আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রাগ-রাগিনীর সাথে বাউল সুরের মিলন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সুর আর বাণীর কথা, কিন্তু আমরা দেখতে পাই বাউল চরিত্রটিও বার বার তাঁর নাটকে এসেছে বিচিত্ররূপে।
রাগ-রাগিনীর সাথে বাউল সুরের মিলন
‘ফাল্গুনী’ তে দেখি অন্ধবাউলকে, বাউল আছে ‘অরূপরতন’ আর ‘মুক্তধারা’তেও ‘রাজা’ নাটকে আছে বাউলের দল। আর ঠিক বাউল নয়, অথচ বাউলের মতোই গীতস্বভাব চরিত্র-
বসন্ত রায়—— ‘প্রায়শ্চিত্ত’
ধনঞ্জয় বৈরাগী– ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ‘মুক্তধারা’ ‘পরিত্রাণ’
ঠাকুরদা- ‘শারদোৎসব’ ‘রাজা’ ‘অরূপরতন’
শেখর——‘ঋণশোধ’।
নাটকভেদে চরিত্রগুলির নাটকীয় ভূমিকা বিভিন্ন হলেও এদের প্রধান সাদৃশ্য স্বভাবের গীতিমুখরতায়। এদের সংলাপ অনেক সময়ই গান, আর দেশী লোকসংগীতের সুরে যত গান আছে রবীন্দ্রনাথের নাটকে, অধিকাংশ গানের গায়ক এই বাউল বা বাউল ধরনের চরিত্ররাই।
“আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন খেপা সে, ‘
‘রইল বলে রাখলে কারো,
‘ওরে আগুন আমার ভাই’ (ধনঞ্জয়),
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’,
‘যা ছিল কালো ধলো’ (বাউলের দল),
“আমি তারেই খুঁজে বেড়াই” (শেখর) তার কয়েকটি নিদর্শন। সংখ্যার দিক থেকে ‘পরিত্রাণ’ নাটকে এই ধরনের গান সবচেয়ে বেশি।
অবশ্য এই সব চরিত্রের কণ্ঠে অন্যান্য সুরের গানও আছে, যে গানকে হয়তো রাগরাগিনীর নামেই চিহ্নিত করা যায়।
তা হলেও বসন্ত রায়ের, ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না’
ধনঞ্জয়ের, ‘আরো আরো প্রভু অরো আরো’,
“আমাকে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন’, বা
ঠাকুর্দার ‘আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান’,
‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে’,
“আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায়’, কিংবা
অন্ধ বাউলের হবে জয় হবে জয় হবে জয় রে’ গানে রাগরাগিনীর বন্ধন পেরিয়ে গভীর কথা সহজ সুরে বলার ভঙ্গিটিই মুগ্ধ করে আমাদের।
ফাল্গুনী’র অন্ধ বাউল বলে, গান না গাইলে সে রাস্তা পায় না। এই উক্তি কেবল তার একার পক্ষে সত্য নয়, জীবনে চলার পথে গান এদের সকলেরই নিত্যসঙ্গী, সংলাপের মতোই গান স্বভাবগায়ক এই চরিত্রগুলির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি।
তাই ঠাকুর্দার ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’ বা
“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশার’,
ধনঞ্জয়ের ‘কে বলেছে তোমায় বধু এত দুঃখ সইতে’,
অন্ধ বাউলের ‘ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে’ কিংবা
‘তোমায় নতুন করে পাব বলে, হারাই ক্ষণে ক্ষণ’ গানের অপেক্ষাকৃত জটিল সুরও আশ্চর্য সামঞ্জস্য পেয়ে যায় চরিত্রের সঙ্গে।
অবশ্য লক্ষ্য যায় যে এদের অধিকাংশ গান নাট্যবিষয়ের ভিতরের কথাটিকে যতটা ব্যক্ত করতে চায়, আত্ম চরিত্রকে ততটা উম্মোচন করে না। আর সে কথাটিও গানে যত বলে সংলাপে বলে তার চেয়ে বেশি।
ফাল্গুণী’র বাউল বাইরের দৃষ্টি হারিয়ে ভিতর দিয়ে দেখতে শেখে, আর ধনঞ্জয় ঠাকুর্দা এমন কি শেখরও বাইরের দৃষ্টি না হারিয়েই পেয়েছে জীবনকে দেখার নিরাসক্ত প্রেমময় অন্ত দৃষ্টি। তাই অনেক সময়ই এরা নাটকের তত্ত্ব বা জীবনের সত্যের কথা বলে সংলাপে, আর গানে করে সেই ভাবেরই পুনরুচ্চারণ, কখনো বা বিস্তার।
তা হলে কি আমরা বলতে পারি এদের গানে সংলাপের অতিরিক্ত কিছুই পাওয়া যায় না সুর ছাড়া, অনেকটা তাই (অবশ্য) তারই মধ্যে কখনো কখনো আশ্চর্যভাবে রচিত হয়ে যায় নাট্যমুহুর্ত। বলা যেতে পারে ‘মুক্তধারা’ নাটকে বাউলের ‘ও তো ফিরবে না রে’ গানটির কথা।
আসন্ন অশুভের যে আশঙ্কা জেগে ওঠে দর্শকের মনে বাউলের এই গান যেন তারই ইঙ্গিত। শঙ্খ ঘোষ যথার্থই বলেছেন, কেবল বাউলই নয়, দর্শকের মনও বলে ‘ও তো ফিরবে না রে ফিরবে না আর ফিরবে না রে। কথায় বা সংলাপে যা হতে পারত অতিপ্রকাশ্য, বাউলের সুর সেই উৎকণ্ঠাবেদনাকে পরম সূক্ষ্মতায় ছড়িয়ে দেয় আমাদের মনে।
কিন্তু এরকম উদারহণ খুব বেশি দেওয়া যায় না। আগেই বলেছি এদের সংলাপ ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার প্রকাশ নয়, জীবন সম্পর্কে অখন্ড বোধেই এদের বিশ্বাস। কথায় বোধ নাট্যদেহের সঙ্গে যুক্ত থাকে, কিন্তু সুরের মায়ায় তা অনেক সময়ই সরে যায় ঘটনার আবেষ্টন থেকে দূরে।
শারদোৎসব’ ‘ঋণশোধ’ ‘ফাল্গুনী’র নাট্য গঠনের সঙ্গে এই ধরনের গানকে মিলিয়ে নেওয়া কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু ‘প্রায়শ্চিত্ত’-‘মুক্তধারা’ কিংবা ‘রাজা’- ‘অরুপরতন’ নাটকের বিন্যাস ভিন্ন রকমের। তাই ধনঞ্জয় বা ঠাকুর্দার গান আমাদের গীতরসে আপ্লুত করলেও নাটকের পক্ষে ভারও মনে হয় কোনো কোনো গানকে ।
প্রায় এই ধরনেরই গীতস্বভাব চরিত্র সুরঙ্গমার গান সম্পর্কে অবশ্য ঠিক এমনটি মনে হয় না। তার গান কখনো তার নিজস্ব অনুভব বা চরিত্রের ব্যাখ্যা, কখনো রাজার সত্যরূপের উদ্ঘাটন; কিন্তু সবচেয়ে বেশি বোধহয় রানী সুদর্শনার অন্তরের ক্রম-উত্তরণের প্রকাশ, যে উত্তরণ নাটকের মূল বিষয়। এ কথা ‘রাজা’ নাটকের চেয়েও সত্য ‘অরুপরতন’এ। সুদর্শনা তাকে বলে:
“তুমি আমার হয়ে ডাকো না’, সুরঙ্গমা তার হয়েই ডাকে:
‘খোলো খোলো দ্বার
রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে, সুদর্শনার জন্যই তার উৎকণ্ঠা;
‘বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কি?’
“এখনো গেল না আঁধার
এখনো রহিল বাঁধা’: এ তো সুদর্শনারই বেদনাময় আর্তি;
সুরঙ্গমার গান কেবল গান শোনানোর আয়োজন নয়, সংলাপের পুনরুক্তিমাত্রও নয়, নাটকের প্রয়োজনেই কথার ভাষার সঙ্গে নাট্যকার তাকে দিয়েছেন সুরের ভাষা; সুদর্শনার সংলাপের পাশে তার গান নিয়ে আসে এক পূর্ণতার বোধ।
নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুরঙ্গমার যে সমর্পিত ভাবটি আমাদের আবিষ্ট করে রাখে, তার গানেও আছে সেই ভাবই; তাই তার সমস্ত গানকে এক সুরের সমগ্রতায় বেঁধে নিতে ইচ্ছে করে আমাদের সে সুরের নাম ‘নিদেন’, যে সুর আছে ‘নটীর পুজা’র শ্রীমতীর আত্ম-উদ্বোধনের গানেও। আর এই ভাবনার সূত্র ধরেই পঞ্চম কিংবা ধনঞ্জয় বৈরাগী-ঠাকুর্দা-অন্ধ বাউল প্রভৃতির গানের সুরকেও বলতে পারি সহজ আনন্দের সুর, মুক্তির সুর।
আরও দেখুন :