সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

সুরশৃঙ্গারের সাথে সরোদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। সুরশৃঙ্গারের সাথে সরোদের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে এবং সরোদ উদ্ভাবনের পেছনে সুরশৃঙ্গার-যন্ত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। প্রাচীনত্বের বিবেচনায় সুরশৃঙ্গার সরোদরে অগ্রজ। সুরশৃঙ্গার-যন্ত্রের কিছু সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালে সরোদে গৃহীত হয়েছে।

তবে আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের চেয়ে বরং বাদনরীতি এবং তারের বিণ্যাস ও সুর বাঁধার পদ্ধতির দিক থেকে সুরশৃঙ্গার সরোদকে বেশি প্রভাবিত করেছে। প্রাসঙ্গিক কারণে তাই সুরশৃঙ্গার-যন্ত্রের বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন ।

 

সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

চিত্র – সুরশৃঙ্গার

সুরশৃঙ্গার আবিস্কারের পেছনের কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই যন্ত্র আবিস্কৃত হয়। মিঞা তানসেনের বংশধর ছজ্জ্ব খানের পুত্র জাফর খান এই যন্ত্রের আবিস্কারক। দু’জনেই খুব উঁচু মাপের রবাব বাদক ছিলেন। একবার জাফর খান এবং নির্মল শাহ্ ( মিঞা তানসেনের বংশের প্রসিদ্ধ বীণকার) বেনারসের রাজদরবারে বাদন পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।

প্রথমে নির্মল শাহ্ বীণ বাজিয়ে শোনালেন। পরে জাফর খানের বাজাবার পালা। তখন ছিলো বর্ষাকাল। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে জাফর খানের রবাবের চামড়ার ছাউনি এবং অস্ত্রী তার এমনভাবে আর্দ্র হয়ে উঠেছিলো যে তা থেকে ভাল শব্দ উৎপন্ন করা সম্ভব ছিলো না। নির্মল শাহের সাথে জাফর খানের সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব ছিলো। এ পর্যায়ে এসে আবহাওয়ার কারণে তাঁকে হেরে যেতে হবে।

মনে করে জাফর খান বেনারসের মহারাজার কাছে এক মাসের ছুটি প্রার্থনা করলেন এবং কথা দিলেন যে এক মাস পর এসে তিনি তাঁর শিল্পকলা প্রদর্শন করবেন। এই এক মাস সময়ের মধ্যে তিনি শহরে গিয়ে একজন কারিগরের সাহায্যে রবাবের মত করে নতুন একটি যন্ত্র তৈরি করলেন। যে পরিবর্তনগুলো তিনি আনয়ন করেছিলেন তাঁর যন্ত্রে তা হলো, ফিংগারবোর্ড হিসেবে তিনি বড় একটি ধাতব পাত বসালেন।

 

সুরশৃঙ্গার ও সরোদ

 

অস্ত্রী তারগুলো খুলে সেখানে ধাতব তার লাগালেন। কাঠের যে শব্দ প্রকোষ্ঠ ছিলো রবারে তার পরিবর্তে বড় লাউয়ের তৈরি একটি তুম্বা সংযোজন করলেন শব্দ প্রকোষ্ঠ হিসেবে। এই লাউয়ের উপরিভাগে পাতলা কাঠের একটি আচ্ছাদন ছিলো। এর যে ব্রিজ ব্যবহার করা হলো তা ছিলো জওয়ারি ধরণের অর্থাৎ চওড়া চৌকির মত, সরোদ কিংবা বেহালার মত পাতলা ব্রিজ নয়। এর শব্দ অনেকটা সুরবাহারের মত ছিলো। সুরবাহারের মতই ডান হাতে মিজরাব পরে এই যন্ত্র বাজানো হতো।

সুরশৃঙ্গার-যন্ত্রের পেগবন্ধু ছিলো বীণের মত আবদ্ধ ডিজাইনের। এর এক পাশে চারটি অপর পাশে পাঁচটি, এভাবে খুঁটিগুলো লাগানো হতো। এর সুর মেলানের পদ্ধতি সেনিয়া রবাবের মত ছিলো। তবে রবাবের চেয়ে এতে অতিরিক্ত তিনটি তার ব্যবহার করা হলো। দু’টি চিকারীর তার হিসেবে এবং একটি সুর ধরে রাখার জনা(ড্রোন হিসেবে)। চিকারীর তার লাগানো হলো ঝালা বাজানোর জন্য। ঝালা পূর্বে শুধু বীণ অঙ্গের কাজ ছিলো।

তবে জাফর খান নির্মল শাহের শিষ্য ছিলেন। সেজন্য বীণ অঙ্গের বহু কাজ তাঁর জানা ছিলো। শব্দ প্রকোষ্ঠ হিসেবে একটি তুম্বার ব্যবহার ছাড়াও ছোট আকারের আরেকটি তুম্বা যন্ত্রের শেষ প্রান্তের কাছাকাছি পেছন দিকে লাগানো হতো অনুনাদক হিসেবে, ঠিক যেমন সুরবাহারে লাগানো হয়। বাদকের পছন্দ অনুযায়ী সেতারেও এই ধরণের ছোট তুম্বা ব্যবহৃত হয়।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

জাফর খান তাঁর নতুন যন্ত্রের নামকরণ করেন সুরশৃঙ্গার। অচিরে এই যন্ত্র অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাফর খান, তাঁর ভাই পেয়ার খান এবং অপর ভাই বাসিত খানের পুত্র বাহাদুর হোসেন খান উচ্চমানের সুরশৃঙ্গার বাদক ছিলেন। বাহাদুর হোসেন খান তাঁর পালিত পুত্র ওয়াজির খানকে রবাব এবং সুরশৃঙ্গার শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং ওস্তাদ হাফিজ আলী খান ওস্তাদ ওয়াজির খানের কাছে সুরশৃঙ্গার-যন্ত্রে তালিম গ্রহণ করেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment