সংস্কৃতি

সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়।

সংস্কৃতি (বা কৃষ্টি) হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অন্তর্গত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের দ্বারা অর্জিত অন্য যেকোনো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস।ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো কিছু বুনিয়াদি অনুমান, মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির, বিশ্বাস, নীতিমালা, প্রক্রিয়া এবং আচরণিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি–যা এক দল মানুষ ভাগ করে নেয় এবং সেই সমষ্টি দলের প্রত্যেক সদস্যের আচরণকে এবং তার নিকট অন্য সদস্যের আচরণের ‘অর্থ’ বা সংজ্ঞায়নকে প্রভাবিত করে (কিন্তু নির্ধারিত করে না)।

 

সংস্কৃতি

সংস্কৃতি

সংস্কৃতি শব্দটা এসেছে মারাঠা থেকে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলায় কালচার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটা প্রস্তাব করলে করলে রবীন্দ্রনাথ এর অনুমোদন দেন। এর আগে বাংলায় কৃষ্টি শব্দটি চালু ছিলো কালচার অর্থে। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্টি শব্দটা মনে করতেন, কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত, সুতরাং কালচার অর্থে সংস্কৃতিই উপযুক্ত।

শব্দতত্ত্ব :

সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়।

বর্ণনা :

সংস্কৃতিকে নৃবিজ্ঞানের একটি প্রধান ধারণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেসব ঘটমান বিষয় একে ঘিরে আছে তা সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের সমাজে প্রবাহিত হয়। সংস্কৃতির সার্বজনীন উপাদান সকল মানব সমাজে দেখা যায়; এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত রূপ যেমন: শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, অনুষ্ঠান, ধর্ম এবং প্রযুক্তি যেমন: যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রান্না করা, ঘর, বাড়ি এবং কাপড় চোপড়। বস্তুগত সংস্কৃতি এর মধ্যে সংস্কৃতির কায়িক বা ভৌত রূপ রয়েছে যেমন: প্রযুক্তি, স্থাপত্য ও শিল্প রয়েছে অপর পক্ষে অবস্তুগত দিক থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম নীতি (রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুশীলন রয়েছে), পুরাণ, দর্শন, সাহিত্য, (লিখিত এবং মৌখিক), এবং বিজ্ঞান নিয়ে একটি সমাজের অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গঠিত হয়।

মানবিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সংস্কৃতির একটি মানে হলো কোন একক ব্যক্তির শিল্প, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ভদ্রতায় নির্দিষ্ট মাত্রায় সূক্ষতা অর্জন। সাংস্কৃতিক সূক্ষতার মাত্রা কখনো কখনো সভ্যতাগুলো থেকে কম জটিল সমাজগুলোকে পার্থক্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই উঁচু নিচু ক্রমানুসারে সমাজ সাজানোর বিষয়টি সাংস্কৃতিক পুঁজিতে কার কতোটুকু অধিকার আছে তার ভিত্তিতে অভিজাতদের জন্য উঁচু সংস্কৃতি এবং নিচু শ্রেণীর জন্য নিচু সংস্কৃতি, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, বা লোক সংস্কৃতি এই শ্রেণী ভিত্তিক পার্থক্যে খুঁজে পাওয়া যায়। গণ সংস্কৃতি বিংশ শতাব্দীতে গণের দ্বারা উৎপাদিত ভোগবাদী সংস্কৃতি’র গণমাধ্যমে প্রচারিত রূপকে নির্দেশ করে। কিছু দর্শন যেমন: মার্ক্সীয় দর্শন বা ক্রিটিক্যাল থিউরি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সংস্কৃতি কখনো কখনো নিচু শ্রেণীর লোকদের কাজে লাগানোর জন্য বা মিথ্যা সচেতনতা তৈরির জন্য অভিজাতদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কালচারাল স্টাডিজ এ এ ধরনের দৃষ্টিকোন দেখতে পাওয়া যায়। বিস্তৃত সামাজিক বিজ্ঞান এ তাত্ত্বিক সামাজিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোন থেকে মানুষের জীবনের বস্তুগত অবস্থান থেকে মানুষের প্রতিকায়িত সংস্কৃতি উদ্ভূত হয় কারণ মানুষ তার শরীরগত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই অবস্থার তৈরি করেছে, এবং মানুষের বিবর্তনের স্বভাব দ্বারা সংস্কৃতির ভিত্তি পাওয়া যায়।

যখন সংস্কৃতিকে গণনার যোগ্য সংখ্যা হিসেবে দেখা হয় তখন সংস্কৃতি মানে হচ্ছে প্রথা, ঐতিহ্য, সমাজ বা সম্প্রদায় যেমন একটি নৃগোষ্ঠিগত দল বা জাতির মূল্যবোধ। বিভিন্ন সময়ে যে জ্ঞান আহৃত হয় তার সমষ্টিই সংস্কৃতি। এই ধারণায় বহুসংস্কৃতিবাদ শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান এবং একই গ্রহে বসবাসরত বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে মূল্যায়ন করে। কখনো কখনো একটি দেশের উপদলের নির্দিষ্ট অনুশীলনকে “সংস্কৃতি” বলা হয়, উদাহরণস্বরূপ: ব্রো কালচার বা মূলধারা বিরোধী সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান এ কোন মানুষের সংস্কৃতি তার বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং অনুশীলন তার নিজের সংস্কৃতির ভিত্তিতে করা হয় এ ধারায় সংস্কৃতি সহজে নিরপেক্ষভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না বা মূল্যায়ন করা হয় না কারণ যেকোন মূল্যায়ন ওই সংস্কৃতির মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়।

 

 

সংজ্ঞায়ন:

কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। উক্ত বিষয়গুলোকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগ নিত্যদিনকার জীবনযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর দ্বিতীয়ভাগ জীবন উপভোগের ব্যবস্থা এবং উপকরণের সাথে সম্পকির্ত।

সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল এবং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের এই কৌশলগুলো ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। পূর্বপুরুষদের যেমন এই কৌশলগুলো ছিল তা থেকে উত্তরপুরুষেরা এই কৌশলগুলো পেয়ে থাকে। অধিকন্তু সময় ও যুগের প্রেক্ষিতেও তারা কিছু কৌশল সৃষ্টি করে থাকে। তাই বলা যায় সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তেমনি তা অর্জিতও বটে।

নৃবিজ্ঞানী টেইলরের ভাষ্যমতে,

সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হল সংস্কৃতি।

ম্যালিনোস্কির বক্তব্যমতে,

সংস্কৃতি হল মানব সৃষ্ট এমন সব কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।

স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের সংজ্ঞা অনুযায়ী,

সংস্কৃতি বলতে সেই সকল পন্থাকে বোঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে ওঠে এবং পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়।

 

ব্যুৎপত্তি :

প্রাচীন রোমের বাগ্মী সিসেরো তার তুসকালেনে ডিসপুটেশনস (Tusculanae Disputationes) নামক গ্রন্থে প্রথম আধুনিক “সংস্কৃতি” (“culture”) শব্দটি ব্যবহার করেন, আত্মার চর্চা’র কথার কথা লিখেন, সেখানে তিনি একটি দার্শনিক আত্মার উন্নয়নে কৃষিভিত্তিক রূপক ব্যবহার করেন, যেখানে পরমকারণবাদের দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে আত্মার চর্চা মানুষের উন্নয়নের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য আদর্শ। স্যামুয়েল পুফেনডর্ফ এই রূপকটিকে একই ধরনের অর্থ করে আধুনিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করেছেন কিন্তু কখনোই এটি মানুষের সম্পূর্ণতার দর্শন বলে ধারণা করেন নি। তার ব্যবহার, এবং তার পরে বহু লেখক “মানুষ কীভাবে উৎসগত বর্বরতা কাটিয়ে ওঠে , আর কীভাবে দক্ষতার মাধ্যমে পুরোপুরি মানুষ হয়ে ওঠে তা নির্দেশ করেন“।

১৯৮৬ সালে দার্শনিক এডওয়ার্ড এস. ক্যাসে লেখেন, “ আদতে সংস্কৃতি শব্দটির মানে মিডেল ইংলিশে হচ্ছে “জমি চাষ করা, লাতিনে এই শব্দটি হচ্ছে কোলে(colere) ‘বাস করা, যত্ন করা, চাষ করা, প্রাথনা করা’ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি নীতি, ‘কোন বিশ্বাস বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাস’ সাংস্কৃতিক হওয়া মানে হচ্ছে, একটি সংস্কৃতি থাকা, প্রগাঢ়তা নিয়ে কোন স্থানে বাস করে সে যায়গাটিকে চাষাবাদ করা-যায়গাটির দায়িত্বে থাকা, সেটিতে সাড়া দেওয়া, যত্ন সহকারে জমিটিতে যোগ দেওয়া।”।

রিচার্ড ভেল্কলে (Richard Velkley) সংস্কৃতিকে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন:

…সত্যিকারের মানে হচ্ছে আত্মা বা মনের কর্ষণ, ১৮-শতকের জার্মান চিন্তাবিদদের লেখার অধিকাংশ পরবর্তী আধুনিক অর্থ গ্রহণ করে যারা (জার্মান চিন্তাবিদ) যারা “আধুনিক উদারনীতিবাদ এবং দীপনবাদ” নিয়ে করা রুশো’র সমালোচনাকে বিভিন্ন মাত্রায়িউন্নীত করেছিলেন। এভাবে এই সব লেখকদের লেখায় “সস্কৃতি” ও সভ্যতার মধ্যে বৈপরীত্য অন্তর্নিহিত ছিল, এমনকি যখন তা প্রকাশ করা হয় নি তখনও এমনটা প্রকাশ পেত।

নৃ বিজ্ঞানী ই. বি. টেইলরের ভাষ্যমতে, এটা হচ্ছে “সেই জটিল পুরোটা যার মধ্যে জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প, নৈতিকতা, আইন, প্রথা, নৈতিকতা এবং অন্যান্য যোগ্যতা ও স্বভাবগুলো যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে আহরণ করে।”

ক্যামব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারি বর্ণনা করেছে যে সংস্কৃতি হচ্ছে “জীবন যাপনের পন্থা, বিশেষকরে নির্দিষ্ট একটি সময়ে নির্দিষ্ট একটি দলের মানুষদের সাধারণ প্রথাসমূহ ও বিশ্বাসগুলো।

 

 

পরিবর্তন:

প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে ধারণা করা হয়েছে ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতির জন্য মানুষের ক্ষমতা প্রায় ৫০০, ০০০-১৭০, ০০০ বছর আগে উদ্ভূত হয়েছে।

রেইমন পানিক্কার ২৯টি উপায়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছিল বলে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, বিবর্তন, উদ্ঘাতন, নবরূপদান, নতুন ভাবনা, সংস্কার, নতুন ভাব, প্রথা, রীতি উদ্ভাবন, পুনর্জাগরণ, বিপ্লব, পরিব্যক্তি, উন্নতি, বিকিরণ, আত্মীকরণ, ধার করা, মানসিক ঔদার্য, সমন্বয় প্রচেষ্টা, আধুনিকীকরণ, দেশিয়করণ, এবং রূপান্তকরণ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, আধুনিকীকরণকে আলোকিত যুগের বিশ্বাস এবং অনুশীলন যেমন: বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, শিল্প, বাণিজ্য, গণতন্ত্র, এবং উন্নতির লক্ষণকে গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে।

সাংস্কৃতিক আবিষ্কারের অর্থ হচ্ছে যে কোন নতুন বিষয় প্রবর্তন যা নতুন আর যা একটি দলের মানুষের জন্য দরকারী আর তাদের আচরণে তা প্রকাশিত কিন্তু তা দেখার মতো কোন বস্তু না। মানবতা বৈশ্বিক “তরান্বিত সংস্কৃতি পরিবর্তন সময়” এর মধ্যে রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, গণমাধ্যম, এবং সর্বোপরি অন্যান্য উপাদানের মধ্যে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রয়েছে। সংস্কৃতি পুর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া মানে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক ধারণাকে পুনরায় নির্মাণ করা।

সংস্কৃতিগুলো উভয় শক্তি যা পরিবর্তনের কথা বলছে আর যা পরিবর্তনকে প্রতিহত করছে তাদের দ্বারা অভ্যন্তরীণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই শক্তিগুলো সামাজিক কাঠামো আর প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কিত আর সাংস্কৃতিক ভাবের চিরস্থায়ীকরণ এবং অনুশীলনসহ পরিবর্তনের অধীন বর্তমান কাঠামোগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

সামাজিক দন্দ্ব এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি সমাজের মধ্যে সামাজিক গতি পরিবর্তন করে এবং নতুন সাংস্কৃতিক আদর্শ উন্নীত করে, এবং উৎপাদনক্ষম কর্ম তরান্বিত করে বা সক্ষম করে সমাজের পরিবর্তন করতে পারে। এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো আদর্শ পরিবর্তনগুলোর এবং অন্যান্য ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গী হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলন নতুন অনুশীলনে অন্তর্ভুক্ত করে যা লৈঙ্গিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন তৈরি করে লিঙ্গ এবং অর্থনৈতিক কাঠামো দুটোকেই পরিবর্তন করে। পরিবেশগত অবস্থাও উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বরফ যুগের শেষে ক্রান্তীয় বনাঞ্চল ফিরে আসায় গার্হস্থ্য জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলার উপযুক্ত গাছপালা সহজপ্রাপ্য হয়, যা কৃষিকাজ আবিষ্কারের পথ প্রদর্শন করে, যা পালাক্রমে অসংখ্য সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বা নতুন সংস্কৃতির উদ্ভাবন এবং সামাজিক অগ্রসরমানতায় পরিবর্তন আনে।

বিভিন্ন সমাজের সংযোগের মাধ্যমে সংস্কৃতি বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত হয়, যা সামাজিক পরিবর্তন তৈরি করতে পারে বা বাধা দিতে পারে আর সংস্কৃতির অনুশীলনে পরিবর্তন আনতে পারে। যুদ্ধ বা সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা সামাজিক গতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। সেইসাথে, সাংস্কৃতিক ভাব বা আদর্শ আশ্লেষ বা সাংস্কৃতিক অভিযোজনের মাধ্যমে এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে বদল হতে পারে। আশ্লেষের ক্ষেত্রে কোন কিছুর রূপ (এর অর্থ হতে হবে এমন না) এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে চালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা রেস্তোরার চেইন এবং রান্নার ব্র্যান্ড চীনের মানুষের কাছে কৌতূহল ও মুগ্ধতা ছড়িয়েছে যে কারণে চীন বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে দেশটির অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উন্মুক্ত করেছে। “উদ্দীপক আশ্লেষ” (ভাবনা বা আদর্শের ভাগাভাগি) একটি সংস্কৃতির একটি উপাদানকে নির্দেশ করে যা অন্য সংস্কৃতির উদ্ভাবনে বা প্রসারে নেতৃত্ব দেয়। অন্যদিকে “সরাসরি ধার করা,” এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে প্রযুক্তিগত বা বাস্তব আশ্লেষ নির্দেশে সহায়ক। উদ্ভাবনের আশ্লেষ তত্ত্ব কেন এবং কখন স্বতন্ত্র ব্যক্তি এবং সংস্কৃতিগুলো নতুন ভাবনা, অনুশীলন, এবং দ্রব্য গ্রহণ করে তার একটি গবেষণা-ভিত্তিক মডেল উপস্থাপন করে।

সাংস্কৃতিক অভিযোজনের বিভিন্ন অর্থ আছে, কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে একটি সংস্কৃতির সঙ্গে আরেকটি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের বদলকে নির্দেশ করে, যেমন ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার সময়ে বিশ্ব জুড়ে নেটিভ অ্যামেরিকান গোষ্ঠিগুলো এবং অসংখ্য আদিবাসীদের বেলায় যা ঘটেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্কিত প্রক্রিয়ায় আত্তীকরণ করে ( একজন ব্যক্তির বিভিন্ন সংস্কৃতি গ্রহণ) এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলে যাওয়া বা সমকেন্দ্রি হওয়া। বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশে যাওয়া এবং চিন্তা, ভাবনা, এবং বিশ্বাসের ভাগাভাগিতে সংস্কৃতির বহুজাতিক প্রবাহ ‍গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 

 

নৃবিজ্ঞান :

যদিও পৃথিবীজুড়ে নৃবিজ্ঞানীরা সংস্কৃতি বিষয়ে টেইলরের সংজ্ঞা নির্দেশ করেন। ২০ শতকে অ্যামেরিকার নৃবিজ্ঞানে “সংস্কৃতি” প্রধান ও সমন্বয় সাধনের ধারণা হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে, যেখানে এটি সাধারণভাবে মানুষের চিরন্তন ক্ষমতাকে নির্দেশ করে শ্রেণীবদ্ধ এবং মানুষের অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রতীকায়িতভাবে সংকেতাবদ্ধ করতে এবং সামাজিক সংকেতাবদ্ধ অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রতীকায়িতভাবে যোগাযোগ করতে। অ্যামেরিকার নৃবিজ্ঞান চারটি ক্ষেত্রে সংঘঠিত, যার প্রতিটি সংস্কৃতির গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে: জীববিজ্ঞানগত নৃবিজ্ঞান, ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান আর অ্যামেরিকার প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞান কালচারব্রিল্লি (Kulturbrille) বা “সাংস্কৃতিক আয়না” শব্দটি জার্মান অ্যামেরিকান নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ বোয়াস Franz Boas উদ্ভাবন করেন, এতে নিজের দেশকে যে আয়না’য় দেখা যায় তার কথা নির্দেশ করা হয়। মার্টিন লিন্ডস্ট্রম দাবি করেন যে কালচারব্রিল্লি যে সংস্কৃতিতে আমরা বাস করি তা সহজে বুঝতে সাহায্য করে, সেইসাথে “আমাদের এমন কিছু দিয়ে বাঁধে যা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে বহিরাগতরা সহজে কিছু শিখতে পারে।”

 

সমাজবিজ্ঞান :

সংস্কৃতির সমাজবিজ্ঞান সমাজে প্রদর্শিত সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত করে।সমাজবিজ্ঞানী জিঅরগ সিমমেল Georg Simmel (১৮৫৮–১৯১৮) এর মতে, সংস্কৃতি নির্দেশ করে “কোন ব্যক্তির ইতিহাসে যা বিমূর্ত হয়ে আছে তার বাহ্যিক রূপের চর্চা।” [37] চিন্তার ধারা, কার্য সম্পাদনের ধারা, এবং বস্তু যা একসঙ্গে মানুষের জীবন ধারা তৈরি করে তাকে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে সংস্কৃতি বলে। সংস্কৃতি দুই ধরনের হতে পারে, অবস্তুগত সংস্কৃতি ও বস্তুগত সংস্কৃতি। [6] অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে শারীরিক অবয়বহীন ভাবনা, যা প্রতিটি ব্যক্তি’র তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কিত, মূল্যবোধ, বিশ্বাস প্রক্রিয়া, নিয়ম নীতি, আদর্শ, নৈতিকতা, ভাষা, সংঘঠন, এবং প্রতিষ্ঠান কিন্তু বস্তুগত সংস্কৃতি বস্তু ও স্থাপত্যের মধ্যে সংস্কৃতির শারীরিক উপস্থিতি । এই পদটি শুধুমাত্র প্রত্নতত্ত্ব ও নৃ-বিজ্ঞান পাঠে প্রাসঙ্গিক কিন্তু নির্দিষ্টভাবে সকল বাস্তবিক উপস্থিতি সংস্কৃতি, অতীত ও বর্তমানে আরোপ করা যায়।

উইমার জার্মানিতে (১৯১৮-১৯৩৩) প্রথম সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান উদ্ভূত হয়, সেখানে সমাজবিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েবার কালচারসোজিওলজি ( Kultursoziologie) শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপরে ১৯৬০ সালে ইংরেজিতে কথা বলা দেশগুলোতে কালচারাল টার্ন-এর একটি পণ্য হিসেবে সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান “পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।

সংস্কৃতি অধ্যয়ন :

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যুক্তরাজ্যের সমাজবিজ্ঞানীগণ এবং স্টুয়ার্ট হল ও রেইমন্ড উইলিয়ামসের মত মার্ক্সবাদে প্রভাবিত কিছু পণ্ডিত সংস্কৃতি অধ্যয়ন-র উন্মেষ ঘটান। মার্ক্সবাদ ও সমালোচক তত্ত্বের মত দর্শনের কিছু পাঠশালা দাবি করে যে, সংস্কৃতিকে প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে অভিজাত-শ্রেণীর একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় যা নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং একটি “ভ্রান্ত চেতনা”র সৃষ্টি করে; সংস্কৃতি অধ্যয়নের পাঠ্যক্রমে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বহুলভাবে প্রচলিত।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment