আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সরোদের উদ্ভাবন
সরোদের উদ্ভাবন
সরোদের উদ্ভাবন
পশুতুনিস্তান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে রবার চলে আসার পর পাঠান রবারিয়াদের বাদনরীতিতে ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলো। এমনটি ঘটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। অধিকন্ত সেনিয়া রবাবিয়াদের কাছে অনেকে ধ্রুপদী সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে এই প্রভাব আরো গভীর হলো। সেনিয়া রবাবিয়াগণ মূলত সেনিয়া রবাব, বীণ এবং সুরশৃঙ্গার বাজাতেন।
পারিবারিকভাবে তাঁদের রীতি ছিলো এই যে, নিজ বংশধর ব্যতীত অন্য কাউকে তাঁরা এই যন্ত্রের শিক্ষা দিতেন না। এমনকি পৌত্রদের শিক্ষা দিলেও দৌহিত্রদের দিতেন না। পাঠান রবাবিয়াদের মধ্যে যাঁরা প্রতিভাবান ছিলেন তাঁরা তানসেনের বংশের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং অত্যন্ত গুণী শিল্পীদের কাছে ধ্রুপদী শেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তবে তাঁরা শিক্ষালাভ করতেন তাঁদের নিজেদের যন্ত্রে অর্থাৎ আফগানী রবাবের সাহায্যে।
হিন্দুস্তানী ধ্রুপদী সংগীত শিক্ষালাভের এক পর্যায়ে তাঁরা অনুভব করতে লাগলেন যে ধ্রুপদী সংগীতের যে বৈশিষ্ট্য এবং মাধুর্য তা প্রকাশ করার জন্য আফগানী রবাব যথেষ্ট নয়। ক্রমে তাঁদের মধ্যে নতুন কোন যন্ত্র আবিস্কারের চাহিদা সৃষ্টি হতে লাগলো। প্রখ্যাত সরোদিয়া বুদ্ধদের দাসগুপ্ত কোলকাতা দূরদর্শনে (১৯৮২) বলেছিলেন যে, “এই রবাবিয়াগন নিজেদের যন্ত্রের দিকে চেয়ে কিছু একটা অভাব বোধ করলেন”।
এই অভাব বোধই ক্রমান্বয়ে ইতিহাসকে সরোদ উদ্ভাবনের পথে নিয়ে গেল। ভারতে বসতি স্থাপনকারী পাঠান বংশোদ্ভূত রবারিয়াদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ লখনৌ এবং রামপুরে রাজদরবারের পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। গোয়ালিয়র এবং দারভাঙার দরবারেও অনেকে স্থান লাভ করেছিলেন। এভাবে রাজন্যবর্গের এবং সমাজের উচ্চশ্রেণীর পৃষ্টপোষকতায় অনেক রবারিয়া সংগীত সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।
এঁদের মধ্যেই এক বা একাধিক শিল্পী রবাবের পরিবর্তন সাধনে তথা সরোদ উদ্ভাবনে অবদান রাখেন। সরোদ উদ্ভাবনের দাবীদার হিসেবে তিনজনের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এই তিনজন হলেন – নিয়ামতউল্লাহ খান, গোলাম আলী খান এবং আবিদ আলী খান। পৃথক – পৃথকভাবে তিনজনই সরোদ আবিস্কার করেছেন বলে তাঁদের বংশধরেরা দাবী করে থাকেন। কোন কোন ক্ষেত্রে এর স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণও রয়েছে। তিনজনের ইতিহাস তাই এখানে পৃথকভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
নিয়ামতউল্লাহ খান
নিয়ামতউল্লাহ খানের জন্য ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি পাঠান বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত রবাবিয়া করিমউল্লাহ খানের পৌত্র। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকদের হাতে যখন নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ্ লখনৌ থেকে রাজ্যচ্যুত এবং নির্বাসিত হয়ে কোলকাতার মেটিয়াবুরুজে চলে আসেন, তখন তাঁর মেটিয়াবুরুজের সভায় একজন সংগীতজ্ঞ ছিলেন নিয়ামতউল্লাহ খান।
সেখানে তিনি এগার বছর ছিলেন। তবে সম্ভবত এর আগে লখনৌ থাকাকালীন তিনি সেখানকার রাজসভায়ও নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময়ে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সরোদ যন্ত্রটি আবিস্কার করেন। তাঁর বংশধরদের কাছ থেকে এই বিবরণ পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে লখনৌয়ের দরবারে থাকার সময়ে অথবা মেটিয়াবুরুজের দরবারে থাকার সময়ে সরোদ আবিস্কৃত হয়েছিলো এ বিষয়ে লিখিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর সরোদ আবিস্কারের বিষয়ে তথ্য প্রমাণ বিদ্যমাণ ।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত নিয়ামতউল্লাহ খানের পুত্র কেরামতউল্লাহ খানের লেখা “ইসরার-ই-কেরামত উরফ্ নাগমাত-ই-নিয়ামত’ গ্রন্থে কেরামতউল্লাহ এই দাবী লিপিবদ্ধ করেন। তিনি লিখেছেন যে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে (হিসেব করলে তা ১৮৫০ সালের কাছাকাছি কোন এক সময়ের কথা বোঝায়) তাঁর পিতা সরোদ যন্ত্রটি আবিস্কার করেছেন।
নিয়ামতউল্লাহ খানের প্রপৌত্র মুহম্মদ ইরফান খানের ভাষ্যমতে তানসেন বংশীয় শিল্পী বাসত খানের পরামর্শে নিয়ামতউল্লাহ খান সরোদে কাঠের ফিংগারবোর্ড পরিবর্তন করে ধাতুর তৈরি ফিংগারবোর্ডের প্রচলন করেন এবং অস্ত্রী তারের পরিবর্তে ধাতব তারের প্রচলন করেন।
নিয়ামতউল্লাহ খানের অপর একজন বংশধর গুলফাম আহমেদ খানের কাছ থেকে নিম্নরূপ ভাষা পাওয়া নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহর দরবারে যোগ দেওয়ার পর নিয়ামতউল্লাহ খান মিঞা তানসেনের পৌত্র বাসত খানের শিষ্য হন। শিক্ষা গ্রহণকালে তিনি তাঁর যন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনয়নের জন্য গুরুর অনুমতি প্রার্থনা করেন, কারণ তাঁর যজ্ঞে ‘সুত’ এবং ‘খীড়’ ভালভাবে বাজানো যেত না। শুরু তাঁকে অনুমতি দিলেন।
নিয়ামতউল্লাহ খান একজন কামারের সাহায্য নিয়ে কাঠের পরিবর্তে একটি পাতলা লোহার পাত লাগালেন। এরপর তাতে লোহা, পিতল এবং ব্রোঞ্জের তার সংযোজন করলেন। এতে করে যন্ত্রটির আওয়াজ, স্বরের গভীরতা এবং স্থায়ীত্ব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। তিনি গভীরভাবে তাঁর সরোদে রেওয়াজ করতে লাগলেন। তাঁর শুরু বাসত খান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁকে নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহর সামনে এই যন্ত্র বাজিয়ে শোনাতে বললেন।
নওয়াব তার সরোদ বাদন শুনে অত্যন্ত যুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে ‘সরকার’ উপাধি দিলেন।” নিয়ামতউল্লাহ খান আরো একটি পরিবর্তন সাধন করেন সরোদে। তখনকার দিনে রবার যন্ত্রে অস্ত্রী তারের তৈরি চারটি পর্দা বাঁধা থাকতো ফিংগারবোর্ডে। নিয়ামতউল্লাহ খার সেগুলো অপসারণ করেন। কারণ প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোন প্রয়োজন ছিলো না বলে তিনি মনে করেন।
নিয়ামতউল্লাহ খানের অপর একজন বংশধর ইলিয়াস খানের মতে সেনিয়া শিল্পীদের কাছে নিয়ামতউল্লাহ খান সেনিয়া রবারে বাজানো বোলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজগুলো সরোদে খুব ভালভাবে রপ্ত করেন।
গোলাম আলী খান
সরোদ আবিস্কারের দাবীদারদের মধ্যে গোলাম আলী খানের নাম নিয়ে তাঁর বংশপরেরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সরব। কারণ তাঁর বংশধরদের মধ্যে রয়েছেন আমজাদ আলী খানের মত তারকাখ্যাতিসম্পন্ন সিরোদিয়া, প্রচার মাধ্যমে যাঁর বিচরণ উল্লেখ করার মত। তবে গোলাম আলী খানের এই আবিস্কারের কথা কেবল তাঁর বংশধরদের মুখে প্রচারিত ইতিহাস থেকেই জানা যায়।
এর পক্ষে কোন লিখিত নিদর্শন নাই। গোলাম আলী খানের জন্যসালও সঠিকভাবে জানা যায় না। এছাড়া করে তিনি সরোদ আবিস্কার করেছিলেন তাও সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি পাঠানদের বাংগাশ গোত্রীয় গোলাম বন্দেগী খানের পুত্র ছিলেন। গোলাম বন্দেগী খান ছিলেন রেওয়ার মহারাজা বিশ্বনাথ সিং-এর সেনাবাহিনীর রিসালদার।
বাল্যবয়সে পিতার কাছে গোলাম আলী খানের সংগীত শিক্ষা শুরু হয়। সংগীতে গোলাম আলী খানের আগ্রহের কথা শুনে রেওয়ার মহারাজা নিজে তাঁকে সংগীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন তাঁর দশ বছর বয়সে। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি ভ্রমণে বের হন এবং সম্ভবত বিভিন্ন রাজদরবারে গমন করেন। ধারণা করা হয় তিনি ফররুখাবাদের নবাবের দরবারে কাজ করেছিলেন। সেখানে তিনি তানসেনের বংশধর পেয়ার খানের সাহচর্যে আসেন।
তিনি শেষ জীবন গোয়ালিয়রে অতিবাহিত করেন এবং ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন। নিয়ামতউল্লাহ খান যে সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরোদ আবিস্কার করেন, গোলাম আলী খানও সেই সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরোদ আবিস্কার করেন বলে জনশ্রুতি আছে।
আবিদ আলী খান
আবিদ আলী পাঠান বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে দিল্লীতে সম্রাট বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। আবিদ আলী খান ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে রামপুরে একজন বিখ্যাত সরোদিয়া হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তানসেন বংশীয় শিল্পী বাহাদুর হোসেন খানের কাছে রামপুরে সংগীত শিক্ষা করেন।
ড. এড্রিয়ান ম্যাকনিলের সঙ্গে ১৯৮৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর পৌত্র মোহাম্মদ আলী খান বলেন, আবিদ আলী খান কাবুলি রবার এবং সরোদ দু’টি যন্ত্রই বাজাতেন। তাঁর চাচাতো ভাই যুক্ত খানও বিখ্যাত সরোদিয়া ছিলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং ওস্তাদ হাফিজ আলী খানের পূর্বে তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত সরোদিয়া। মোহাম্মদ আলী খানের মতে তাঁর পিতামহই সর্বপ্রথম সরোদে ধাতব ফিংগারবোর্ড এবং ধাতব তারের সংযোগ করেন।
কবে তিনি এই কাজ করেছিলেন সে বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট তারিখ মোহাম্মদ আলী খান উল্লেখ করতে পারেন নি, তবে তাঁর ধারণা সম্ভবত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি এই আবিস্কার করেন। তাঁর এবং তাঁদের বংশের অন্যান্যদেরও বিশ্বাস আবিদ আলী খান সর্বপ্রথম এই আবিস্কার করেন এবং তাঁর অনুকরণে অন্যান্যরাও পরে বাদ্যযন্ত্রে এই পরিবর্তনগুলো আনয়ন করেন।
আবিদ আলী খানের পুত্র আহমেদ আলী খানও একজন বিখ্যাত সরোদিয়া ছিলেন। তিনি প্রথমে রামপুরে এবং পরে কোলকাতায় বসবাস করেন। পরিশেষে একথা বলা যায় যে, এক দিনে অথবা কোন একটি পরিবর্তনের মাধ্যমে সরোদ আবিষ্কৃত হয়। নি। একটিমাত্র আবিষ্কারের পেছনে একাধিক ঘটনা কাজ করে। এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই ।
নিয়ামতউল্লাহ খান, গোলাম আলী খান এবং আবিদ আলী খান তিনজনেই কাঠের ফিংগারবোর্ডের পরিবর্তে ধাতব ফিংগারবোর্ড এবং অস্ত্রী তারের পরিবর্তে ধাতব তারের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তবে তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো কিন্তু অভিন্ন রকমের ছিলো না। প্রত্যেকের যন্ত্র ভিন্ন রকম ছিলো। নিয়ামতউল্লাহ্ খান এবং গোলাম আলী খানের পুত্র মুরাদ আলী খানের সরোদ পর্যবেক্ষণ করে গবেষকগন কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন।
যেমন, সরোদের শেষ প্রান্তে খুঁটি আটকানোর জায়গাটি, ইংরেজিতে যাকে পেগ বক্স বলা হয়, সেটি দু’জনের সরোদে দুই ধরণের ছিলো। নিয়ামতউল্লাহ খানের পুত্র কেরামতউল্লাহ খানের সরোদ হাতে যে ছবি রয়েছে তাতে দেখা যায় যে, পাঠান সরোদের অনুসরণে এর পেগ বক্সের সামনের অংশ খোলা। সেনিয়া রবারের গঠনও এই রকম ছিলো। তাঁর পিতা নিয়ামতউল্লাহ খানও একই রকম ডিজাইনের সরোদ বাজাতেন।
চিত্র – বাদ্যযন্ত্রে জোড়া তার ব্যবহারের নমুনা
দ্বিতীয় পরিবর্তনটি এলো বাদন পদ্ধতিতে। কাঠের ফিংগারবোর্ডে বাঁ হাতের আঙুলের পেছনভাগ অর্থাৎ মাংসল অংশের সাহায্যে তার চেপে ধরে বাজানো হতো। কিন্তু ধাতব ফিংগারবোর্ড লাগানোর পরে তার উপরে তার চেপে রাখার জন্য আঙুলের নখের ব্যবহার শুরু হলো।
তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকার নখের সাহায্যে প্রয়োজনমত স্থানে তার চেপে ধরে সরোদ বাজতে হয়। এত করে সরোদে স্বরের রেশ অনেক দীর্ঘায়িত হলো। ফলে শুধু আকার বা কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, শব্দের গুণ ও মানের দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক বাদ্যযন্ত্রের আবিস্কার হলো।
আরও দেখুন :