শিকল ভাঙার গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় শিকল ভাঙার গান

শিকল ভাঙার গান

 

শিকল ভাঙার গান

 

শিকল ভাঙার গান

নির্যাতিত আর নিপীড়িত মানুষের জন্য নজরুলের আপসহীন ভালোবাসা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে শত ধারায় শিকল ভেঙে মানুষকে আশার আলো দেখার পথ রচনার।

গান, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, খবরের কাগজ বা চিঠিপত্র সর্বত্র তাঁর এই বলিষ্ঠ ও আপসহীন সংগ্রামের আভাস পাই। নজরুল ইসলামের সমস্ত কবিজীবনের সদাজাগ্রত সবচেয়ে দীপ্ত প্রেরণার উৎস হলো শোষণহীন, পীড়নহীন এক সমাজ আর সুস্থ বলিষ্ঠ মানবতা সম্বন্ধে গভীর এক প্রত্যাশা আর তার জন্য ক্লান্তিহীন আপসহীন সংগ্রামের সংকল্প নজরুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন সারাজীবন। ছাত্র-সৈন্য-কৃষক-

শ্রমিক এ সকল পেশায় মানুষের অসন্তোষ নজরুলকে ভাবিত করতো। নজরুল তাদের এই অসন্তোষের বেড়াজাল থেকে স্বাধীনতা, শোষণ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। তাদেরকে একত্রিত করার প্রয়াসে রচনা করেছেন বহু কোরাস ধরনের গান বা মার্চ সংগীত। এই সকল সংগীত তখন স্কুল, কলেজ বা যেকোনো মিটিং মিছিলে যুবসমাজ গর্জে উঠতো। গেয়ে উঠতো সমস্বরে-

“এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল ।

এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল ॥

তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হ’তে নয়,

ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাধন ভয়।

এই বাঁধন প’রেই বাঁধন-ভয়কে করবো মোরা জয়।

এই গানের সুরে ও ছন্দে অদ্ভুত এক শক্তি সঞ্চারিত হয় মনে। স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধে আত্মনিবেদনে এ সকল গানের ভূমিকা অসাধারণ। এ যেন এক অর্জিত কন্ঠস্বর যে সময়ের আহ্বানে যুবসমাজে এক নবযুগের সূচনা হয় রক্তে লাগে দোলা। পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করতে এ সকল শিকল ভাঙার গানে নজরুল বন্ধন এবং ত্রাসের অবসান চেয়েছেন বারবার। অর্জিত কন্ঠস্ব যেন এক অনাগত দেবতা অগ্রপথিক হয়ে সকল মুক্তি পিপাসুর পথ দেখায়। এই শৃঙ্খলে তাঁর আগমনী ঝঙ্কার শোনা যায়।

“আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ বরাভয়

এ যে আনন্দ-বন্ধন ক্রন্দন নয়।

ওরে নাশিতে সবার এই বন্ধন-ত্রাস,

মোরা শৃঙ্খলে ধরি তারে করি উপহাস।

২৫ (রাগ: ইমন কাওয়ালী)

কবির ভাষ্যে নিপীড়ন-পীড়নের সময়ের অবসান করতে হবে সকল শৃঙ্খলমুক্ত আনত বন্ধনে। সেই শিকলে এখন বেজে উঠেছে বাঁধনছেড়ার ডাক। শৃঙ্খলে শোনা যায় আগমনীর ঝঙ্কার। অর্জিত কন্ঠস্ব কারাগারসম পরাধীন জীবনে কবি এই শৃঙ্খল বন্ধনের অন্তরালে নতুন সূর্যালোক দেখতে পান। শিকলে যেন বেজে উঠেছে বীরের মুক্তি তরবারি। সেই মুক্তি তরবারির পেছনে রয়েছে ত্রিশ কোটি প্রাণের মুক্তি প্রতিষ্ঠা। তাই যে বীর শৃঙ্খলিত হয়ে বাঁধনছেঁড়ার বন্ধনা শীতে উৎসারিত তারজন্যেই গাঁথা হয় বিজয়মালা।

“শিকলে যাদের উঠেছে বাজিয়া বীরের মুক্তি-তরবারি,

আমরা তাদেরি ত্রিশ কোটি ভাই, গাহি বন্দনা-গীতি তা’রি ॥

তাদেরি উষ্ণ শোণিত বহিছে আমাদেরও এই শিরা-মাঝে,

তাদেরি সত্য-জয়-ঢাক আজি মোদেরি কণ্ঠে ঘন বাজে ॥

সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে তখন চলছিল স্বদেশি আন্দোলনের উত্তেজনা। তৎকালীন জনমানসে নজরুলের এ সকল শিকল ভাঙার গান এক সাড়া জাগানো প্রভাব ফেলে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনার গান যেমন আমাদের ভাবিত করে, নজরুলের গান তেমনি আমাদের চাবুক মেরে জাগ্রত করে। তাঁর গানের আবেগ যেন কোনো বুদ্ধি-বিবেচনাবোধের চিন্তাক্লিষ্ট সৃষ্টি নয়, এ যেন মনের গভীরে লুকায়িত জীবনীশক্তির সুধায় আবৃত।

 

শিকল ভাঙার গান

 

তাই আবেগই তাঁর গানের প্রধান উপজীব্য। এ আবেগ মানে না কোনো বাঁধা-শৃঙ্খল। জানে শুধু যে করেই হোক শৃঙ্খল ভাঙতে হবে, মুক্ত করতে হবে দেশকে। তাই কৰি এইরূপ আরো কতিপয় গান রচনা করেছেন। নিচে সেগুলোর উল্লেখ করা হলো :

ক . “ও ভাই মুক্তি সেবক দল !
তোদের কোন্ ভায়ের আজ বিদায়- ব্যথার নয়ন ছল-ছল ?

খ . “আজ ভারত-ভাগ্য বিধাতার বুকে গুরু-লাঞ্ছনা- পাষাণ-ভার,

আর্ত-নিনাদে হাঁকিছে নকীব, কে করে মুশকিল আসান তার ?

গ . “একি বেদনার উঠিয়াছে ঢেউ দূর সিন্ধুর ‘পারে, নিশীথ-অন্ধকারে।
পূরবের রবি ডুবিল গভীর বাদল-অশ্রু-ধারে, নিশীথ অন্ধকারে। ”

ঘ . “এই দেশ কা’র ? তোর নহে আর। রে মূঢ় সন্তান! ভারত মাতার

দেবতার দেশে আজ, দৈত্য ক’রে বিরাজ, মন্দির আজি বন্দীর কারাগার।

কবির এই গানগুলোতে শৃঙ্খলের এক অন্যরকম অর্থ পাই। কারাগার কেবলই লৌহের বাঁধন হবে তা নয়। যখনই ভারত মায়ের কোনো সন্তান ভীত সংকুচিত হয়ে নিজেকে কেবল বাঁচাবার জন্য আড়ালে থাকে কবি সে জীবনকেও কারাজীবনের সাথে তুলনা করেছেন। দাসত্বের শিকল কবির কাছে লৌহবন্ধনের থেকেও কঠিন। তাই যারা দাসত্বের শিকলকে বরণ করে হাসি মুখে ফেরে কবি তাদের ভারত মায়ের মূঢ়, অযোগ্য সন্তান বলেছেন।

মন্দির সমান ঘর আজ বন্দির কারাগার। ঘরের মা যখন দাসি। লজ্জার আর অসম্মানের এ জীবনের অবসানে সকল সন্তানকে কবি জেগে উঠতে বলেছেন। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে মনের শিকল ছিন্ন করে দেবতার এ রাজ্যকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। পরাধীনতার এ লজ্জা থেকে নিজেদের কলুসমুক্ত করতে হবে। তেমনি বাংলায় মহাত্মার আগমনের আনন্দে সকল প্রাণ দিগ্বিদিক।

কংস কারার দ্বার ঠেলে তার আগমন এ বাংলায় মুক্তিপাগল মানুষের কাছে এ দিন বড় আনন্দের, বড় আকাঙ্ক্ষার। এ আগমনে সকল জাত-বিজাতের ব্যবধান ভুলে বামন- মুচি সব এক হয়ে গেল। অর্থাৎ কাউকে না কাউকে এ কারা ভেঙে বের হতে হবে। শিকল ভাঙার উদাহরণই কেবল সৃষ্টি করবে শতসহস্র শিকল ভাঙা পথিকের। যে পথিক পথ দেখাবে মুক্তির পথ দেখাবে নতুন সূর্যালোকিত স্বাধীনতার।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

“আজ না চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে

ঐ কংস কারার দ্বার ঠেলে।

আজ শব শ্মশানে শিব নাচে ঐ ফুল ফুটানো পা ফেলে

এই গানটিকে আবার বিজয়গাঁথার গানের অংশেও সংযুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এতে রয়েছে বিজয়ের আলো। প্রত্যাশিত মহাত্মাকে পেয়ে সকল বাঙালির গর্বের আরতি এ গান।

আরও দেখুন :

Leave a Comment