আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় শাপমোচন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শাপমোচন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শাপমোচন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৩৩৮ সালেই পৌষমাসে জোড়াসাঁকো ভবনে পাঠ ও নৃত্যগীত সহযোগে শাপমোচন প্রথম অভিনীত হয়। এর গানগুলি পূর্বরচিত নানা গীতিনাটিকা হতে সংকলিত। তবে এর জন্য কয়েকটি। নতুন গানও কবি রচনা করেছিলেন। শাপমোচনের সূচনাসঙ্গীত-
‘এ শুধু অলস মায়া এ শুধু মেঘের খেলা’।
মদ্ররাজকুলে মধুশ্রী জন্ম নিল কমলিকা নামে। তাদের জন্মান্তরীণ আত্মবিস্মৃত বিরহবেদনার গান।
‘জাগরণে যায় বিভাবরী’।
গান্ধারের রাজ অন্তঃপুরে কেমন করে কমলিকার ছবি এসে পড়ল। তা দেখে অরুণেশ্বরের মনে এল গান:
“ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে।
ছবিখানি দিনের চিন্তা ও রাতের স্বপ্নের পরে আপন ভুমিকা রচনা করল গানে
তুমি কি কেবলি ছবি শুধু পটে লিখা’।
রাজা চিঠি লিখলেন চিত্ররূপিনীর উদ্দেশ্যে:
‘কখন দিলে পরায়ে স্বপনে ব্যাথার মালা বরণমালা’।
সখীদের নিয়ে বারবার সে চিঠি পড়ল রাজকন্যা দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে’। গান্ধারের দূত এল মদ্ররাজধানীতে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে। সখীরা রাজকন্যাকে গিয়ে সে সংাবদ জানালে বাজিবে সখী বাঁশি বাজিবে। চৈত্রপূর্ণিমা তিথিতে বিবাহরাত্রে রাজার বুকের মধ্যে রক্ত ঢেউ খেলিয়ে উঠল। তার মনে পড়েেত থাকলো লোকান্তরে এমনি রাতে কার
সঙ্গে যেন দোলায় দুলছিলেন তিনি। সেই অস্পঃ স্মৃতি এল গান হয়ে
“সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা’।
রাজার প্রতিনিধি হয়ে হস্তীপৃষ্ঠে এল অরুণেশ্বরের বীণা। দূরোদ্দিষ্ট রাজার আবাহনসঙ্গীত গাইল সখীগণ :
“তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে এল গো।’
অরুণেশ্বরের বীণার সঙ্গে কমলিকার পরিণয়। বিবাহসঙ্গীত ধ্বনিত হল:
“বাজো রে বাঁশরি বাজো।’
বীণার সঙ্গে রাজকুমারীর মালা বদলের গান গাইল সখীরা:
‘লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি।’
বধূ পতিগৃহে যাবার সময় সখীরা সুন্দরকে প্রণাম করে গাইল-
‘রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাওগো এবার যাবার আগে’।
পতিগৃহে এল রাজবধূ। রাজা থাকেন অন্ধকার গৃহে। রাজা তাকে চাক্ষুস দেখা দেন না। আগে অন্তরে দেখে নিতে বলেন, তার গানের মধ্যেই তাকে দেখতে বলেন:
কোথা বাইরে দুরে যায়রে উড়ে হায়রে হায় । একদিন রাত্রি তৃতীয় প্রহরে কমলিকা তার সুগন্ধি চুলে রাজার দুই পা ঢেকে মিনতি জানাল তাকে দেখবার জন্য। না হয় সে বিদায় নিতে চাইল অন্ধকারের বুকে তার কান্না রেখে গিয়ে। তখনকার গান:
“আমি এলেম তোমার দ্বারে’।
রাজা বললেন রাণী যেন না দেখার নিবিড় মিলনকে নষ্ট না করেন। রাণী এখনো আনমনা, তাই শুভদৃষ্টির সময় এখনো আসেনি। তখনকার গান:

‘আনমনা গো আনমনা,
তোমার কাছে আমার বীণার মাল্যখানি আনবনা’।
রাণীর মনে খেদ থেকেই যায়, সেকি কোনদিন রাজাকে দেখতে পাবে না? রাজা জানালেন পরেরদিন চৈত্রসংক্রান্তিতে নাগকেশরের বনে নৃত্য হবে। রাণী যেন প্রসাদ শিখরে থেকে চেয়ে দেখেন। কিন্তু রাজাকে রাণী চিনবে কেমন করে? রাজা বললেন যেমন খুশি কল্পনা করে নিতে। তখনকার গান:
‘হায়রে, ওরে যায় না কি জানা।
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে রাণী সেই নাচ দেখলেন। কিন্তু নৃত্যসভায় একজন কুশ্রীর অংশগ্রহণ তার মনকে পীড়িত করল। রাজা সেই শ্রীহীনের জন, করুণা দাবি করলেন রাণীর কাছ থেকে। তিনি গাইলেন :
‘বাহির ভুল ভাঙ্গবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙ্গবে কি।’
রাণীর আকাঙ্খা মত রাজা দেখা দিলেন তাকে। কিন্তু শ্রীভ্রষ্ঠতার আঘাত সইতে পারলেন না রানী, তিনি ঘর থেকে ছুটে পালালেন। রাজা তাকে ডাক দিয়ে গাইলেন :
না যেয়োনা ঘেয়ো নাকো
মিলনপিয়াসি মোর কথা রাখো’।
কিন্তু রাণী চলে গেলেন বহুদূরে, বনের মধ্যে যে মৃগয়াগৃহ আছে রাজার সেই খানে। মধ্যরাতে শোনা যায় বীণাধ্বনি, চিরবিরহের সঞ্চিত অশ্রু বুকের মধ্যে উছলে ওঠে। রাণী গেয়ে ওঠেন:
“সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন মানেনা’।
রাতের পর রাত যায়। রাণী মনে ভাবেন যখন তিনি কাছে এলেন তখন ছিল কৃষ্ণসন্ধ্যা, চাঁদ উঠল তার মালাখানি রইল তিনি রইলেন না। রাণীর গান: যখন
“যখন এসেছিলেন অন্ধকারে।
নাচ দেখালেন রাণী। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ডুবছে অন্ধকারের তলায়। তিনি মনস্থির করলেন, দৃষ্টিকে আর ভয় নেই, তিনি যাবেন রাজসন্দর্শনে। তখনকার গান: প্রদীপ তুলে ধরে রাজার মুখখানি দেখলেন রাণী। কী সুন্দর মনে হল রাজার রূপ তার কাছে।
মোরে বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি’।
তিনি গাইলেনঃ
বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে।
এই মিলনের মধ্য দিয়েই শাপমোচনের সমপ্তি। এ কোন অধ্যাত্ম নাটক নয়। এ নাটক রোমান্টিক, প্রকৃত প্রেম যে রূপমোহের অন্তরাল। তাঁ, সে কথাই বলা হয়েছে এখানে। সেই মহান অনুভবের প্রতি কমলিকাকে এগোতে হয়েছে ক্রমে ক্রমে। দেহের শাপকে মোচন করে তিনি অদেহ সুন্দরের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। গানই এ রচনার প্রাণ। কথকতা সামান্য, গানেই সকল
অভিব্যক্তি অতি গভির ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
আরও দেখুন :