর প্রদত্ত সুর ও তালে গানটি গাওয়া হয়নি বা এর কোনো স্বরলিপিও পাওয়া যায়নি। এই বিখ্যাত গানটি সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরমতামত প্রকাশ করেন যে, তিনিই সর্বপ্রথম বন্দে মাতরম্ সংগীতের প্রথম অংশ সুরযোজনা করেছেন।

কংগ্রেসের প্রথম যুগের এক অধিবেশনে কবি কংগ্রেস সমবেত জনতার সম্মুখে গানটি পরিবেশন করেন। স্বদেশমাতৃকার গুণবর্ণনা সম্বলিত গানটি শুনে উপস্থিত সকলেই আকৃষ্ট হয়। এ গানটির সাথে জাতীয় সংগ্রামের স্মৃতি জড়িত থাকায় এবং গানটির জন্য বহু দেশসেবককে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে বিধায় সকলে শ্রদ্ধার সাথে গান করে থাকে।

 

রবীন্দ্র স্বদেশচেতনার গান রচনার কালানুক্রমিক ধারা

 

১৯৭৩ সালে শারদিয়া সুরছন্দা পত্রিকায় লেখক কিরণশশী দে রচিত “বন্দে মাতরম্ গানের সুর প্রসঙ্গ” প্রবন্ধটিতে এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ আছে যে, H. Bose’s pathephone রেকর্ডেও ‘বন্দে মাতরম্’ এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে গেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই গানটি স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির অনুমোদিত সুরটি রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত।

আরও দেখুন :

Leave a Comment