শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

 

শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

 

শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

“আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,

আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয় কেতন

কবি নজরুল তাঁর সামগ্রিক রচনায় অচেতন জাতির চেতন ফেরাবার সাধনা করে গেছেন তাঁর নিজস্ব পন্থায়। নজরুলের গানে স্বদেশচেতনাকে বুঝতে হলে অবশ্যই তাঁর জাগরণমূলক গানের পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন। নজরুল মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। মানুষের শক্তি অপরিসীম। তাই তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন নানাভাবে। মানুষের বন্দিদশা, ভিরুতাকে, পরাধীনতাকে কবি ধিক্কার জানিয়েছেন। নিজের পায়ের শেকল ভাঙতে নিজেকেই জেগে উঠতে হবে।

নজরুলের স্বদেশি সংগীতগুলো নিদ্রাচ্ছন্ন জাতির বুকে এক নতুন স্পন্দন এনে দেয়। জাগরণের জোয়ারে স্বদেশচেতনায় দেশ-জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পূর্বের আলোচনায় আমরা পেয়েছি যে, দেশাত্মবোধক গান রচনায় রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ অন্য দুই কবি রজনী-অতুল প্রসাদেরও যথেষ্ট অবদান আছে।

কিন্তু নজরুল ইসলামের স্বদেশপর্বের গানে যে উন্মাদনা তা তাঁদের সুর চেতনায় সেই উন্মাদনার আঘাত হানে না। যেমন—চিল্‌ চল্ চল্ ঊর্ধ্বে গগনে বাজে মাদল’, ‘অগ্রপথিক হে সেনা দল’, ‘জাগো অনশন বন্দী’, ‘জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা’, ‘টলমল টলমল পদভরে, -বীর দল চলে সমরে। এই সকল গানে এক রকম উত্তেজনা, পৌরুষ ব্যক্ত রয়েছে।

কবি এই সকল গানে ব্যান্ডের সুর, মার্চের সুর প্রয়োগ করে গানগুলোকে একপ্রকার অগ্নিশিখাদীপ্ত আগুনঝরা গান করে তুলেছেন। যেখানে জাগরণের বাণী হয়ে ওঠে ভাগ্য পরিবর্তনের সোপান-

ক. “ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।

দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা

ভরিয়া বাতাস, জুড়ি’ বিমান

খ. জয় হোক জয় হোক-

শান্তির জয় হোক,

সাম্যের জয় হোক,

সত্যের জয় হোক, জয় হোক ॥

গ. “জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী

ডুবালো পাপ-চণ্ডাল তোদের বাঙলাদেশের কাশী।

ঘ. “জাগো জাগো জাগো হে দেশপ্রিয় !

ভারত চাহে তোমার হে বীর-বরণীয়।

ঙ. “জাগো তন্দ্ৰামগ্ন জাগো ভাগ্যহত ।

তব গৌরব-কেতন সমুন্নত ঐ হল আনত।

নজরুলের জীবদ্দশায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এমন কি কলকাতায়ও দাঙ্গা হয়েছিল যা নজরুলকে ভীষণভাবে আঘাত করে। তিনি তাঁর বিভিন্ন গানে এর সরব বিরোধিতা করেছেন এবং এর অবসানে বহু প্রচেষ্টাও চালিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে নজরুলের অন্তর্নিহিত আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ তাঁর জাগরণমূলক বা উদ্দীপনামূলক গান।

নজরুলের স্বদেশ সংগীত ভাণ্ডারের সমগ্রটা জুড়ে রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ। শুনেছি একই বৈঠকে বসে কবি যেমন ইসলামি গজল, হামদ-নাত লিখেছেন, তেমনি কীর্তন ও শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। জীবনের শুরু থেকেই তিনি সমন্বয়বাদী ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মকেই তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন, তেমনি ধনী-গরিবের ব্যবধান নিরসনে কৃষকদের জেগে উঠতে আহ্বান করেছেন। কবির ভাষায়-

“ওঠরে চাষী জগদ্বাসী, ধর ক’ষে লাঙল।

আমরা মরতে আছি ভাল করেই মরব এবার চল ॥

কাজী নজরুল ইসলাম কৃষকদের জাগ্রত করার লক্ষ্যে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করতে রচনা করেন ‘কৃষাণের গান’। ‘সর্বহারা’ গ্রন্থে প্রকাশিত এই গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার সাথে সাথে সর্বহারা শব্দটিও প্রথম সকলের কাছে উন্মোচিত হয় এবং তৎকালীন সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক একটি উচ্চারণ হয়ে ওঠে। লাঙল পত্রিকায় ৮ই পৌষ ১৩৩২ সংখ্যায় কৃষাণের গান প্রকাশিত হয়। চাষীদের উজ্জীবিত করতেই মূলত কবির এ গান রচনা।

কবি কৃষকের সকল জড়তা কাটিয়ে তার উঠানভরা শস্যের মায়াভরণের কথা স্মরণ করে সাহসী হতে বলেছেন, সকল লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে বলেছেন। কারণ কৃষকের লাঙলের শক্তি যেকোনো অস্ত্রের নজরুলের স্বদেশ চেয়ে অধিক শক্তিশালী। লাঙলই পারে ক্ষুধাতুর মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতে, তাই কৃষকের গুরুত্ব কৃষককেই উপলব্ধি করে জেগে উঠবার আহ্বান করেছেন কবি।

১৯২৬ সালের ৬ ও ৭ই ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে শ্রমিকের গানরূপে কথিত এই গানটি নজরুল রচনা করেন এবং নিজেই তা সম্মেলনে পরিবেশন করেন। এ প্রসঙ্গে হেমন্ত সরকার জানিয়েছেন : “কনফারেন্সের জন্য গান লেখার ফরমাস করা গেল নজরুলকে।

তাঁকে একটা ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আদায় করলুম দু’টি গান—“ধ্বংস পথের যাত্রীদল’ আর ‘ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’। বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের গান ছিলো না এর আগে, নজরুলের স্বদেশ নজরুলই তার পথকার। নজরুলের সংগীত রচনাকর্মে জীবনবোধ ও চিন্তাধারায় যে সময়ের প্রত্যাশা ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে যা সমকালীন অন্য কোনো সংগীত রচয়িতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না।

ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদল ভারতবর্ষে প্রায় দু’শ বছর রাজত্ব করে। সেই শাসনের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নজরুল সংগ্রাম করেছেন তাঁর রচনাকালের শেষ দিন পর্যন্ত। তাই নজরুল তাঁর প্রত্যেক কর্মে স্পষ্ট করে তাঁর স্বদেশপর্যায়ের প্রায় প্রতিটি গানে জাগরণের মন্ত্রকে তুলে ধরেছেন যা মানুষকে আত্মজাগরণ এবং স্বাধীনতা মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছে।

“অগ্নিযুগের অন্যতম পুরুষ ও স্বাধীনতা যজ্ঞের ঋত্বিক বারীন্দ্রকুমার ঘোষের কাছ থেকে নজরুল শিখেছিলেন বিপ্লববাদের দীক্ষা। মুক্তি-আন্দোলনের নেতা মুজফ্ফর নজরুলের স্বদেশ আহমদের সাহচর্য ও বন্ধুত্বে নজরুল মুক্তিযুদ্ধের যে মূর্তি উপলব্ধি করেছিলেন তা তাঁর কাব্যে একটি বিশেষ বিদ্রোহ ও বিক্ষোভের রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ”

কবি নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন কৃষকের গোলাভরা ধানের যে আনন্দ তা বিলুণ্ঠিত করেছে ইংরেজ শাসক। দস্যুবেশে এসে তারা লাঞ্ছিত করছে। লক্ষ্মীমায়ের কোলে তারা থাবা বসিয়েছে। সেই মায়ের কাঁদনে কৃষকের সকল সুখ শত সাগরের লোনা জলে মিশে গেছে। এই শাসন ও শোষণ থেকে পরাধীন কৃষক, মা ও মাটিকে মুক্ত করতে কবি বিপ্লবী সংগ্রামীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

লাল নিশান উড়িয়ে নববসন্তের সূর্যকে জাগাতে আহ্বান করেছেন কবি। শত বছরের মৃত্যুবাণ প্রতিহত করে চিরবসন্তের যৌবনকে জাগাতে, পুরাতনের দাসত্বকে বিদায় জানাতে আহ্বান করেছেন কবি। নজরুলের স্বদেশ সর্ব অকল্যাণ-পীড়ন আর অশান্তির, মিথ্যা ভ্রান্তির ক্ষয় চেয়েছেন কবি শান্তি আর সাম্যের জয়ের প্রত্যাশায়।

এই উপমহাদেশের মানুষ নানারকম গোড়ামী, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, বর্ণবিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিবিদ্বেষ প্রভৃতি বহুবিধ পাশবিক আবরণে নিজেদেরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল। তারা নিজের পায়ে নিজেরাই শেকল পরে। কবি সেই শেকল ভাঙতে চেয়েছেন, সকল ক্ষয়ের বিনাশ করে জয়ের নিশান উড়াতে চেয়েছেন।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

তন্দ্রামগ্ন ভারতবাসীকে জাগাতে কবি সকল দেশপ্রেমিক বীরকে জেগে উঠবার আহ্বান করেছেন। মন্দিরের বিগ্রহ ধুলায় লুটায়, লক্ষ্মীর চরণের আলপনাও মুছে যায়। কবি বাংলা মায়ের এ রূপ সমুন্নত রাখতে সকল তরুণ দলকে, সকল বীরকে দণ্ড হাতে সকল বঙ্গবাসীকে জেগে উঠতে বলেছেন। কবির ভাষায়:

“জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী।

ডুবালো পাপ-চণ্ডাল তোদের বাংলাদেশ কাশী-

জাগো বঙ্গবাসী

এই গানটি সম্পর্কে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা গ্রন্থে লিখেছেন,

“নজরুল ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের নাম দিয়েছে অন্তর ন্যাশনাল সংগীত। হয়তো সকলে জানেন না যে, ইন্টান্যাশনাল সংগীতের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই গানটির ভিতর দিয়েই মজুরশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা বিশেষভাবে ফুটে উঠে। সারা দুনিয়ার মঞ্জুরশ্রেণীর মধ্যে যে একটা সংঘবদ্ধতা আছে তাও প্রকাশ পায় এই গানটির ভিতর দিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় এই গানটি গাওয়া একই সুরে।

মজুরশ্রেণীর কোন বিশ্ব সম্মেলনে এই গানটি গাইতে শুনলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। হয়তো চল্লিশটি দেশের লোকেরা চল্লিশটি বিভিন্ন ভাষায় একই সুরে একই সঙ্গে গানটি গেয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না যে বিভিন্ন ভাষীরা গানটি গাইছেন। প্রথমে একজন ফরাসী মজুর এই গানটি লেখেন। পরে নানান দেশের নানান ভাষায় তরজমা হয়ে গানটি বিশ্বসংগীতে পরিণত হয়।

১৯২৬ সালে আমি নজরুলকে এই গানটি বাংলায় তরজমা করতে বলি। তার জন্যে গানের একটি ইংরেজী কপি তো তাকে জোগাড় করে দিতে হবে। চেষ্টা করেও আমি এমন একখানা বই জোগাড় করতে পারলাম না যাতে ব্রিটেনের মজুররা যে তরজমাটা গান তা পাওয়া যায়। আমেরিকার তরজমাটি পাওয়া গেল আপ্টন সিংক্লেয়ারের হেল নামক নাটিকায়…। ১৪
জাগরণীপর্বের গানে নজরুলের আরো কিছু গানের সংযুক্তি প্রাসঙ্গিক মনে করছি। যেমন-

ক. “ঝড়-ঝঞ্ঝার ওরে নিশান, ঘন-বস্ত্রে বিষাণ বাজে।

জাগো জাগো তন্দ্রা-অলস রে, সাজো সাজো রণ-সাজে ॥”

খ. “দুরন্ত দুর্ম্মদ প্রাণ অফুরাণ

গাহে আজি উদ্ধত গান ।

লঙ্ঘি’ গিরি-দরী

ঝঞ্ঝা নূপুর পরি’

ফেরে মন্থন করি’ অসীম বিমান

গ. “পর হবে তোর আপন জনে

(তুই) ভাবনা তবু করিস্ নে

হয়ত তরী ডুববে জলে

(তবু) তুফান দেখে ডরিস নে

ঘ. “ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও !

ফিরে চাও গুগো পুরবাসী

সন্তান দ্বারে উপবাসী,

দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!

জাগো গো, জাগো গো,

তন্দ্রা-অলস জগো গো,

জাগো রে জাগো রে !

ঙ. “জননী । জননী । আবার জাগো অভ্র শারদ-প্রাতে

আঁখি তোল অনসিত অনাহত মহিমাতে

এই পর্বের প্রতিটি গানে আশা জাগানিয়া এক উদাত্ত ভাবের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কখনো কবি নিজের লক্ষ্যে নীরবে নিভৃতে পথ চলতে অটল থাকতে বলেছেন, কখনো উদ্ধৃত গানে মার্চের সুরে দুরন্ত দুম্মদ প্রাণ অফুরানের আনন্দে মৃত্যুকে নিঙড়ে জীবনকে বরণ করতে বলেছেন।

 

শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

 

আবার পরক্ষণেই কবির মানবতার ভিক্ষা চাইছেন মুক্তি চাইছেন জাগো জাগো বলে। উপবাসী সন্তানের মুখে অম্লানের জন্য পুরোবাসীকে জেগে উঠতে বলেছেন। উপস্থাপনগত দিক, সুরের ঝঙ্কার যেমনই হোক নজরুলের এ সকল গানেই তিনি রূপক শব্দের অদ্ভুত ব্যবহারে ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে জাগাবার আমরণ সংগ্রাম করে চলেছেন যেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment