সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

রবার বিশেষত আফগানী রবাবের সাথে সরোদের মিল সবচেয়ে বেশি। রবাব থেকে সরোদ উদ্ভাবনের পক্ষে যুক্তিও সবচেয়ে বেশি। ড.এলাইন মাইনারের মতে আফগানী রবাব থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সরোদ উৎপত্তির সম্ভাবনাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণা। ১ তবে এ সম্পর্কে দু’টি মতবাদ রয়েছে।

প্রথম মতবাদ অনুসারে আফগানী রবার থেকে সরোদের উৎপত্তি। বর্তমান ভৌগোলিক পরিসীমা অনুযায়ী আফগানিস্তান এবং উত্তর পাকিস্তানের কিছু অংশে বসবাসকারী পশতুন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রবাবের চর্চা চলে আসছে। এই রবার আফগানী রবাব অথবা কাবুলি রবাব নামে পরিচিত। আকৃতির দিক থেকে এর সাথে বর্তমান সরোদের অসাধারণ মিলও রয়েছে।

দ্বিতীয় মতবাদ অনেকটা প্রথম মতবাদের অনুরূপ। অর্থাৎ পশতুন বাদকদের হাতে যে রবাবের চর্চা হয়ে এসেছে সে বিষয়ে এখানে কোন দ্বিমত নাই। তবে এই মত অনুসারে ঐতিহাসিক পটভূমির বিবেচনায় এই রবাবের মূল খুঁজে নিতে হবে আরো পেছন থেকে। পশতুনিস্তানে প্রচলিত রবাবের উৎপত্তি আসলে প্রাচীন গ্রিসে। আলেকজান্ডারের অভিযানের সময় এই যন্ত্রটি পশতুনিস্তানে আসে। মূল যন্ত্রটির আবিষ্কারক ছিলেন পিথাগোরাস।

এই মতের পক্ষে কিছু যুক্তি এবং তথ্য প্রমাণ রয়েছে, যে কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত “সরমাইয়া-ই-ইসরাত” গ্রন্থে “রবাব সিকান্দারী” নামে এক ধরণের রবাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিকান্দার নামটি এসেছে আলেকজান্ডার থেকে। এই যন্ত্র আলেকজান্ডারে সাথে এই অঞ্চলে এসেছিলো বলে লোকমুখে প্রচলিত আছে।

এই যন্ত্রে চারটি অস্ত্রী তার থাকতো এবং সাতটি তরফের তার থাকতো। মূল তারগুলোর সুর বাঁধা হতো এভাবে প্রথম দু’টি তার ‘স’ স্বরে, এ দু’টি জোড়া তার, দ্বিতীয় তারটি ‘প’ স্বরে এবং শেষের তারটি ‘স’ স্বরে বাঁধা হতো। সপ্তকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তরফের তার বাঁধা হতো। ত্রিভূজাকৃতির জওয়া দিয়ে বাজানো হতো। গ্রন্থে এই যন্ত্রের একটি চিত্রও দেওয়া হয়েছে।

 

সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

চিত্র – রবাব সিকান্দারী

তৃতীয় আরেকটি মতবাদ রয়েছে সরোদের আবির্ভাব প্রসঙ্গে। প্রথম এবং দ্বিতীয় মতবাদ থেকে এটি কিছুটা ভিন্ন। এই মত অনুসারে খাটো গলাবিশিষ্ট সম্পূর্ণভাবে উপমহাদেশের নিজস্ব একটি যন্ত্র চিত্রা বীণা (প্রাচীন লিউট জাতীয় যন্ত্র) থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সরোদের উৎপত্তি হয়েছে।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রাচীন গুহাচিত্রে এই ধরণের বীণার চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি রবাবের মত একটি যন্ত্র। প্রাচীন চিত্রা বীণা থেকে বিবর্তনের ধারায় একদিকে যেমন সুরশৃঙ্গার যন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সরোদেরও উৎপত্তি হয়েছে।

 

সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

চিত্র – চিত্রা বীণা

প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, মুসলিম শাসকদের আগমণের বহু আগে থেকেই এদেশে রবাব জাতীয় যন্ত্রের অস্তিত্ব ছিলো। তবে মজার ব্যাপার এই যে, সেতারের ক্ষেত্রে যেমন প্রাচীন মন্দির চিত্রে পাওয়া লিউট যন্ত্রের সাথে সেতারের সরাসরি কোন যোগ দেখানো যায় না, এখানেও ঠিক তেমন মন্দিরে প্রাপ্ত রবাব জাতীয় যন্ত্র যা পাশ্চাত্য গবেষকদের লেখায় “Gandharan Lutes” নামে অভিহিত হয়েছে তার সাথে রবারের সরাসরি কোন যোগ আবিস্কার করা যায় না।

তবে আকার এবং কাঠামোগত সাদৃশ্যের বিবেচনায় এই অনুমানটিকে একোরে অস্বীকার করা যায় না। ওস্তাদ আলী আকবার খান এবং শরণ রাণীর মত অনেক বিখ্যাত শিল্পী এই মতবাদে বিশ্বাসী। সরোদের পূর্বসূরী হিসেবে কখনো চিত্রা বীণা কখনো রবাব কখনো সুরশৃঙ্গারকে বিবেচনা করা হয়েছে।

ড. এড্রিয়ান ম্যাকনিলের মতে বিষয়টিকে এভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, প্রাচীন কাল থেকেই উত্তর ভারতে এবং আশেপাশের অঞ্চলে তারে টোকা দিয়ে বাজানো হয় এমন ধরণের খাটো গলার লিউট জাতীয় যন্ত্রের প্রচলন ছিলো। পশতুন রবাব এবং চিত্রা বীণাকে পরস্পর বিরোধী ধরণের দু’টি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিবেচনা না করে অন্যভাবে বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে।

গুহাচিত্র থেকে, প্রাচীন ইতিহাস থেকে এবং নৃতাত্ত্বিক আবিস্কার থেকে যে সমস্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে ধারণা করা যেতে পারে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর আশেপাশের বিরাট এলাকা অর্থাৎ পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে হিমালয় অতিক্রম করে উত্তরের সমভূমি, সেখান থেকে পূর্বে আসাম এবং বাংলাদেশ – এই সমগ্ৰ অঞ্চল জুড়ে যুগ যুগ ধরে খাটো গলা লিউট জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের চর্চা হয়ে এসেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে পশতুনদের রবাব হোক অথবা অন্য কোন যন্ত্র হোক সবগুলোকে একটি বিশাল ভৌগোলিক এলাকার একই গোত্রের লিউট জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের অন্তর্গত বলে ধরে নেওয়া যায়। এগুলো সবই তারে টোকা দিয়ে বাজানোর যন্ত্র। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এক একটি সংস্কৃতিতে প্রচলিত যন্ত্রগুলোর মধ্যে কিছু মিল অমিল লক্ষ্য করা যায় এই যা পার্থক্য ।

ঠিক একই ধরণের মনোভাব সংগীত গবেষক এবং লেখক দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায়েরও। আফগানিস্তানে প্রচলিত কাবুলি রবাব, যা কোন কোন ক্ষেত্রে ‘সুরুদ’ নামেও পরিচিত, ভারতবর্ষে এসে তার নাম ও আকারে রূপান্তর প্রসঙ্গে এই দুই অঞ্চলের ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার কথা প্রয়োজন বলে মনে করেন।

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সংগীতে ঘরানার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন “আফগানিস্তান অতীতে ভারতের অঙ্গ ছিলো, তখন সেই ভূভাগ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিমণ্ডলভুক্ত এবং তার স্থাপত্য-ভাস্কর্য-কারুর চাক্ষুষ পরিচয় নিদর্শন আজও আফগানিস্তানে বর্তমান।

আরো কথা এই যে, পরবর্তীকালে গজনীর মাহমুদ, ঘোরীর মহম্মদ প্রমূখের লুণ্ঠন অপহরণে শুধু মণিরত্নাদি নয়, সাংস্কৃতিক নানা উপকরণ এমন কি শিল্পী কারিগর পর্যন্ত ভারত থেকে সে দেশে স্থানান্তরিত হয়ে যায়।সরোদ নামের আবির্ভাব নিয়েও কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। যেমন,

১. সরোদ শব্দের মূল উৎপত্তি গ্রিক শব্দ থেকে। প্রখ্যাত সরোদবাদক কেরামতউল্লাহ খান এই মতবাদের সমর্থক।

২. সরোদ একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ ‘সুর’ (Melody)। প্রখ্যাত সরোদবাদক আমজাদ আলী খান এই মতের সমর্থক।

৩. ফার্সি শব্দ ‘সরোদান’ থেকে সরোদ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ গান গাওয়া’।

৪. ফার্সি শব্দ ‘শাহরুদ’ থেকে সরোদ শব্দের উৎপত্তি। ‘রুম’ হচ্ছে পারস্যে প্রচলিত লিউট জাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্র। ‘শাহ্’ অর্থ রাজা। কাজেই ‘শাহরুদ’ অর্থ ‘বাদ্যযন্ত্রের রাজা’।

উল্লিখিত মতগুলোর কোনটির পক্ষেই সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণ নাই। কাজেই বিষয়টিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। সরোদের ইতিহাস থেকে অন্তত এটুকু বিষয় স্পষ্ট যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন কাবুলি রবার ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে এবং তারপর ধীরে ধীরে হিন্দুস্তানী সরোদে রূপান্তরিত হতে থাকে, সে সময়েই সরোদ নামটির প্রচলন শুরু হয়।

সময়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কে প্রথম সরোদ নামটির প্রচলন করেন, অথবা কি কারণে ‘সরোদ’ নামটি নির্বাচন করেন এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয়ে অনুমান গঠন করেছেন ড.এড্রিয়ান ম্যাকনিল। যেমন, ফার্সী ভাষায় সরোদ অর্থ গান গাওয়া। কাজেই ফার্সী সাংগীতিক পরিভাষায় এ শব্দটির প্রচলন বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতে বেলুচিস্তানে ছড় দিয়ে বাজানোর এক প্রকার যন্ত্র প্রচলিত ছিলো যার নাম সারোদ এবং সিস্তানে অনুরূপ যন্ত্র প্রচলিত ছিলো যার নাম সরুদ। অবশ্যই এই যন্ত্রগুলোর কাঠামোগত গঠনে কাবুলী রবাবের সাথে ভিন্নতা ছিলো। তবে এই যন্ত্রগুলোও যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হতো।

কেরামতউল্লাহ খান এবং আরো অনেকের মতে ভারতবর্ষে যা কাবুলি রবার নামে পরিচিত ছিলো তা আরো অনেক আগে থেকে আফগানিস্তানে সরোদ নামে পরিচিত ছিলো। উল্লেখ্য যে, পাঠানদের মধ্যে অনেকের নামের শেষাংশে ‘সরোদী’ নাম যুক্ত হতে দেখা যায়। এরা সরোদ অথবা রবাব বাদকের বংশধর। এ থেকে কেরামতউল্লাহ খানের ধারণার পক্ষে একটি যুক্তি পাওয়া যায়।

 

সরোদ উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ

 

তবে মনে রাখতে হবে এই সরোদ বলতে বে যন্ত্রকে বোঝায় তা আমাদের পরিচিত সরোদ নয়। আমাদের পরিচিত তুলনামূলক আধুনিক যন্ত্র সরোদকে আলোচনার সুবিধার্থে এখানে ‘হিন্দুস্তানী সরোদ’ বলে উল্লেখ করা হবে। ড. এড্রিয়ান ম্যাকনিলের অনুসরনে উপসংহারে বলা যায় যে, আধুনিক হিন্দুস্তানী সরোদ আবিষ্কারের পূর্বেই পাঠানদের মধ্যে সরোদ জাতীয় যন্ত্র বাদনের ঐতিহ্য প্রচলিত ছিলো।

এরপর পরিবর্তনের মাধ্যমে যখন হিন্দুস্তানী সরোদের (অর্থাৎ কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের কথা বাদ দিয়ে আধুনিক যুগে সরোদ বলতে যে ধরণের যন্ত্রের সাথে আমরা পরিচিত) উদ্ভব হলো, তখন সম্ভবত পাঠানদের সংস্কৃতিতে প্রচলিত ‘সরোদ’ নামটিই এই আধুনিক যন্ত্রের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিলো।

আরও দেখুন :

Leave a Comment