বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে বাংলাদেশের কয়েকজন কালজয়ী শিল্পীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন ওস্তাদ আয়েত আলী খান। সরোদ উদ্ভাবনে তাঁর অবদানের কথা পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

এই গুণী শিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা সম্পর্কে বিশিষ্ট সংগীত গবেষক, লেখক, অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে অবস্থিত ম্যাকোয়ারি ইউনিভার্সিটির ‘কনটেমপোরারি মিউজিক স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং বিশিষ্ট সরোদ বাদক ড. এড্রিয়ান ম্যাকনিল তাঁর ‘Inventin the Saroda Cultural History’ গ্রন্থে লিখেছেন “ Ayet Ali Khan, the yonger brother of Alauddin Khan. was a Surbahar player and gifted luthier (বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা),

The brothers started an instrument making business in the Brahminbaria district of what was the then East Bengal. Ayet Ali made a series of sarods that culminated in the instruments he made for his nephew Ali Akbar Khan and his son Bahadur Khan.”

সরোদের আধুনিক রূপদানের পেছনে রয়েছে ওস্তাদ আয়েত আলী খান (১৮৬২-১৯৭২) এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৮৮৪-১৯৬৭), এই দুই ভাইয়ের সুদীর্ঘ গবেষণার ইতিহাস। ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামে একটি সংগীতপ্রেমী পরিবারে এই দুই ভাইয়ের জন্ম। পিতা সফদর হোসেন খান ছিলেন একজন সৌখিন সেতারবাদক। তাঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে সবাই সংগীত শিল্পী ছিলেন। এর মধ্যে তিনজন ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান।

সফদর আলী খানের দ্বিতীয় পুত্র ফকির (তাপস) আফতাবউদ্দিন খান অসাধারন তবলাবাদক এবং বংশীবাদক ছিলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খানের প্রথম গুরু ছিলেন তিনিই। আফতাবউদ্দিন খান ন্যাস তরঙ্গ নামে একটি যন্ত্র বাদনেও খুব দক্ষ ছিলেন। এই যন্ত্র বাজানো অত্যন্ত কঠিন এবং বাজানোর পদ্ধতিও অভিনব। এটি শুষির গোত্রের যন্ত্র হলেও ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয় না।

যন্ত্রে দু’টি বাঁশির মত অংশ থাকে, কিন্তু তাতে কোন ছিদ্র থাকে না । এগুলোর মধ্যে একটি করে ঝিল্লিময় সূক্ষ্ম অংশ থাকে। বাদক যন্ত্র দু’টি গলার দু’পাশে লাগিয়ে গলার তন্ত্রীতে শ্বাস-প্রশ্বসের আশ্চর্য কৌশলে চাপ দেওয়ার ফলে ঐ ঝিল্লিময় অংশে বায়ুতরঙ্গ আন্দোলিত হয়। এ থেকে সুর সৃষ্টি হয়। এতে সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখানো যায়, কিন্তু বাজানোর কৌশল কষ্টসাধ্য। বর্তমানকালে এই যন্ত্রের বাদক খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ ধরণের কঠিন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলো আফতাবউদ্দিনের। শুধু বাদনে তিনি পটু ছিলেন তা নয়। আফতাবউদ্দিন খান নিজে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র ও উদ্ভাবন করেছিলেন। নিচে এগুলো সম্পর্কে অলোচনা করা হলো।

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ফকির (তাপস) আফতাবউদ্দিন খান

‘স্বর-সংগ্রহ’ এবং ‘মেঘডম্বুর’

স্বর-সংগ্রহ এস্রাজ জাতীয় একটি তত গোত্রের বাদ্যযন্ত্র। স্বর সংগ্রহের দণ্ডটি এস্রাজের মত কিন্তু খোলটি সরোদের মত। খেলটি ফাঁপা এবং এতে চামড়ার ছাউনি দেওয়া থাকে। খোলের সংগে একটি ফাঁপা দণ্ড সংযুক্ত থাকে। দণ্ডের বুকে পটরী আবদ্ধ থাকে। স্বর সংগ্রহের মাথাটি পাখির মত। মাথায় চারটি কাঠের গোল খুঁটি বা বয়লা লাগানো থাকে। পটরীর উপরের দিকে দু’টি তারগহন দণ্ডের সাথে সংযুক্ত।

দণ্ডের পাশে ষোল থেকে কুড়িটি চেপ্টা কাঠের বালা লাগানো থাকে। পটরীর বুকে পিতল বা জার্মান সিলভারের তৈরি বারোটা পর্দা মুগা সুতা দিয়ে দণ্ডের সঙ্গে বাঁধা থাকে। খোলের বুকে আবৃত চামড়ার ছাউনির মাঝখানে একটি হাড়ের সওয়ারি স্থাপিত। খোলের প্রান্তভাগে একটি পিতলের লেঙট সংযুক্ত। স্বর- সংগ্রহের প্রধাণ তার চারটি এবং তরফের তার ষোল থেকে কুড়িটি।

প্রধাণ তারগুলো দণ্ডের মাথায় আবদ্ধ চারটি বয়লা থেকে তারগহন ও সওয়ারির উপর দিয়ে লেঙুটের সাথে আবদ্ধ থাকে। নায়কী তার বা প্রধাণ তারটি লোহার, বাকী তিনটা পিতলের। তরফের তারগুলো দণ্ডের পাশে আবদ্ধ চেষ্টা বয়লা থেকে পটরীর বুকে সংযোজিত কীলকের ভিতর দিয়ে সওয়ারির ছিদ্র দিয়ে লেঙুটে সংযুক্ত। তরফের তারগুলোর জন্য সওয়ারিতে প্রধাণ তারগুলোর নিচে ছিদ্র থাকে। তরফের তাগুলো পিতলের।

ফকির আফতাবউদ্দিন খান উদ্ভাবিত আরেকটি যন্ত্র ‘মেঘডম্বুর’। এটি সহজ সরল তারের যন্ত্র। প্রস্তুত প্রণালীও অতি সাধারণ। প্রায় এক হাত লম্বা ও প্রায় এক ইঞ্চি চওড়া একটি বাঁশের চটার সঙ্গে একটি রোহার তার সংযুক্ত করে মেঘডম্বর যন্ত্রটি তৈরি হয়। বাঁশের চটাটি সুন্দরভাবে মসৃণ করে নেওয়া হয়। চটার মাথা দু’টিতে তার সংযোজনের জন্য কিছুটা কেটে নিতে হয়। যন্ত্রটি দেখতে ধনুকের মত। একটি ছোট ছড় দিয়ে এটি বাজাতে হয়। এর সুর বেশ মিষ্টি।

‘চন্দ্র সারঙ্গ’, ‘কাঠ-তরঙ্গ’, ‘বাঁশ-তরঙ্গ’ এবং ‘নল-তরঙ্গ’

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান

এই যন্ত্রগুলোর আবিষ্কর্তা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। সরোদ যন্ত্রের আধুনিক রূপদানে তাঁর অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর সকল পরিকল্পনার রূপকার ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খান। সরোদ ছঅড়াও আরো কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র আবিস্ক রে তাঁর অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের প্রপৌত্রী সাহানা খান তাঁর “Boro Baba. Ustad Alauddin Khan” গ্রন্থে লিখেছেন,

“Boro Baba gave the Sarode a new form because he realized that in its traditional form it was not suitable for the Dhrupad style Incollaboration with his brother, Ustad Ayet Ali Khan, he made several modifications…He devised and introduced several new instruments, creating the Chandrasarang….. Then he made the Nal Tarang from gun 8 barrels which is played with a piece of iron.”

চন্দ্র সারঙ্গ বাংলাদেশের পল্লী সংগীতে আরেকটি নতুন সংযোজন। সারিন্দা যন্ত্রের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলশ্রুতিতে এই যন্ত্রের উদ্ভব। এক সারিন্দা যন্ত্রের উন্নত সয়স্করণ বলা যেতে পারে। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নিভৃতচারী সংগীত সাধক সফদর হোসেন খানের তৃতীয় পুত্র বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন বার পরামর্শে উপমহাদেশের অন্যতম শেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খান এই যন্ত্র তৈরি করেন।

চন্দ্র সারঙ্গ যন্ত্রটি সারিন্দার চেয়ে বড়। আকৃতি সারিন্দার মত। একটিা নিরেট কাঠের খণ্ডতে খোদাই করে খোল তৈরি করা হয়। খোলের ভিতরটা ফাঁপা। খোলে বুকে টামড়ার ছাউনি লাগানো থাকে। খোলের সঙ্গে দণ্ড সংযুক্ত। দণ্ডের ভিতরটা ফাঁপা। দণ্ডটির বুকে ইস্পাতের পাত বসানো থাকে। একে বলে পটরী। পটরীর উপরের অংশটি জীবজন্তু বা পাখির মাথার আকৃতিতে প্রস্তুত করা হয়। এই অংশে তার সংযোজনের জন্য বয়লা লাগানো হয়। মূল তার তিনটি।

তাছাড়া আরো নয়টি তার অনুরণনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই নয়টি তার দণ্ডের একপাশে আবদ্ধ নয়টি চেপ্টা বয়লার সঙ্গে সংযোজিত থাকে। এই নয়টি তার পিতলের। খোলের উপর স্থাপিত হয় কাঠ বা হাড়ের তৈরি একটি সওয়ারি। খোলের শেষ প্রান্তে একটি লেভুট খোলের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আটকানো হয়।

সব ক’টি তার লেট থেকে টেনে নিয়ে বয়লাতে আটকানো হয়। সুর বাঁধার নিয়ম সারিন্দার মত। সারিন্দার মতই এই যন্ত্র ছড় দিয়ে বাজাতে হয়। চন্দ্র সারঙ্গ এককভাবে বাজানো হয়ে থাকে। প্রয়োজনবোধে পল্লীগানের সঙ্গেও বাজানো যেতে পারে।

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ছাত্রদেরকে চন্দ্রসারঙ্গ দেখাচ্ছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান

‘কাঠ-তরঙ্গ’ নামে আরেকটি বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। শুকনো কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। কাঠ-তরঙ্গ। নিরেট কাঠ কেটে একটি বাক্সে সাজিয়ে রেখে এই যন্ত্র প্রস্তুত করা হয়।

জল তরঙ্গ যন্ত্রে যেমন এক একটি বাটিতে পরিমাণমত পানি ভরে নির্দিষ্ট স্বর উৎপন্ন করা হয়, অনেকটা সেই সূত্র অনুযায়ী এই যজ্ঞে বিভিন্ন মাপের কাঠের খণ্ড কেটে বাক্সে স্থাপন করা হয় যাতে এক একটি কাঠের খণ্ড থেকে এক একটি স্বর উৎপন্ন হয়। কাঠির সাহায্যে এই সব কাঠের খণ্ডের উপরে আঘাত করে কাঠ-তরঙ্গ বাজাতে হয়।

একই ধরণের আরেকটি যন্ত্রের নাম বাঁশ-তরঙ্গ। এর উদ্ভাবকও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। শুকনো মুলি বাঁশ থেকে এই যন্ত্র তৈরি হয়। মুলি বাঁশ চোঙার আকারে কেটে নিতে হয়। চোঙাগুলো এমনভাবে কাটা হয় যেন বাজাবার সময় আঘাত করলে ফেটে না যায়। কণ্ঠ তরঙ্গে যেভাবে নির্দিষ্ট স্বরের প্রয়োন অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাপে কাঠের খণ্ড কেটে নিতে হয়, ঠিক তেমনিভাবে এই যন্ত্রেও এমন মাপে এক একটি বাঁশের চোঙা কেটে নিতে হয় যাতে করে প্রতিটি থেকে নির্দিষ্ট একটি স্বর উৎপন্ন হয়।

‘নল-তরঙ্গ’ একই গোত্রভুক্ত আরেকটি যন্ত্র। মাইহারের রাজদরবারে অবস্থানকালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এই যন্ত্র প্রস্তুত করেন। রাজার সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত বন্দুকের নল নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী কেটে তার সাহায্যে তিনি এই যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রেও বিভিন্ন মাপের লোহার নল কেটে নিয়ে বাক্সে স্থাপন করা হয়। এক একটি নল থেকে এক একটি স্বর উৎপন্ন হয়। এক খণ্ড লোহার সাহায্যে আঘাত করে এই যন্ত্র বাজাতে হয়

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ব্যান্ডে ব্যবহৃত নলতরঙ্গ

মনোহরা’ এবং ‘মন্ত্রনাদ

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ওস্তাদ আয়েত আলী খান

সফদর হোসেন খানের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ, সুরবাহার বাদক এবং বিশিষ্ট বাদ্যয়ন্ত্রনির্মাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খান। তিনি এস্রাজ যন্ত্রটির সংস্কার সাধন করে একটি নতুন যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন এবং এই যন্ত্রের নাম দেন মনোহরা। সুরের মাধুর্যের দ্বার মন হরন করে নেয় বলে এই যন্ত্রের নামকরণ করা হয় ‘মনোহরা’। মনোহরা যন্ত্রটির আকৃতি ও গঠন অনেকটা এস্রাজের মত।

তবে সুরে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং মাধুর্য বৃদ্ধির জন্য এর খোলটির গঠন প্রণালীতে কিছু পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। খোলটি অনেকাটা আমের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। খোলের বুকে চামড়ার ছাউনি দেওয়া থাকে। খোলটি খোদাইয়ের কৌশলে উপরে যন্ত্রটির সুরের উৎকর্ষ নির্ভর করে। খোলের সঙ্গে একটা ফাঁপা দণ্ড সংযুক্ত করা হয়। এর নাম পটরী। পটরীর বুকে এস্রাজের মত ষোলটি পিতলের পর্দা শক্ত মুগা সুতা দিয়ে আটকানো হয়।

পটরীর মাথায় চারটি কাঠের বয়লা দণ্ডের সঙ্গে লাগানো হয়। বয়লার নিচে হাড়ের তৈরি দু’টি তার গহন। দণ্ডের একপাশে একটা কাঠের ফলক লাগিয়ে তাতে বারোটি তরফের তার সংযোজনের জন্য বারোটি চেপ্টা বয়লা লাগানো হয়। খোলে আবদ্ধ চামড়ার ছাউনির উপরে একটি হাড়ের সওয়ারি থাকে। নিচে কিছুটা পিছনের দিকে একটি লেঙুট থাকে। প্রধান চারটি তার প্রধাণ চারটি বয়লা থেকে তারগহন এবং সওয়ারির উপরে আবদ্ধ থাকে।

ঠিক তেমনি তরফের বারাটি তার চেপ্টা বয়লাগুলো থেকে সওয়ারির গায়ে বারোটি ছিদ্র দিয়ে গিয়ে লেঙুটে আবদ্ধ থাকে। এস্রাজের ছড়ের মত ছড় দিয়ে মনোহরা যন্ত্রটি বাজাতে হয়। মন্ত্রনাদ একটি খাদ বা যন্ত্র স্বরের একটি বাদ্যযন্ত্র। এই যন্ত্রটি পাশ্চাত্য চেলো যন্ত্রের অনুকরণে তৈরি হয়েছে। ওস্তাদ আয়েত আয়েত আলী খান এর উদ্ভাবক।

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

পাশ্চাত্য যন্ত্রকে দেশজ ঢঙে তৈরে করে দেশীয় সুরের ঝঙ্কার সৃষ্টির মাধ্যমে সংগীত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তোলাই মন্ত্রনাদ যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য। মন্দ্রনাদের দেহ চেলোর দৈহিক গঠনের মত। বলা যায় বেহালার বৃহৎ সংস্করণ। কাঠ দিয়ে বেহালার মত করে প্রথমে এই অবয়ব তৈরি করতে হয়। ফাঁপা মূল অংশটিকে ‘বেলি’ বলা হয়। ‘বেলি’ বা পেটের সাথে দণ্ডাকৃতির অংশ যুক্ত হয়, যাকে ‘নেক’ বা ঘাড় বলা হয়।

নেকের বুকে পটরী বা ফিংগারবোর্ড সংযোজন করা হয়। এটি সাধারণত কালো রঙের হয়ে থাকে। পটরীর উপরের অংশের কাঠ একটু উঁচু করে দেওয়া হয় যা তারগহনের কাজ করে। নেকের উপরিভাগ একটু বাঁকানো। তার সংযোজনের জন্য নেকের শেষ প্রাপ্ত বা পেগ বক্সে চারটি কাঠের খুঁটি বা বয়লা লাগানো হয়। ‘বেলি’র বুকে কাঠের তৈরি একটি সওয়ারি থাকে। সওয়ারির দু’পাশে শব্দ বের হওয়া জন্য দু’টো ফাঁক থাকে।

একে বলে ‘সাউন্ড হোল। সাউন্ড হোলের পাশে বেলি ও নেকের মধ্যবর্তী অংশে একটি কাঠি সংযোজন করা হয়। একে বলে ‘সাউন্ড স্টিক’। শেষ প্রান্তে তার সংযোজনের জন্য লেংগুট লাগানো হয়।

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ওস্তাদ আয়েত আলী খানকে লেখা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের চিঠি।

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – চিঠিতে অঙ্কিত বাদ্যযন্ত্রের নকশা

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – বিভিন্ন দিক থেকে বাদ্যযন্ত্র দেখতে যেমন হবে তার নকশা

“আমার ইচ্ছা হয় বেসের জন্য বেহালার অনুকরণ না করিয়া আমাদের দেশী যন্ত্র করা যায় কিনা। নীচের দিকটা সারেঙ্গী কিংবা এস্রাজ যন্ত্রের নমুনা রাখিয়া উপরের খাড়াটা চন্দ্রসারংগের মত করিলে কিরূপ হয় চিন্তা করিয়া দেখিবে। নীচটা পাতলা ততা দ্বারা করিতে হইবে, যাতে বড় আওয়াজ হয়। তারপর বেহালার পরিবর্তে এসরাজ। এক হাত দেড়হাত লম্বা। পিয়ালি খাড় মোটা হইবে।

যাতে চড়া স্বর বেহালার মত হয়। এরূপ করিয়া এসরাজ তৈয়ার করিতে হইবে। দ্বিতীয় চন্দ্রসারং হইবে, বেসের জন্য বড় এসরাজ কিম্বা সারেঙ্গী হইবে। এসব তৈয়ার করিবার জন্য একটু চিন্তা কর। আমি তোমার নিকটে আসিয়া এসব চিন্তা করিয়া দেখিব । … … বেসের জন্যই চিন্তা। এ যদি করিয়া দিতে পার তবে আমার ইচ্ছা খোদা পূরণ করিবেন। আমি যাহা কিছু লিখিলাম প্রাণের আবেগে। তুমি চিন্তা করিবে।

তোমার মাথা আছে। প্রথমে ক্ষতি করিলে পরে লাভ হইবে। ছবি আঁকিয়া দিলাম। যে নমুনাটি পছন্দ হয় তাহাই করিতে চেষ্টা করিবে। বেহালার মত পৃথক পৃথক কাঠের দ্বারা উপরে ও নীচে বেহালার মত ততা দিয়া করিতে হইবে। ইহাতে খুব মোটা তার লাগে।

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের লেখা আরেকটি চিঠির অংশবিশেষ

“পুনঃ, শ্রীমান, সারেঙ্গীর চাইতে কিছু লম্বা পৌনে দুই হাত কিংবা দেড় হাত লম্বা পিয়ালা সহ এসরাজ বেহালার মতন চড়া সুরে বাজাইবার জন্য তৈরি কর। পিয়ালা বড় ও চওড়া হইবে। ডাণ্ডাও খুব চওড়া হইবে। ‘জি’ সুরের ‘তারা’ সুরে যেমন প্রথম সুর বাঁধা যায়। আওয়াজ বড় হওয়া চাই। যদি ভাল করিতে পার তবে আমার ব্যাণ্ডের জন্য আটখানা এসরাজ নিব। চন্দ্রসারঙ্গের স্বর আমাদের সাবেকী ধরণের খুব বড় ও বেহালার মত হওয়া চাই।”

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – পরিকল্পিত বাঁশ তরঙ্গ সম্পর্কে লেখা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের চিঠি

“আয়েত আলীকে বলিবে খুব পুরানো শুকনো কাঠ যেন যোগাড় করিয়া রাখে। কাঠের কাঠ-তরঙ্গ’ তৈয়ার করিবার জন্য। তিন চার প্রকারের চিন্তা ঠিক করিয়া রাখিয়াছি। যে কাঠে সুর বাহির হয় এমন কাঠ চাই। খুব মজবুত কাঠের দরকার। খুব পুরানো মুলি বাঁশ যোগাড় করিয়া রাখিবে। মুলি বাঁশের চোঙার দ্বারা ‘বাঁশ-তরঙ্গ’ করিবার জন্য। বাড়ি দিলে যেন না ফাটে এমন বাঁশ চাই।

এই দেশে আসিয়া অনেক যন্ত্র করিবার কতকটা আইডিয়া হইয়াছে। খোদা যদি দেশে ফিরাইয়া নেন তবে কতকগুলো যন্ত্র করিবার ইচ্ছা আছে। অবশ্য তোমরা যদি ভাল মনে কর।

‘সুরশ্রী”

 

বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ও অবদান

চিত্র – ড.মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী

দোতারা জাতীয় তত যন্ত্রের একটি আধুনিক ও পরিমার্জিত রূপ হচ্ছে সুরশ্রী। দোতারা এবং নকুল বীণার সম্মিলনে নতুন এই যন্ত্রটির আবিষ্কর্তা ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। তিনি এর নামকরণ করেছেন সুরশ্রী। প্রাচীন ভারতে দুই তার বিশিষ্ট এক ধরণের বীণা ছিল, যার নাম নকুল বীণা। এই যন্ত্রের প্রভাব বজায় রেখে বাংলাদেশের অত্যন্ত পরিচিত একটি লোকজ বাদ্যযন্ত্র দোতারার পরিমার্জিত নতুন একটি সংস্করণ আবিস্কার করেছেন ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী।

যন্ত্রটি দোতারার মত ছোট আকারের হলেও আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যে অনেকটা নকুল বীণার মত। যন্ত্রের মূল অংশটি কাঁঠাল কাঠের তৈরি একটি শব্দ প্রকোষ্ঠ। এর সঙ্গে যুক্ত নাতিদীর্ঘ ফিংগারবোর্ড। ফিংগারবোর্ডে ধাতব পাত লাগানো থাকে। এর শেষ অংশে পেগবন্ধ যা দেখতে দোতারার মতই। যন্ত্রে চারটি স্টিলের তার ব্যবহৃত হয়। তারগুলো যথাক্রমে মস, প এবং র স্বরে বাঁধা হয়।

ডান হাতে জওয়ার সাহায্যে তারে আঘাত করে এই যন্ত্র বাজাতে হয়। যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এতে দোতারার কাটা কাটা স্বরের পরিবর্তে টানা এবং সুরেলা শব্দ উৎপন্ন হয়। যার ফলে এতে শুধু লোক সংগীত নয় বরং রবীন্দ্র সংগীত, আধুনিক গান, উচ্চাঙ্গ সংগীত ইত্যাদি সব ধরণের সুর পরিবেশন করা যায়। সংগীত শিল্পী এবং সংগীত গবেষক ড. মৃদুলাকন্তি চক্রবর্তীর জন্ম সুনামগঞ্জে, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।

১৯৭২ সাল থেকে বেতারে তিনি নিয়মিত রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করতে শুরু করেন। বিশ্বভারতী’ থেকে “বাংলা সংগীতের ধারা ও লোকসংগীতের সুরে রবীন্দ্র সংগীত” বিষয়ে গবেষণা করে পি.এইচ.ডি লাভ করেন ১৯৯৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগ স্থাপনে তাঁর ব্যাপক অবদান। বর্তমানে তিনি এই বিভাগে অধ্যাপনায় নিয়োজিত রয়েছেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment