আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সংগীতে স্বদেশচেতনার পটভূমিকা
সংগীতে স্বদেশচেতনার পটভূমিকা
সংগীতে স্বদেশচেতনার পটভূমিকা
বাংলা স্বদেশি গানের মর্মমূলে রয়েছে পরাধীনতারবোধ। বাংলা সাহিত্যে ও সংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বদেশ প্রসঙ্গটি বিকাশলাভ করে। চর্যাপদ থেকে রামপ্রসাদের গানের যুগে অর্থাৎ প্রায় সাতশ বছরের ইতিহাসে স্বদেশ বিষয়ক কোনো গান বা কবিতা রচিত হয়নি। ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বন্ধনই ছিলো তাদের রচনার উৎস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজদের আগমনের পরেই স্বদেশ নিয়ে সচেতনতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ হয়।
ইংরেজদের শোষণমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরাধীনতাবোধের সম্মিলনে জনমনে দেশপ্রেমবোধ দানা বাঁধতে থাকে। সামাজিক হীনমন্যতা ও বেদনার উপলব্ধি থেকে জাগ্রত হয় স্বজাতির সকল মহত্তর বিষয়ের প্রতি গর্ববোধ ও দেশের তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়ের জন্য মায়ার অনুভূতি।
স্বদেশপ্রেম বিষয়ক সাহিত্য আত্মপ্রকাশের প্রধান দুটি কারণ হিসেবে বলা যায়, নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠা ও সেই লক্ষ্যে সমাজকে সচেতন করা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য মানসিক প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়া। স্বদেশপ্রেম বিষয়ক গানের রয়েছে দুটি ধারা। এক ধারার স্বদেশীয় গানে থাকে স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ, অন্য ধারাতে থাকে স্বদেশের জন্য এর বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে জনমনকে শুদ্ধ করা, অনুপ্রাণিত বা আন্দোলিত করা।
এ বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ইংরেজ সাহিত্যের প্রতি বিশেষত মুর, বায়রন, ক্যাম্বেল প্রমুখের লেখনির প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করতো এদেশের শিক্ষিত সমাজের। এদের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই অনুকরণ করতেন। যেমন রঙ্গলাল, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্রসহ আরো জগৎখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ্য।
যেমন মাইকেল মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রেও ইংরেজ কবিদের উক্তি বাংলা ভাষায় অনুবাদের উদাহরণ মেলে। এসব উল্লেখের উদ্দেশ্য হলো ইংরেজ কবিদের লেখায় তথা ইউরোপীয় সাহিত্যে স্বদেশপ্রেমমূলক রচনার বিকাশ ছিলো বহু আগে থেকেই এবং সেই সকল রচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে এর অনুপ্রবেশ ঘটে।
স্বদেশের কীর্তিবিষয়ক রচনা, বিজয়গাঁথা ও প্রকৃতির আরাধনার বিষয় স্থান করে নেয় বাংলা সাহিত্য ও গানে। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে স্বদেশচেতনা বিকাশে এসব রচনার সূত্রপাতের একটি পরোক্ষ কারণ হতে পারে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক থেকে মূলত দেশপ্রেম নিয়ে গান রচনা শুরু হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপট ও এর গতি পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বদেশপ্রেমমূলক গানের রূপ বদলাতে থাকে।
দেশের মানুষের বিপন্নতা, হীনমন্যতা, সর্বোপরি পরাধীনতার বোধ স্বদেশি গান রচনার মূল অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়। ইংরেজ শাসক কর্তৃক শাসিত বাঙালির দেশাত্মবোধের বেদনা থেকে রচিত হতে থাকে স্বদেশপ্রেমের গান। পরাধীন জাতির এই হতাশা মূলত অনুভূত হতে শুরু করে পলাশী যুদ্ধের সময়কাল থেকেই।
ভারতবাসীর উপর আধিপত্য বিস্তারে ইংরেজরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং তাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ, বাণিজ্য ঘাটি স্থাপনে নানা কুটিলতার মাধমে অর্থশক্তি বৃদ্ধি যেভাবে অগ্রসর হতে থাকে; ততই বাড়তে থাকে বাঙালির দুঃখ-কষ্ট, অপমান ও বহুবিধ পন্থায় অত্যাচারের নমুনা। যে কারণে কেবল দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ইংরেজকে আরও বহুকাল সহা করে যাওয়াটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
ইতোমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের অবনতি বাঙালির আশাভঙ্গের ও চরম ক্ষোভের কারণ হয়ে ওঠে যা শিক্ষিত বাঙালির মনে চরমভাবে আঘাত হানে। শাসক হিসেবে বাঙালি ইংরেজকে আর চায় না। শুরু হয় পরাধীনতার অপমান থেকে নিজেদের মুক্তির অভিপ্রায়ে সকলকে একাত্ম করা ও জাগ্রত করবার নানা পথের সন্ধান।
চলতে থাকে স্বদেশি গান, কবিতা রচনা ও সর্বত্র স্বদেশপ্রেম জাগ্রতকরণের লক্ষ্যে এবং দেশের প্রতি অধিক মনোযোগী করে তোলার অভিপ্রায়ে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার তৎপরতা। সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে বাঙালি যেভাবে সংঘবন্ধ হয়ে প্রতিবাদে লিপ্ত হয়, প্রতিবাদে ও বাংলা প্রসারে মনোযোগী হয় তাতে সময়টাকে বাংলা রেনেসাঁ বলা যেতে পারে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঙালি চিত্তকে জাগ্রতকরণে সময়টি ছিলো অত্যন্ত সহায়ক।
এ ক্ষেত্রে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য-
“১৮৫৬ হইতে ১৮৬১ অব্দ পর্যন্ত এই কাল বঙ্গসমাজের পক্ষে মাহেন্দ্রক্ষণ বলিলে হয়। এই কালের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথে ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলন, নীলচাষের প্রসার ও তদ্বিষয়ে হাঙ্গামা ও হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাটরিয়টে’ প্রতিবাদ, বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্র হইতে ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তিরোভাব ও মধুসূদনের আবির্ভাব,
‘সোমপ্রকাশ’ নামক পত্রিকার অভ্যুদয়, দেশীয় নাট্যশালা স্থাপন ও হিন্দুসমাজের মধ্যে রক্ষণশীলদলের জাগরণ এবং ধর্ম ও সমাজ সংরক্ষণের প্রয়াস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পাশ্চাত্যশিক্ষার দ্রুত ব্যাপ্তি, ইনডিয়ান কাউন্সিল একট পাশ ও কলকাতায় হাইকোর্ট স্থাপন প্রভৃতি ঘটনাগুলি ঘটিয়াছিল। ইহার প্রত্যেকটি বঙ্গ সমাজকে এমন প্রবলভাবে আলোড়িত করিয়াছিল যে, প্রত্যেকটি বিষয়ে পৃথক ইতিহাস গভীরভাবে আলোচনার বিষয় হতে পারে।ইহাকে আমরা বলিব বাংলাদেশের রেনাসাস। “
এ উক্তির মধ্যদিয়ে পরাধীনতার মুক্তি পেতে বাঙালি শিক্ষিত সমাজ যে জেগে উঠেছিল তার উদাহরণ মেলে। দেশবাসী দেশাত্মবোধের দিকে প্রসারিত হতে থাকে, তেমনি দেশের ভাষার প্রতিও অনুরাগী। হয়ে ওঠে। মাতৃভাষার জন্য রচিত হয় গান, যার দ্বারা হয় ইতিহাসের প্রথম স্বদেশি গানের সূচনা। নিধুবাবুর রচিত সেই নবজাগরণের চেতনাবাহী গান-
“নানান দেশে নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা
কত নদী সরোবর, কিবা ফল চাতকীর
ধারা জল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা
প্রায় একই সময় বিশেষত মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ রচিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ‘স্বদেশ’ ও ‘মাতৃভাষা’। মাইকেল মধুসূদনের ‘বঙ্গভাষা’ রচিত হয় ১৮৬১ সালে এবং ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ রচিত হয় ১৮৬২ সালে। স্বদেশ বিষয়ক লেখনিতে বাংলা সাহিত্যের পটভূমি গড়তে শুরু করে।
স্বদেশের প্রতি উচ্ছ্বাস ও স্বদেশবন্দনার প্রকাশ পেতে থাকে বহু কাব্য ও গদ্য রচনার মধ্যদিয়ে। সেই সময় অর্থাৎ ১৮৬৭ সালে যে সংগঠনটিকে ঘিরে স্বদেশি গান রচনার জোয়ার শুরু হয় তা হলো “হিন্দুমেলা’। এবিষয়ে সৌমেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরা আবশ্যক-
“উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জনচিত্তে দেশানুরাগ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় বাঙালি এক নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন। সভা-সমিতির আলোচনায় আর সাহিত্যের মধ্যে এতদিনে যে প্রচেষ্টা গণ্ডিবদ্ধ ছিলো তা বহুমুখী আর ব্যাপকরূপে লাভ করল ‘চিত্রমেলা’ বা ‘হিন্দুমেলা’র প্রবর্তনে। ”
এক্ষেত্রে উল্লেখ প্রয়োজন যে, হিন্দুমেলার পূর্বেই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি অনেকটা অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। যেখানে স্বদেশপ্রীতিমূলক আনন্দ-বেদনার উচ্ছ্বাসসহ জাতিগত সম্প্রীতি ও স্বদেশবন্দনার দিক-নির্দেশনা প্রকাশ পায়। যেমন ১৮৫৮ সালে রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান, ১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য এবং ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বীরবাহু’ প্রভৃতি কাব্যে স্বদেশপ্রীতি ব্যক্ত হয়।
এ সকল অনুপ্রেরণাই মূলত হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার তাগিদ সৃষ্টি করে যেখানে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা প্রতিহত করতে দেশের শিক্ষিত বাঙালি একত্রিত হয় এবং স্বদেশের স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষায় স্বদেশের উন্নতিকরণে স্বাবলম্বী হওয়ার আবশ্যকতা অনুভূত হয়। বিশেষত স্বদেশের উন্নতি নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে স্বজাতির সকলের মধ্যে সাম্যতা ও সদ্ভাব গড়ে তোলা ছিলো ‘হিন্দুমেলার মূল উদ্দেশ্য।
অর্থাৎ বাঙালিমনে জাতীয়তাবোধ স্থাপন করাই ‘হিন্দুমেলা’র প্রধান লক্ষ্য ছিলো। হিন্দুমেলার উদ্যোক্তাদের এই লক্ষ্যটির প্রতিফলন হিসেবেই এর বিশ বছর পরে কংগ্রেসের আবির্ভাব। প্রাক হিন্দুমেলাপর্বে স্বদেশবোধের যে বীজ বপিত হয়েছিল তারই বিকাশ লাভ ঘটে হিন্দুমেলার পর্বে। অতীত গৌরবের স্তুতিগাঁথা, কর্ম ও চিন্তায় স্বদেশপ্রীতিবোধ জাগ্রতকরণ সর্বোপরি জাতীয়তাবোধের প্রকাশ হিন্দুমেলা যুগে রচিত স্বদেশি গানের প্রধান উপজীব্য।
সময়ের সাথে সাথে এই মেলা ও এর কর্মের পরিব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। এই মেলা প্রসঙ্গে যোগেন্দ্রচন্দ্র বাগলের উক্তি, আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, কোনো বিষয়সুখের জন্য নহে, কেবল আমোদ-প্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য, ইহা ভারত ভূমির জন্য।” হিন্দুমেলার বিভিন্ন অধিবেশনের মধ্যদিয়ে দেশীয় শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতচর্চায় যেমন উৎসাহ প্রদান করা হতো, তেমনি কৃষিকাজ থেকে শুরু করে দৈহিক শক্তিচর্চা বিষয়েও দেশবাসীকে সচেতন করতে শুরু করেছিল।
শুধু তাই নয় দেশের অর্থনৈতিক দৈন্য-দুর্দশার কথা ও এর প্রতিকারের পন্থা বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করা হয় হিন্দুমেলাতেই। দেশীয় শিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথাও এই মেলাতেই প্রথম ব্যক্ত হয়। জাতীয় ঐক্যের বিষয়টিকে মূল করে এরা অগ্রসর হতে থাকে।
হিন্দুমেলা যুগে (১৮৬৭-১৮৮০) এই সকল আদর্শ বা ভাবনা ব্যক্ত করা হতো গানের মাধ্যমে। হিন্দুমেলার বিভিন্ন অধিবেশন উপলক্ষে কত গান রচিত হয়েছে, তা নিরূপণ করা কঠিন, এমনকি অনেক গানেই রচয়িতার নাম না থাকায় গীতিকাব্যের নাম নিরূপণ করাও অসম্ভব ছিলো। এই সকল গানের মধ্যদিয়ে বিশেষত স্বদেশি সাহিত্যচর্চায় হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য ও স্বদেশিবোধকে প্রকাশ করা হতো।
সর্বপ্রথম ‘জাতীয় সংগীত’ রচনা মূলত হিন্দুমেলাতেই হয়। এই সময়ে রচিত হয় সত্যেন্দ্রনাথের “মিলে সব ভারত সন্তান’ এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি” স্বদেশি গান। মুখে মুখে এই গান দুটি গীত হতো এবং হিন্দুমেলা যুগের পরেও যেকোনো জাতীয়তাবোধ বা ঐক্যের আহ্বানের ডাক আসলেই সমস্বরে এই সকল গান গাওয়া হতো।
স্বদেশপর্বের এই দুটি গান সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘এই হল আমাদের আমলের সকাল হবার পূর্বেকার সুর, যেন সূর্যোদয় হবার আগে ভোরের পাখি ডেকে উঠল। আমরাও ছেলেবেলায় এই সকল গান খুব গাইতুম।
ড. সীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতে স্বদেশচেতনা গ্রন্থে উল্লেখ পাই যে, জাতীয় সংগীত রচয়িতা হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং হিন্দুমেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে খ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গাও ভারতের জয়’ গানটি যা হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে গীত হয়
“মিলে সব ভারত সন্তান
এক তান মনঃপ্রাণ
গাও ভারতের যশগান”
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই গানটি এতটাই আলোচিত ও সকলের প্রশংসিত ছিলো যে, এই গানকে অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় সংগীত বলে দাবি করেন। বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর ‘বঙ্গদর্শনে’ এই গানটির বহুল প্রশংসা করেন। তিনি বলেন-‘এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক। গঙ্গা যমুনা সিন্ধু নর্মদা গোদাবরীতটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক! এই বিংশতিকোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক।
বঙ্কিমযুগের রচিত স্বদেশপ্রেমের গানে স্বদেশকে মাতৃরূপে কল্পনার ধারাটি পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালের গীতিকবি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেনসহ অন্যান্য অনেক গীতিকবিই স্বদেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন।
হিন্দুমেলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে এর বাস্তবরূপ দান এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা সবটাই ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের অবদান। তবে জাতীয় মেলা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগীদের মধ্যে নব গোপাল মিত্র মহাশয় প্রথম ও প্রধান হিসেবেই গণ্য ছিলেন। রাজনারায়ণ বসু এ বিষয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন-
“শ্রীযুক্তবাবু নবগোপাল মিত্র মহোদয় আমার প্রণীত ‘জাতীয় গৌরবোচ্ছা সঞ্চারিণী সভার অনুষ্ঠান পত্র পাঠ করাতে হিন্দমেলার ভাব তাঁহার মনে প্রথম উদিত হয়। ইহা তিনি আমার নিকট স্পষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। ঐ হিন্দুমেলা সংস্থাপনের পর উহার অধ্যক্ষতা করিবার জন্য মিত্র মহাশয় জাতীয় সভা সংস্থাপন করেন। উহা আমার প্রস্তাবিত ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভার আদর্শে গঠিত হইয়াছিল।
প্রথম যে বৎসর (১৮৬৭ সাল) হিন্দুমেলা হয় আমি মস্তকের পীড়ার জন্য মেদিনীপুর হইতে ছুটা লইয়া বোড়ালে অবস্থিতি করিতেছিলাম। বলাবাহুল্য হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরবাড়ির পাশাপাশি অন্যান্য খ্যাত-অখ্যাত কবি স্বদেশি সংগীত
রচনায় ব্রতী হন-
“হিন্দুমেলা থেকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের (১৯০৫) পূর্ব পর্যন্ত স্বদেশি সংগীত রচয়িতাদের নামের তালিকা দেওয়া যেতে পারে, নরকান্ত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ভারতীয় সংগীত মুক্তাবলী’ (১৮৯৩ খ্রি. ১৩০০ ব. ৩য় সং) বইটি থেকে। ‘সংগীত মুক্তাবলী’তে প্রকাশিত স্বদেশ সংগীতগুলির পর্যায় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এতে মূল বিভাগ দু’টি উদ্দীপনামূলক ও ‘সূচনা-সূচক’।
এছাড়া মুদ্রা শাসন আইন, জন্মভূমি, বঙ্গভাষা, দিল্লী দরবার, নব্য বঙ্গের প্রতি ভিক্টোরিয়ার প্রতি, জাতীয় মহাসমিতি ইত্যাদি বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনাকে ভিত্তি করে বিভিন্ন সংগীত রচয়িতাগণ স্বদেশ সংগীত রচনা করেছেন। প্রায় ত্রিশজন স্বদেশ সংগীত রচয়িতার নাম নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থে সংকলিত হয়। এঁদের মধ্যে ঠাকুর পরিবারসহ বাইরের খ্যাত অন্যান্য কবিদের নামও রয়েছে।
যেমন ঠাকুর পরিবার থেকে রয়েছে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও রয়েছে কালীপ্রসন্ন ঘোষ, শিবনাথ শাস্ত্রী, রাধানাথ মিত্র, কালীচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ রায়, মনোমোহন বসু, দ্বারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র বসু, শীতলকান্ত চট্টোপাধ্যায়,
বিষ্ণুরাম চট্টোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্নচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বেদারনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ দাস, গোবিন্দচন্দ্র রায়, আনন্দচন্দ্র মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বীননাথ ধর, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অবিনাশচন্দ্র মিত্র, জগদীশ্বর সেন, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সুরেন্দ্রচন্দ্র বসু এবং কামিনী রায়। এছাড়াও ‘ভারতীয় সংগীত মুক্তাবলী’ গ্রন্থে আরো কয়েকজন অজ্ঞাত কবির স্বদেশ সংগীতের সন্ধান পাওয়া যায়।
১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় জাতীয়তাবোধে স্বদেশপ্রীতির এক নতুন অধ্যায়। সংঘবদ্ধতা, স্বদেশব্রত ও ঐক্যের আদর্শের সাথে পরাধীনতার বেদনাবোধ থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় বুদ্ধিজীবীদের সহমর্মিতা পেতে শুরু করে কংগ্রেস। কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনকে কেন্দ্র করে অনেক দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়।
দেশের শাসন ব্যবস্থায় দেশবাসীর অধিকার লাভের আশায় জাতীয়তাবোধের বিবর্তনের ধারায় রাজনৈতিক অধিকারবোধ যুক্ত হতে থাকে, যার ফলশ্রুতি মূলত কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা লাভ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য উক্তি- “দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং দেশের শাসন সম্পর্কিত চিন্তা যখন জেগে উঠছে, সেই সময়কার (১৮৮৩) দুটি ঘটনা ইলবার্ট বিল নিয়ে আন্দোলন ও সুরেন্দ্রনাথের কারাদণ্ড যা দেশবাসীকে আরও গভীরভাবে রাজনীতি সচেতন হতে সহায়তা করে।
ছাত্রসমাজ দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন হয়ে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করলে দেশব্যাপী এক উত্তপ্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা এই কারণে অনুভূত হয়। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের বীজ থেকে জাতীয় কংগ্রেস পত্রে সুশোভিত, বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করে।
ঐক্যতার আদর্শকে মূল করে দেশের সকল মানুষকে দেশপ্রীতির ব্রতে সম্মিলিত হবার আহ্বানে অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন (১৮৮৬); তারই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটি রচিত হয়। হিন্দুমেলা এবং বঙ্কিমযুগের স্বদেশপ্রেমবোধটি দেশের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কংগ্রেসের যুগে এসে তা বিস্তৃতি লাভ করে।
অর্থাৎ স্বদেশপ্রেম বোধটি কেবল মুষ্টিমেয় শিক্ষিতজনের চিন্তার বিষয় না থেকে তা দেশের গণমানুষের মধ্যে বিস্তারলাভ করতে থাকে। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতির বিষয়টি স্থান পায় দেশপ্রেমের ভাবনায় যা বঙ্কিমযুগে বা তাঁর পূর্বে প্রায় অসম্ভব ছিলো।
কংগ্রেসের সম্মেলন শুরু হতো ‘বন্দে মাতরম’ গান দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘অয়ি ভুবনমোহিনী’, ‘জনগণমন অধিনায়ক হে’, ‘দেশ দেশ নন্দিত করি’ গানসমূহ কংগ্রেসের সভায় গাওয়া হতো।
হিন্দুমেলা ও বঙ্কিমযুগে স্বদেশপ্রেম চেতনার যে ধারাটি প্রতিষ্ঠা ও অগ্রসর হয় তা কংগ্রেসের সময় আরও কিছুদূর এগিয়ে যায় এবং কংগ্রেসের প্রস্তাবে তা ফল্গুধারার ন্যায় জেগে ওঠে। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশপ্রেমের গান বাংলার উৎসমুখ আবেগের জোয়ারে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
স্বদেশপ্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসে ১৯০৫ সালে বিদেশি পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেওয়া বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলনের বহুবিধ ভাবনা প্রকাশের পথ পায়, এ সময়ে রচিত স্বদেশপ্রেমের গানগুলোতে। তবে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গান এ সময়ের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের পর বেশকিছু দেশাত্মবোধের গান রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রেমের গান রচনায় শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন ছিলেন।
এ ধারায় আরেকজন গীতিকবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গান রচনা করে জনমনে স্থান করে নেন। অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মুকুন্দ দাসসহ অনেকেই স্বদেশভাবনার ও স্বদেশচেতনা সমৃদ্ধ গান রচনা করেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে। রবীন্দ্রনাথের দেশবন্দনার গানে পাই যেমন দেশের প্রতি মমতা ও গৌরববোধ তেমনি তা স্বদেশের ভিতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমেরও প্রকাশ।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গান কোলাহলবর্জিত শান্তির আধার, গভীর ও মর্মস্পর্শী। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের গানের মধ্যে তিনি বিচিত্র ধারার সমন্বয় করেছেন, কখনো দেশের প্রকৃতি বন্দনা, কখনো দেশকে মাতৃরূপে দর্শন, আবার কখনো জাতীয় আন্দোলনের প্রেরণাদায়ী একলা চলার আহ্বান। তিনি মূলত দেশের গানের মধ্যে কর্মের আদর্শকে তুলে ধরেছেন। আত্মবিশ্বাস ও নিষ্ঠা দিয়ে দুর্জয়কে জয় করবার বাসনা ব্যক্ত করেছেন তাঁর স্বদেশপর্বের গানে। যেমন-
“বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিসনে ভাই।
শুধু তুই ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষ্মী ঠেলিসনে ভাই ”
রবীন্দ্রসমসাময়িক যে সকল গীতিকবি স্বদেশের গান রচনা করেছেন তাদের গানে রবীন্দ্রপ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গানের বাণী ও সুর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই অনুকরণপ্রিয়তা বা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন-রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির ভাবগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় ডি. এল. রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটিতে। আবার ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি গানটির আদর্শ খুঁজে পাওয়া যায় অতুলপ্রসাদের ‘হও ধর্মেতে ধীর, কর্মেতে বীর’ গানটিতে।
রবীন্দ্রনাথ মোট ৪৬টি স্বদেশপর্বের গান রচনা করেন, যা গীতবিতানের ‘স্বদেশ’ নামক পর্বে অন্তর্ভুক্ত আছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশপর্বের গানের সংখ্যা ১৯টি। এই সকল স্বদেশি গানে নিজস্ব ভঙ্গিমায় স্বদেশের স্তুতি বন্দনা ও মহিমার জয়গান গেয়েছেন। মূলত দেশের অতীত গৌরবকে তিনি গানের ভিতর দিয়ে চেতনায় আঘাত করতে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন অতি সচেতনে। রজনীকান্ত সেনের গানের মূল বৈশিষ্ট্য কাতরতা।
তাঁর স্বদেশপর্বের গান স্বদেশের দুঃখ-দুর্দশায় মৃয়মান। এই দুর্দশা প্রতিকারের পন্থা তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর গানে। যেমন তাঁর মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি একটি কালোত্তীর্ণ গান। এছাড়াও ‘তাই ভালো মোদের মায়ের ঘরের শুধু ভাত গানটি অত্যন্ত বাস্তবতা নিরূপণকারী গান। রজনীকান্ত সেনের ১৬টি গানে স্বদেশানুভূতি পরিলক্ষিত হয়, যেখানে অতি সাধারণ সাদামাটা সুরে ও বাণীর বাস্তবতায় নিজস্ব ধারায় তিনি সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
অতুলপ্রসাদ সেন মাত্র ১৩টি স্বদেশপর্বের গান রচনা করেছেন। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনার সাথে তাঁর স্বদেশপর্বের গানে চেতনা হয়ে ফুটে। “ওঠে অতীত, বর্তমানসহ ভবিষ্যতের আশার সুর। তাঁর ‘ওঠ গো ভারতলক্ষ্মী’, ‘বল বল বল সবে’ প্রভৃতি গানের ভিতর দিয়ে দেশের অস্তিত্বের উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন আপন স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। রচনা করেছেন মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের গান।
এই সকল কবির গান রবীন্দ্রসমসাময়িক হবার কারণে নানাভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব পরিলক্ষিত হলেও প্রত্যেকে সুর ও বাণীর সমন্বয়ে স্বতন্ত্র। স্বদেশপর্বের গানের ক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম ধারাটি নিয়ে হঠাৎ ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হন কাজী নজরুল ইসলাম। তির্যকভঙ্গিতে ছুঁড়ে দেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ (১৯২৬)।
“দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে
লংঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার ॥
স্বদেশভাবনার এই গানটি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্য কবি নজরুল লিখেছিলেন। তাঁর গানে ফুটে ওঠে স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ উচ্চারণে শাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লব আর বিদ্রোহের ডাক। অসহযোগ আন্দোলনকালে কেবল স্বদেশের গান বা কবিতাই রচনা করেননি, সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে তিনি কারাবরণ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের যুগে স্বদেশিযুগের স্বদেশ তপস্যা আরও ব্যাপকতা ও দৃঢ়তা লাভ করে।
স্বদেশি আন্দোলনের বিবর্তনের পথ বেয়ে একই সোপানে পরিণত হয় অসহযোগ আন্দোলন। মূলত কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অর্থাৎ ১৮৮৫ সাল থেকেই যে নিয়মতান্ত্রিক আইনভিত্তিক আন্দোলন চলমান ছিলো তাতে আশার আলো দেখতে পায়নি বলেই গণআন্দোলনের পথ বেছে নেয়া হয়েছিল। স্বাদেশিকতার এ ক্ষেত্রে সূর্যবীরের মতো আবির্ভূত হলেন মহাত্মা গান্ধী।
তবে স্বদেশসংগীত রচনার ক্ষেত্রে এই সময়টি ছিলো ভাটাকাল। মূলত বঙ্গভঙ্গপর্বে রচিত গানই গীত হতো এই সময়টাতে সর্বত্র। কারণ স্বদেশি গান রচনার গীতিকবিদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯১৩ সালে মারা যান এবং রজনীকান্ত সেন ১৯১০ সালে। অতুলপ্রসাদও অন্যধারার গান রচনায় বেশি মনোযোগী ছিলেন।
আর রবীন্দ্রনাথের যে সরব উপস্থিতি ছিলো বঙ্গভঙ্গের পরবর্তী কিছুকাল পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের শুরুর কাল থেকে তা একেবারেই থেমে যায়। এই যুগে তিনি কোনো স্বদেশপর্বের গান রচনা করেননি। বস্তুত অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করলেও ভাবের বিচারে তা গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। তেমনি প্রবীণ গীতিকারের প্রায় সবাই এই পথ থেকে দূরে সরে যান।
রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধীর ভাবনার আদর্শগত ব্যবধান মূলত রবীন্দ্রনাথের স্বদেশসংগীত রচনার নীরবতার কারণ। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার কবি। স্বদেশের মুক্তি আর স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, বিদেশি কাপড় ‘অপবিত্র’। তাই গান্ধীজী কর্তৃক বিদেশি কাপড় পুড়িয়ে ফেলার নীতিকে তিনি যেমন মেনে নিতে পারেননি, তেমনি এক বছরের মধ্যে চরকা কেটে সুতা তৈরি করলে স্বরাজ লাভ হবে-
এই উক্তি বা যুক্তিকেও মেনে নিতে পারেননি বলে অসহযোগ আন্দোলনের সকল কর্ম ও ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, অসহযোগ আন্দোলন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশাল হলেও দেশপ্রেমবোধটি সংকীর্ণ সীমায় বন্দী হয়ে যায় বিধায় এই ভাবনার সাথে তিনি একাত্ম হতে পারেননি। ফলশ্রুতিতে জাতি আরও বহু স্বদেশপর্বের গান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।
তবে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বিপ্লবীদের কর্মের প্রেরণার উৎস হয়েছিলো। যেমন ‘সার্থক জনম আমার’, ‘যদি তোর ডাক শুনে আর’, ‘অমল ধবল পালে’ প্রভৃতি গান বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করতো। নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি বিপ্লবীদের কাছে অতি প্রিয় একটি গান হয়ে ওঠে। এছাড়াও ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গানে তারা জীবনের ছন্দ খুঁজে পাওয়া যেত স্বদেশবোধের নতুন আঙ্গিকে।
নজরুলের গানের উন্মাদনা জনমানসকে উদ্দীপ্ত করতো এবং হিন্দুমেলা থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলনের যুগ পর্যন্ত রচিত বহু স্বদেশি গান আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে দেশপ্রেমী প্রতিটি মানুষের কাছে। বিশেষ সময়ে রচিত হলেও বাঙালির গৌরব অর্জনে যুগের পর যুগ এই গান উদ্দীপনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
সে সময়ের স্বদেশচেতনা এ কালের স্বদেশ ভাবনাকে প্রভাবিত করে। এ গবেষণায় স্বদেশি গান রচনার মহাপুরুষ রবীন্দ্র-নজরুলসহ ডি. এল. রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেনের কর্মজীবন, স্বদেশপ্রেম, স্বদেশ চেতনার গান বিষয়ক বিশদ পর্যালোচনার মাধ্যমে নতুন তথ্য আবিষ্কারে ব্রতি হবো।
আরও দেখুন :