আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় শান্তিনিকেতনে নৃত্য চর্চা শুরু
শান্তিনিকেতনে নৃত্য চর্চা শুরু
শান্তিনিকেতনে নৃত্য চর্চা শুরু
শান্তিনিকেতনে যথার্থ অর্থে পদ্ধতিগত নৃত্যশিক্ষার শুরু হয় ১৯৯৯ সালের মাঘ মাসে বুদ্ধিমন্ত্র সিং নামে আগরতলা থেকে আসা এক মণিপুরী নৃত্য শিক্ষকের দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে যখন সিলেট ভ্রমণে যান তখন তাকে দেখাবার জন্য মণিপুরী নাচের আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই নাচ দেখে মুগ্ধ হন এবং সম্ভবত শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চার সম্ভাবনা ও সার্থকতা খুঁজে পান।
তিনি চেয়েছিলেন সেখান থেকেই কোনো মনিপুরী নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসতে কিন্তু কোনো কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ফেরার পথে তিনি আগরতলা হয়ে ফেরেন এবং সেখানেও মণিপুরী নাচ দেখেন। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ এবং উৎসাহে ত্রিপুরার মহারাজা বুদ্ধিমন্ত্র সিংহ নামে একজন মণিপুরী নর্তক এবং একজন মৃদঙ্গবাদক শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। শান্তি দেব ঘোষ লিখেছেন,
‘ছেলেদের কাছে তখন তা ছিল একাধারে শরীরচর্চা ও নাচ। নৃত্যচর্চার প্রথমদিকে অনুশীলনের সময় চারিদিকে একটা গণ্ডির সীমানা দেয়া হত যাতে শিক্ষার্থীরা তার বাইরে চলে না যায় এবং পিঠের সঙ্গে কাঠি বেঁধে দেয়া হত যাতে তাদের শিবদাড়া সোজা থাকে; গুরুদের নিজে প্রায়শই বিকেলে সে প্রশিক্ষণ দেখতে আসতেন। তিনি তখন থাকতেন দেহলী বাড়ীতে।
যেটা লক্ষণীয়, এই নাচ শেখার ব্যাপারটি বিরূপ সমালোচনার আশঙ্কায় শান্তিনিকেতন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বাহাদুরের দরবার হইতে দুইজন কলাবিদ আশ্রমে আসিয়াছেন। আশ্রম বালকেরা তাহাদিগের নিকট হইতে মৃদঙ্গ সহযোগে সাঙ্গীতিক ব্যায়াম শিক্ষা করিতেছে। সংবাদে কোথাও নৃত্য বা নাচ শব্দটির উল্লেখ নেই। বুদ্ধিমন্ত্র সিংহ সেবারে কিছুদিন পরে গরমের ছুটিতে ফিরে গিয়ে আর আসেন নি।
ছাত্রদের নৃত্যশিক্ষার সেখানেই সমাপ্তি ঘটে। তবে শান্তিনিকেতনে সেই প্রথম কোন ধ্রুপদী নৃতের চর্চার গুরু। মেয়েরা সে নৃত্যশিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি, সেটি ছিল কেবলমাত্র ছাত্রদের জন্য । ১৯২৩ সালে কবি সুরাট ও গুজরাট ভ্রমণ করেন। সুরাটের এক গ্রামে মেয়েদের মাটিতে বসা অবস্থায় ঢোলের তালে দুই হাতে দুই জোড়া মন্দিরা নিয়ে ছন্দতোলা এক ধরনের নাচ দেখে কবি খুবই মুগ্ধ হন।
ভ্রমণ শেষে শান্তিনিকেতনে ফেরার সময় সেখানকার মন্দিরা নৃত্যকুশলী একটি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের একটি কিশোরী কন্যা দুই হাতে মন্দিরা নিয়ে খুব সুন্দর নাচত। কবির ইচ্ছে ছিল সেই ধরনের চ শান্তিনিকেতনে মেয়েরা শিখে নিক। সবাইকে দেখাবার জন্য চৈত্র মাসের শেষে আম্রকুঞ্জে মেয়েটির নাচের আসর বসে। শান্তিনিকেতনের সবাই সেই নৃত্য দেখে মুগ্ধ। এ নাচটি শিখে নেবার জন্য একটি ছাত্রীদলকে নির্বাচন করা হয়েছিল।
ছাত্ররা তাতে স্থান পায়নি। শিক্ষা চলেছিল কিছুদিন। তারপর পরিবারটি ফিরে যায়। এই নাচটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি রচনা করেছিলেন ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’ গানটি। মন্দিরা নৃত্য শিক্ষার সেখানেই ইতি হয়। ১৯২৪ সালে শান্তিনিকেতনে ইংরেজী এভাগে জাহাঙ্গীর ওয়াকিল অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তার পত্নী কাথিয়াওয়াড় এবং গুটরাজে গরবা লোকনৃত্য পটু ছিলেন। এই নাচটি মূলত মেয়েদের নাচ।
চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে কখনো পাতে তালি দিয়ে কখনো দুহাতে দুটি দণ্ড নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে তালে তালে ঠোকাঠুকি করে নাা হয়। প্রতিমা দেবী এবং রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে মিসেস ওয়াকিল বাছাই করা ১৫/১৬ জন মেয়েকে গরবা নাচের প্রশিক্ষণ দেন। এই দম্পতি প্রায় দু বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন। মেয়েরা মোটামুটি গরবা নাচে পটুত্ব লাভ করেছিল। শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছিলেন,
যদি বারণ করো গাহিব না’
‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি
‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’
প্রভৃতির গানের সঙ্গে গরবা নাচের আদর্শে নৃত্য সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯২৫ সালে বসন্ত ও বর্ষা ঋতুর কিছু গানের সমাবেশে যথাক্রমে সুন্দর ও শেষবর্ষণ ঋতুনাট্য রচিত হয়। ছন্দময় দেহভঙ্গিমায়, মূকাভিনয় এবং গুজরাটের লোকনৃত্যের আদলেই তা করা হয়েছিল। এর পেছনে মূল প্রেরণা ছিল প্রতিমা দেবী এবং মিসেস ওয়াকিল।
শেষবর্ষণ ঋতুনাট্যে নৃত্যের প্রয়োগের যথার্থতা উপলব্ধি করেই কবি মেয়েদের মধ্যে নৃত্যচর্চা শুরু করার কথা ভাবেন এবং ত্রিপুরারাজকে আবার মেয়েদের নৃত্যশিক্ষা দেবার উপযুক্ত আরেকজন মণিপুরী শিক্ষককে পাঠানোর অনুরোধ জানান। ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে নবকুমার সিংহ এবং তার ভাই বৈকুণ্ঠনাথ সিংহ শান্তিনিকেতনে আসেন। বাছাই করা মেয়েরা এর কাছে নিয়মিত নাচ। শিখতে শুরু করে।
এদের মধ্যে ছিলেন গৌরি দেবী, শ্রীমতি দেবী, নন্দিতা দেবী, অমিতা দেবী, যমুনা দেবী প্রমুখ। নাচ শেখানো হতো শান্তিনিকেতনবাসীর দৃষ্টির আড়ালে বিরূপ সমালোচনার আশঙ্কায়। ক্লাসটির তত্ত্বাবধান করতেন প্রতিমা দেবী। এই সময় গভর্নর লর্ড লিটন কবির সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতন আসেন। তার অভ বর্নার জন্য নবকুমারের শেখানো একটি মণিপুরী রাসের নাচ দিয়ে অনুষ্ঠান সাজানো হয়।
অনুষ্ঠানের কদিন আগে রবীন্দ্রনাথ এবং কয়েকজন বয়স্ক অধ্যাপক কোণার্ক বাড়িতে বসে আগে দেখে নেন অনুষ্ঠানটি।
মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক নবকুমার সিংহ চলে যাবার পর ১৯২৯ সালে মণিপুরের ইম্ফল শহর থেকে দুজন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক আসেন এবং ছেলেরা প্রবল উৎসাহে তার কাছে নাচ শিখতে শুরু করে। শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষও মণিপুরী নৃত্যচর্চা শুরু করেন। এরা মাত্র বছরখানেক শাস্তি নিকেতন ছিলেন।
১৯৩২ সালে রুশ দেশীয় লোকনৃত্য পটু এক মার্কিন দম্পতি বছরখানেকের জন্য শান্তি নিকেতনের কাজে যোগ দিলেন। ডাঃ টিথার্স ও তার স্ত্রী রুশ দেশে কিছুকাল ছিলেন। সেখানে তারা সেদেশের কয়েক প্রকার লোকনৃত্য শিখেছিলেন। এই নাচে পায়ের ছন্দে আনন্দোচ্ছল। ভঙ্গিমার ভাবটি সহজে শেখানো যায়। মাঘী পূর্ণিমার রাত্রের অনুষ্ঠানে শান্তিদেব এদের কাছে শেখা নৃত্যভঙ্গিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নাচ তৈরি করেছিলেন রুশ দেশীয় নৃত্য ভঙ্গিতে।
কেরালার কোচিন রাজ্যের মহারাজা, কবির অনুরোধে কল্যাণী আম্মা নামে একজন নৃত্যশিক্ষিকাকে পাঠিয়ে দেন ১৯৩৪ এর জানুয়ারী মাসে। তিনি সম্ভবত মোহিনী অষ্টম নৃত্যের একজন জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। ছাত্রীরা এর কাছে স্বরম, কইকুট্টিকলি ও কলাম্বুলি নামে কয়েকটি নাচ শিক্ষা করেন। তিনি অভিনয় নৃত্য শেখাতে পারেননি কারণ তার সাথে গায়ক ও বাদক ছিল না।
এছাড়া নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানতেন না। কল্যাণী আম্মার শেখানো নৃত্যভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে কম্পোজিশান এর মধ্যে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ গানের সঙ্গে নাচকে খুব সুন্দর মেলানো হয়েছিল। গরমের ছুটিতে দেশে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।
এবারে কথাকলি নৃত্যের নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে কবি ভাস্তাখোর নারায়ণ মেনন প্রতিষ্ঠিত কোচিন রাজ্যের কথাকলি নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কেরালা কলামগুলমে যান তখন কেলু নায়ার সেখানকার তরুণ শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে শান্তিদেবই তাকে নির্বাচন করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। কেলু নায়ার সে বছরই কেরালা কলামলন্ডলমের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপরই শান্তিনিকেতনে এবং রবীন্দ্র নৃত্যে কথাকলি নৃত্য একটি স্থায়ী আসন লাভ করে।
১৯২৫ সালে নবকুমার প্রথমবার শান্তিনিকেতনে আসেন। ১৯২৭ সালে তিনি আহমেদাবাদে চলে যান এবং ১৯৩৫ সালে বেেত মণিপুরী নৃত্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে যান। এর মধ্যে প্রয়োজনে খবর পাঠিয়ে তাকে শান্তিনিকোনে বিভিন্ন সময়ে আনানো হয়েছে বিশেষ করে অনুষ্ঠানের সময়। ১৯৩৪ এর মার্চে নবকুমার হি আবার আসেন। সঙ্গে ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ্য পুত্র নরেন্দ্র সিংহ।
পরের বার নবকুমার মণিপুরী নৃত্যের আরেকটি নতুন দিক শান্তি নিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের সামনে উন্মুক্ত করলেন যা পূর্বে করননি। বিশুদ্ধ মণিপুরী নৃত্যভঙ্গিতে কবির গানের কলির ফাঁকে ফাঁকে অনুকূল ছন্দের বোলের নাচ ঢুকিয়েছিলেন। এতে নাচে যেমন বৈচিত্র্য এসেছিল তেমনি জমজমাট লাগতো। বাকি আমি রাখবো না, কেন পান্থ এ চঞ্চলতা প্রভৃতি গানের সাথে এই আদর্শে নৃত্য সংযোজন করা হয়।
এটি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনৃত্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। নবকুমার যখন তার কর্মস্থলে ফিরে যান তারপর শিলচর থেকে ১৯৩৪ এর জুলাই মাসে রাজকুমার সেনারিক 1 নংহ এবং মৃদঙ্গ বাদক মহিম সিংহকে নিয়ে আসা হয়। সেনারিক সিংহ পূঝার ছুটিতে শান্তিনিকেতনে দলের সঙ্গে মাদ্রাজ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে যান। পরিবর্তে, শিলচর থেকে আসেন নীলেশ্বর মুখার্জি। তিনিও মণিপুরী। শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন,
“শিলচরের মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক শণি [রী পঞ্চম তালের একটি সম্মেলক নৃত্য, খোলের বোলের সঙ্গে শিখিয়েছিলেন। ছন্দ ও ভঙ্গি বৈচিত্র্য নাচটি ছিল খুবই জমাট। গানের সঙ্গে নাচটিকে বেঁধে রাখবার প্রয়োজন গুরুদেব ‘দূরের বন্ধ সুরের দূতীরে’ গানটি রচনা করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে মাদ্রাজে শাপমোচনের অভিনয় কালে নাচের জন্য গানটিকে রাখা হয়।’
আরও দেখুন :