আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সুরশৈলী অনুসন্ধান
সুরশৈলী অনুসন্ধান
সুরশৈলী অনুসন্ধান
স্বদেশি গানের গভীরে থাকে নিজভূমির প্রতি মমতা, নিজ মাটির প্রতি মনের টান। অতি সহজ ও সাবলীল এই সম্পর্ক। এই সকল গানের সুরে কালোয়াতি বা গুরু-গম্ভীর সুরের ব্যবহারে আত্মার সাথে এর সহজ সুন্দর সম্পর্ক বাধাপ্রাপ্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন সহজ মাটির সুর কীর্তন, বাউল, সারি ও রামপ্রসাদীর চিরচেনা সুরকে প্রয়োগ করেছেন তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও ঠিক তাই করেছেন।
সহজ কথা ও সুর যেমন করে বিষয়বস্তুকে বোঝাতে সক্ষম হয় কঠিন কালোয়াতি সুর তা করতে ব্যর্থ হয়। স্বদেশের জন্য আন্দোলন দেশের সকল মানুষের সম্পৃক্ততায় পরিপূর্ণতা পায়। তাই যে সুর বা বাণীর প্রক্ষেপণ সহজ বোধগম্য তাই হয় আত্মস্থকরণের সরল উপকরণ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্বদেশের গানে রাগ-রাগিণীর ব্যবহারকে শিখিল করে তাতে কীর্তন-বাউলের সুর ব্যবহার করেছেন। যেমন-
“একবার গালভরা মা ডাকে
মা বলে ডাক মা বলে ডাক
মা বলে ডাক মা কে
এই দেশপ্রেম পর্বের গানের সুরসৃষ্টিতে তিনি সচেতনভাবেই কীর্তন ও বাউল সুরের সহজ এ উপাত্ত আবেগকে গ্রহণ করেছেন। মানুষের মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্ষেপণ হবে স্বদেশের গান এই ভাবনাতেই সুরের বাউলমতে অন্তরের উদ্দীপনার উচ্চারণকে গুরুত্ব দিয়েছেন সবার আগে। রবীন্দ্র সমসাময়িক প্রায় সকল কবিরই এ ক্ষেত্রে স্বদেশের গান রচনার এই সহজ সুরের বিষয়টি অনুধাবনযোগ্য।
তাই সকলের সাথে সমস্বরে গাইবার উপযোগী। এ প্রসঙ্গে স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মন্তব্যে বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ-এঁদের সকলেরই দেশাত্মবোধক গানগুলি’র সুর খুব সহজ সরল, অথচ আবেগদীপ্ত। সুরের সূক্ষ্ম কারুকর্মে এই গানগুলি রচিত হলে সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয়ে শিকল ভেঙে মন্ত্র সাধনে সক্ষম হবে না।
এ প্রসঙ্গে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর মন্তব্যে বলেছেন গানগুলি সুরের দিক দিয়ে খুবই সরল ও অনাবশ্যক অলঙ্কার বিবর্জিত, সেজন্য সম্মেলক গানের উপযুক্ত। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানসমূহে মূলত বিদেশি সুরের প্রভাব অধিক পরিলক্ষিত। এই বিদেশি সুরের সাথেই তিনি সংমিশ্রণ করেছেন লোকসুর কখনো শাস্ত্রীয় সুরের অভিজ্ঞতাকে। ঠিক একই ধারা তিনি প্রবর্তন করেছেন তাঁর স্বদেশি গানে।
ইংরেজি গানের সোজা সরল সুরের ওঠানামার ঢং-টিও স্বদেশি গানের সুরকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে তাঁর গানে। তাই তাঁর স্বদেশি গানের সুরে একদিকে চোখে পড়ে লোক সুর আবার অন্যদিকে ইংরেজি সুরের অনুপ্রেরণা। এই দুই ধারার মিলনের নিপুণ প্রভাব পাই তাঁর স্বদেশপ্রেমের গানে
“ইংরাজি গানের স্বরগুলি সব সোজা সোজা, একটা স্বরের উপরে আর একটার নির্ভর নাই । প্রতিস্বর স্পষ্ট এবং স্বাধীন। …. ইংরাজী গানে আবার যেরূপ ভাবের বৈচিত্র্য আছে, হিন্দু সংগীতে তাহা নাই। কি করুণ, কি প্রেম, কি হাস্য, কি বীর সব রসই ইংরাজী পানে আছে। ইংরাজি সুর ধূমকেতুর মত কোথা হইতে আসিয়া চলিয়া যায়, তাহার ঠিকানা নাই…… যেন হাউয়ের মত একেবারে ঊর্ধ্বে উঠিয়া চলিয়া যায়,
বাঙালী সংগীতাদি একস্থানে শুইয়া মনে মনে স্বপ্নরাজ্য সৃষ্টি করে, ইংরাজী সংগীতাদি যেন পাইন বৃক্ষের ন্যায় সোজা সংযত নিয়মিত। ইংরাজী গানে সংযমের ভাব আছে, যাহা হিন্দু গানে নাই,…..একটি উন্মীলনোন্মুখ, অপরটি অর্ধনিমীলিত।
একটি জাগরণ, অপরটি তন্দ্রা … একটি দিবা, অপরটি সন্ধ্যা……একটি যেন প্রভাত আকাশে উড্ডীন স্বরসুধাবর্ষী পাপিয়া, অপরটি যেন নিভৃত নিকুঞ্জে কলকণ্ঠ কোকিল; একটি আশাময়ী, উন্মুখী সূর্যমুখী, অপরটি সভয়া, • বিনতনয়না অপরাজিতা। এই উদ্ধৃতির মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয় ইংরেজি গানের প্রতি তিনি কতোটা অনুরাগী ছিলেন।
আর এই গানের রীতিকে তিনি স্বদেশি গানের সুরের প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করতেন বলেই তাঁর স্বদেশি গানের অনেকাংশে ইংরেজি গানের সুরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্র সমকালীন এই কবির মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের মতো বিদেশি সুরের প্রতি প্রেম এবং সেই সুরকে অতি নিপুণ ও যথার্থভাবে বাংলা গানে প্রয়োগের সাবলীল প্রচেষ্টা লক্ষণীয় এবং এর উপস্থাপন অত্যন্ত প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছিল।
যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাকালের প্রথম পর্যায়ে বিলেত থেকে ফেরার পর বিদেশি সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগটি যেভাবে পরিলক্ষিত হয়, পরবর্তীকালে তেমনভাবে তিনি এ সুর আর গ্রহণ করেননি।
কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সারাজীবন কোনো না কোনোভাবে তাঁর গানের সুরে ইংরেজি সুরের ঢং-টি প্রয়োগ করেছেন নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্যতায়। তাঁর মতো করে সেই সময়ের অনেকের সৃষ্টিতেই এই প্রভাবটি পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. উৎপলা গোস্বামীর নিচের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে
“দেশী রাগের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নানাবিধ সুরের মিশ্রণ ব্যবস্থা বাংলা গানে একটি ঐতিহ্যসম্পন্ন সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল-সকলেই বৈচিত্র্য আনার জন্য বাংলা গানে বিদেশি সংগীতের সুর ও ছন্দ এনেছেন। কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের উৎসমুখ খুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর গানে বিবিধ সুরের মিশ্রণ থাকলেও তা মার্গসংগীতের বিশুদ্ধ ছাঁচে ফেলেই তৈরি। বাংলা পল্লীসংগীতের সুর, বিশেষভাবে বাউল, কীর্তন তো তিনি গ্রহণ করলেনই দেশীয় সুরের মিশ্রণের সঙ্গে তিনি বিদেশি সুরও আনলেন। সুরের অপূর্ব মিলনে বাংলা গানের জগতে সৃষ্টি হল একটি বিশেষ সংগীতরীতি। ” দ্বিজেন্দ্রলাল রায় উপলব্ধি করলেন যে আমাদের কিছু রাগ-রাগিণীর ওঠা-নামাতেও বিদেশি সুরের ধরনটি লক্ষণীয়।
সরল ও তুলনামূলকভাবে হাল্কা ছন্দ বা তালের রাগ ঝিঁঝিট, খাম্বাজ, সুরট খাম্বাজ প্রভৃতিতে সুরের ওঠা-নামাতে বিদেশি সুরের লক্ষণটি অনুধাবনযোগ্য। তিনি নিজেই এই সকল রাগ- রাগিণীর সাথে বিদেশি সুরের সংমিশ্রণের এক অভিনব ও স্বতন্ত্র অবয়ব গড়ে তোলেন। যেখানে রাগ- রাগিণী তাদের স্বরূপটি রক্ষা করে চলতে পারে এবং ইংরেজি গানের বৈশিষ্ট্যও সুরের মধ্যে পরিলক্ষিত হবে।
এই ব্যতিক্রমী ভাবনারই প্রয়োগ তিনি করেছেন তাঁর স্বদেশপর্যায়ের কিছু গানে। অসাধারণ এই গানসমূহে নিপুণ ভালোবাসায় তিনি দেশীয় রাগ-রাগিণীর সাথে বিদেশি তথা ইংরেজি সুরের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। এই অভিনব সুরভাবনা ও এর প্রয়োগ তাঁকে অনন্য এক কৃতিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
স্বদেশপর্যায়ের বা দেশপর্বের গানের সুরে বিদেশি সুর ও রাগ-রাগিণীর যৌথ আভাস পরিলক্ষিত হয় তার একটি তালিকা নিচে প্রদান করা হলো :
স্বদেশপর্যায়ের গানে বিদেশি সুর ও রাগ-রাগিণীর আভাস
উপরের উদাহরণ থেকে বুঝতে পারা যায় যে স্বদেশি গানে ব্যবহৃত রাগ-রাগিণীর মধ্যে ইমন, ভূপালী ও কেদার রাগটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। মূলত এই সকল রাগ-রাগিণীর চলন পদ্ধতিটি বিদেশি সুরের চলার গতির মতো। অর্থাৎ সুরের ওঠা-নামাতে বিদেশি সুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই উল্লেখিত রাগে রচিত গানগুলোর লাফিয়ে চলার গতির কারণে প্রায় বিদেশি সুরের গান বলে মনে হয়। স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেয়া একটি উদাহরণে বিষয়টি বোঝানো সহজ হবে।
ইমন-ন ধ প ক্ষ গর, র গ ম র ন র স (উভয় মধ্যম ও নিষাদ প্রবল)।
কেদার-সম, মগ, প, ক্ষ প ধ ম গ প ধ র্স (উভয় মধ্যম, মধ্যম প্রবল)।
ভূপালী স র গ প ধ র্স ধ প গ প ধ প গ র স (মধ্যম বর্জিত ধৈবত প্রবল)।
যদিও বেহাগ, খাম্বাজ, ঝিঁঝিট, বাগেশ্রী, বাহার, ভৈরবী ও নটমল্লার তাঁর প্রিয় রাগ। কিন্তু স্বদেশি গানের বেলায় তিনি উপরোক্ত রাগগুলো ব্যবহার করেছেন বেশি। দেখা যাচ্ছে যে, এই প্রতিটি রাগের মধ্যেই একটু লাফিয়ে চলার প্রবণতা আছে ইংরেজি সুরের মতো। তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও এই শ্রেণির রাগের প্রয়োগে বিদেশি সুরের একটি আলাদা ধারা সৃষ্টি করেছেন-যা একান্তই তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে।
এই গানগুলিতে দ্বিজেন্দ্রলাল ভারতীয় রাগ-রাগিণীকে আশ্রয় করেছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে উঠে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিদেশি সুরের ও ভারতীয় রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে রচিত গানগুলো এমনই এক বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি যা মূলত অন্য কোনো ধারার সাথে মেলানো মুশকিল। রাগমিশ্রিত হওয়া স্বত্ত্বেও সুরের মহিমায় এতে কোনো রাগই প্রবল হয়ে ওঠে না।
সংগীতের এই প্রাণোচ্ছল শক্তি আমাদের দেশে ছিলো না। দ্বিজেন্দ্রলাল এই প্রাণশক্তি ইউরোপীয় সংগীত থেকে আত্মসাৎ করে বাংলা গানে সঞ্চার করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছোটবেলা থেকে তাঁর বাবার কাছে হিন্দুস্তানি গান শিখলেও হুবহু অনুকরণ তাঁর স্বভাবে ছিলো না। নিজস্ব ছোঁয়ায় তাকে হতেই হয়েছে দ্বিজেন্দ্রগীতি। হিন্দুস্তানি সুরের আগে ইংরেজি সুরের সংমিশ্রণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তবে এই ইংরেজপ্রীতির জন্য তাঁকে সাহিত্য-রসিকদের অনেক কটুবাক্য সইতে হয়েছে। অক্ষয়কুমার সরকারের একটি ভাষণের কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি :
“য়ুরোপের সঙ্গীতে মীড় মূর্ছনা নাই, এমন নয়, আছে, অল্প আছে-সেই সঙ্গীত প্রধানতঃ খাড়া সুরে গড়া। ভারতবর্ষ মীড় মূর্ছনার দেশ। বাঙ্গালা আবার ভারতের ভারত-বাঙ্গালীর কীর্ত্তনের সুর কেবল মীড় মূর্ছনায় পরিপূর্ণ। … আমার বর্তমান দুঃখ নবযুবকদলের মধ্যে ইংরেজি সুরের সঙ্গীতচর্চা দেখিয়া।… যে সুরের কথা আমি বলিতেছিলাম, সেটি প্রধানতঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কর্তৃকই নব্যসমাজে প্রচারিত হইয়াছে।
আমার কথা দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকৃত ও প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেমিক হইলে, তিনি খাড়া সুর বাঙ্গালায় চালাইতে চেষ্টা করিতেন না। তবে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। রবীন্দ্রনাথ নিজেই যেহেতু বিলেত ফেরত, পরবর্তী অবস্থায় তাঁর গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য রচনাসহ অনেক গানে বিদেশি সুরের ব্যবহার করেছেন।
তাই দ্বিজেন্দ্রলালের এহেন গুণের তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং এই সংযোজনে হিন্দুস্তানি গানের আরো উন্নতি সাধন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর প্রতিবাদপূর্ণ এবং তাঁর কাজের প্রশংসাবাহী বক্তব্যটি তুলে ধরা হলো-
“দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য একটি নতুন ঢঙের সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তাতে করে হিন্দুসঙ্গীতের ধর্ম নষ্ট হয়নি-কেননা ওস্তাদি ঢং ভারতবর্ষীয় সঙ্গীতের একমাত্র ঢং নয়। … দ্বিজেন্দ্রলালের সুরের বিশেষত্ব এবং নূতনত্ব এই যে, সে সুরের ভিতর অতি সহজে একটি বিলেতি চাল চলে এসে পড়েছে। …আর্টের সৃষ্টির পদ্ধতি হচ্ছে Organic। দ্বিজেন্দ্রলালের হিন্দুসঙ্গীতের ন্যায় ইউরোপীয় সঙ্গীতেও পরিচয় ছিলো।
তাঁর অন্তরে এই দুয়ের অলক্ষিত মিলনের ফলে তাঁর সুরের সৃষ্টি। দ্বিজেন্দ্রলাল যে নূতন ঢঙের নবসুরের সৃষ্টি করেছেন, সে সুর তাঁর মগ্ন চৈতন্যে, দেশি ও বিলাতি সুরের নিগূঢ় মিলনে সৃষ্টি হয়েছে।
আরও দেখুন :