আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সুর সমাবেশ
সুর সমাবেশ
সুর সমাবেশ
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসঙ্গীত বা পাশ্চাত্য) সঙ্গীতের ভিত্তির উপরই রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রতিষ্ঠিত। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পর্বে যে কথা বলেছিলেন, এই প্রসঙ্গে তা স্মরণযোগ্য। “আমি বলবো, আমি কাউকে জানি না, কাউকে মানি না; আমরা যা কিছু সৃষ্টি করি না কেন, তার মধ্যে ভারতীয় ধারা অপনি থেকে যাবে। আমাদের সেই আত্মা, সেই ভারতীয় প্রকৃতি তেমনি আছে যেমন পূর্বতনকারে কীর্তনগানে বাউলে ছিল।
সেই-রকম আজ যদি বাঙ্গালী আপনাকে সঙ্গীতে চিত্রকলায় প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে, সেই প্রকৃতিকে লঙ্ঘণ করতে পারবে না- যদি একমাত্র লক্ষ্য থাকে যা কিছু করবে নিজেকে মুক্ত করে- নকল করে নয়।”
এ উক্তির মধ্যে নিশ্চয়ই বহুদিনের সাধনা ও অভিজ্ঞতার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু একথা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ‘নিজেকে মুক্ত করা: প্রবণতাই নকল করা থেকে দূরে রেখে তাঁকে নুতন সৃষ্টির কাজে সাহায্য করেছে। বাল্মীকি-প্রতিভার সুর-সমাবেশের আলোচনা-প্রসঙ্গে প্রথমেই লক্ষ্য করা যায় যে, এই গীতিনাট্যে তিনি প্রায় ২৭টি রাগ-রাগিনী ব্যবহর করেছেন। এর মধ্যে ৮টির মতো মিশ্ররাগের পরিচয় পাওয়া যায়। সুরারোপের দিক থেকে গানগুলি সন্নিবেশ করা গেল:
প্রথম দৃশ্য
১. সহে না সহে না কাঁদে- সিন্ধু কাফি
২. আঃ বেঁচেছি এখন মিশ্র সিন্ধু
৩. এনেছি মোরা এনেছি- মিশ্র ঝিঁঝিট
৪. আজকে তবে মিলে কাফি
৫. এক ডোরে বাঁধা- খাম্বাজ
৬. এখন করব কী বল- পিলু
৭. শোন তোরা তবে শোন্ ঝিঁঝিট
৮. ত্রিভুনমাঝে বে, বতী
দ্বিতীয় দৃশ্য
৯. রাঙাপদপদ্মযুগে- বাগেশ্রী
১০. দেখো হো ঠাকুর– কাফি
১১. নিয়ে আয় কৃপাণ- কানাড়া
১২. কী দোষে বাঁধিলে- ঝিঁঝিট
১৩. এ কেমন হলো- সিন্ধু ভৈরবী
১৪. আরো কী এত ভাবনা- পরজ
তৃতীয় দৃশ্য
১৫. ব্যাকুল হয়ে বনে বনে- খাম্বাজ
১৬. ছাড়ব না ভাই- মিশ্র বাগেশ্রী
১৭. রাজা মহারাজা কে জানে কানাড়া
১৮. আছে তোমার বিদ্যেসাধ্যি জানা- খাম্বাজ
১৯. আঃ কাজ কি গোলমালে মিশ্র সিন্ধু
২০. হা, কী দশা- গারা ভৈরবী
২১. এত রঙ্গ শিখেছ- ভাটিয়ারী
চতুর্থ দৃশ্য
২২. রিম্ ঝিম ঘন ঘন রে-মল্লার
২৩. কোথায় জুড়াতে আছে- বেহাগ
২৪. কেন রাজা ডাকিস- সুরট
২৫. এইবেলা সবে মিলে- ইমনকল্যাণ
২৫. কে এলে আজি-মিশ্রমল্লার
পঞ্চম দৃশ্য
২৬. জীবনের কিছু হল না- হাম্বীর
২৭. দেখ দেখ দুটো পাখি মিশ্র পূরবী
২৮. থাম্ থাম্ কী করিবি – সিন্ধু ভৈরবী
২৯. কি বলিনু আমি বাহার
৩০. এ কি এ, এ কি এ- ভূপালী
৩১.শ্যামা, এবার ছেড়ে- রামপ্রসাদী
৩২. কোথা লুকাইলে টোড়ী
৩৩. কেন গো আপন- সিন্ধু
৩৪.কোথায় সে ঊষাময়। টোড়ী
৩৫. বাণী বীণাপাণি ভৈরো
৩৬. এই যে হেরি গো দেবী- বাহার
এই তালিকার দিকে লক্ষ্য রেখে বলা যায়- বাল্মীকিপ্রতিভার সুরযোজনার মূল বিশেষত্বগুলি যথাক্রমে:
১. সবগুলি গানই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর উপর প্রতিষ্ঠিত।
২. কোনো বিশেষ আদর্শের অনুসরণে অধিকাংশ সুরারোপ করা হয়েছে।
৩. গানগুলি রাগ-রাগিনীতে রচিত হলেও নাটকের প্রয়োজনে সেগুলি নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ এই গীতিনাট্য রচনা করার সময় এই রাগ রাগিনীগুলির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মানময়ী’ এবং ‘কান্ত উৎসবে’ বিশেষ করে ‘মানময়ী’তে, যতগুলি রাগ-রাগিনীর ব্যবহার হয়েছে তার প্রায় সবগুলিই বাল্মীকিপ্রতিভায় ব্যবহৃত। উনিশ শতকের গীতিনাট্যের আলোচনা-প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, ঐসব গানেও রাগ-রাগিনীর ব্যবহার রয়েছে।
৫২টির মতো রাগ-রাগিনীর ব্যবহার ঐসব গীতিনাট্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কয়েকটি অপ্রচলিত রাগ, যেমন- কুকুভ, সরফর্সা, লুম, গারা ইত্যাদি কোনো কোনো গীতিনাট্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাল্মীকিপ্রতিভার মধ্যেও ঐসব রাগ-রাগিনীর ব্যবহার আছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু মিশ্র রাগেরও পরিচয় পাওয়া যায় ঐসব গীতিনাট্যে।
যেমন- সুরুট-খাম্বাজ, ললিত-যোগিয়া, ঝট-রামকেলি, ঝিঁঝিট খাম্বাজ, কানাড়া বসন্ত, গৌড়-সারাং, ভৈরব-বাহার, পঞ্চম-বাহার, সোহিনী-বাহার, পরজ-কালাংড়া ইত্যাদি। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও মিশ্ররাগের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে ।
এই গীতিনাট্য মূলতঃ শিক্ষানবিশির ফসল বলেই, খুবই স্বাভাবিক যে, এই গানগুলিতে কোনো-না-কোনো আদর্শের অনুসরণে সুর-যোজনা করা হয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া গেল:
পুরোবর্তী আদর্শ
- অহো! আস্পর্ধা একি দারা দ্রিম তানা না
- এই যে হেরি গো দেবী- মনকী কমলদল গোলিয়া
- রিম্ ঝিম্ ঘন ঘন রে- রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি
- হা, কী দশা হলো আমার হাল মে রবে রবা
- এই বেলা সবে মিলে- চতুরঙ্গ রসঘন
- আয় মা আমার মা একবার দাড়া গো হেরি চন্দ্রানন
- থাম্ থাম্ কী করিবি যে যাতনা যতনে
রাগতাল
- বেহাগ, ত্রিতাল
- বাহার, ত্রিতাল
- মল্লার, ত্রিতাল
- বেহাগ-খাম্বাজ ত্রিতাল
এছাড় ‘শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা’ গানটি রামপ্রসাদের গানের আদর্শে রচিত। তেলেনা গানের অনুসরণে এই বেলা সবে মিলে’ গানটি রচনা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি গানে অনুরূপ ঙ চোখে পড়া বিচিত্র নয়। কে এল আজি এ ঘোর নিশীথে’ গানটিও এ ভরা বাদর’ গানের সুর অনুসরণ করেছে। ইন্দিরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথার মধ্যে বলেছেন যে, তৎকালীন ব্যান্ডসঙ্গীতের আদর্শেও কোনো কোনো গান রচিত।
যেমন এনেছি মোরা এনেছি মোরা’ গানটি। সম্ভবতঃ শুধু দস্যুদের সমবেত গানেই এই প্রভাব পড়েছে। তবে আয় সবে আয়’ গানটিও এদিক থেকে স্মরণীয়। তা ছাড়া তিনি প্রত্যক্ষভাবে ‘মরি ও কাহার বাছা’ এবং ‘কালী কালী বলো রে আজ’ গানদুটি যে যথাক্রমে টমাস ম্যুরের Go where glory waits thee’ এবং স্টিফেন অ্যাডস্-এর ‘Nancy Lee’-র আদর্শে রচিত।
মূল গানের সুর বা তাল তিনি গীতিনাট্যের গানের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবানুযায়ী ব্যবহার করেছেন। মূল সুরের বিকৃতি বা ব্যতিক্রম প্রায় ঘটে নি বললেই হয়। যেমন ‘অহো আস্পর্ধা একি’ গানটি মূলেও ছিল বেহাগে। টমাস ম্যুর বা স্টিফেন অ্যাডস্-এর গান দুটির সুরও যথাযথভাবে বজায় রাখা হয়েছে। Nancy Lee গানটির প্রথমে নির্দেশ রয়েছে ‘with Spirit’ এবং বলাই বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ উদ্দীপনামূলক সুর হিসেবেই তা ব্যবহার করেছেন।
প্রাসঙ্গিকবোধে জীবনস্মৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য স্মরণ করা যায়- ‘এই দেশী ও বিলাতী সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীকিপ্রতিভার জন্ম হইল। ইহার সুরগুলি অধিকাংশই দৈশি, কিন্তু এই গীতিনাট্যে তাহাকে তাহার বৈঠকি মর্যাদা হইতে অন্যক্ষেত্রে বাহির করিয়া আনা হইয়াছে; উড়িয়া চলা যাহার ব্যবসায় তাহাকে মাটিতে দৌড় করাইবার কাজে লাগানো গিয়াছে।
যাঁহারা এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়াছেন, তাঁহারা, আশা করি, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, সঙ্গীতকে এইরূপ নাট্যকার্যে নিযুক্ত করাটা অসঙ্গত বা নিষ্ফল হয় নাই। বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্যের ইহাই বিশেষত্ব। ‘
বাল্মীকিপ্রতিভার সুর-সমাবেশের এইটেই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক যে, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের রাগ-রাগিনীগুলিকে সর্বপ্রথম এই গীতিনাট্যে নতুনরূপে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, এ সঙ্গীত অভিনয়ের সঙ্গে কানে না শুনলে এর কোনো স্বাদগ্রহণ সম্ভবপর নয়।
এদিকে লক্ষ্য রেখে বলা যায়, রাগ-রাগিনীগুলি যেখানে যে ভাবের সঙ্গে খাপ খায়, সেখানে তিনি সেইভাবেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কথার সঙ্গে রাগ- রাগিনীর রূপটি ঠিকমতো বজায় রেখেও এমনভাবে সাজিয়েছেন, যার ফলে রাগ-রাগিনীর চরিত্র বদলে গেছে। কথার (তাবের) সঙ্গে মিলিয়েই রাগ-রাগিনীগুলি ব্যবহার করেছেন; যেখানে তা হয় নি সেখানে সুরকে ছন্দের বা তালের সাহায্যে জোড়ালো করেছেন, বা তার চাল বদলে দিয়েছেন।

দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটি গানের উল্লেখ করছি:
১. সহে না সহে না কাঁদে পরান- সিন্ধু কাফি
২. আয় মা আমার সাথে ভৈরবী
৩. রিম্ রিম্ ঘন ঘন রে মল্লার
8. কোথায় জুড়াতে আছে ঠাঁই বেহাগ –
৫. রাঙ্গাপদ-পদ্মযুগে- মিশ্র বাগেশ্রী ইত্যাদি।
এই গানগুলিতে প্রচলিত প্রথাকে যথাযথ বজায় রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত সাঙ্গীতিক শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনেছেন বা বলা যায়, প্রচলিত প্রথাকে লঙ্ঘন করেন নি। কিন্তু আসল কৃতিত্ব এখানে নয়, এই কৃতিত্ব একই রাগ-রাগিনীকে নানাভাবে ব্যবহারের মধ্যে- কোথাও জোরালো, কোথাও বা কোমল। দৃষ্টান্ত হিসেবে সিন্ধুতে রচিত কয়েকটি গানের উল্লেখ
করা গেলো:
১. সহে না সহে না কাঁদে পরান- সিদ্ধ কাফি
২. আঃ বেঁচেছি এখন- মিশ্র সিন্ধু
৩. এ কেমন হল মন- সিন্ধু ভৈরবী
8. কেন গো আপন মনে- সিন্ধু
ভৈরব রাগের অন্তর্গত সৈন্ধবী বা সিন্ধুকে কিভাবে ব্যহার করা হয়েছে তা লক্ষ্য করার মতো। ভৈরব রাগের অন্তর্গত বলে সিন্ধুর আবেদন করুণ রস। এর ধ্যান-বর্ণনায় তার পরিচয় রয়েছে, যেখানে রূপ-কল্পনার মধ্যে বৈরাগ্যেং চিত্র অঙ্কিত। অনুরূপ ভাবে ঝিঁঝিটে কয়েকটি গানের দৃষ্টান্ত স্মরণযোগ্য:
১. এনেছি মোরা এনেছি মোরা- “মশ্র ঝিঁঝিট
২. শোন তোরা তবে শোন- ঝিঁটি
৩. কী দোষে বাঁধিলে আমায় ঝিঁঝিট
কালমৃগয়া
উপরুক্ত আলোচনারই সূত্র ধরেই কালমৃগয়া গীতিনাট্যের আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যায়। এই গীতিনাট্যের ৩৯টি গানের মধ্যে ৯টি গান পরিবর্ধিত বাল্মীকি প্রতিভার মধ্যে স্থান পেয়েছে। বাকী ৩০টি গানের রাগ সমাবেশ যথাক্রমে:
১. বেলা যে চলে যায় মিশ্ৰ ভূপালী
২. ও ভাই দেখে যো- মিশ্র খাম্বাজ
৩. ও দেখবি রে ভাই- মিশ্র খাম্বাজ
৪. কাল সকালে মিশ্র বিভাস
৫. সমুখেতে বহিছে তটিনী- সিন্ধু
৬. ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে- কেদারা
৭. নেহার লো সহচরী- ছায়ানট
৮. জল এনে দে রে বাছা জয়জয়ন্তী
৯. না না কাজ নেই- দেশ
১০. আমা-তরে অকারণে- খাম্বাড।
১১. সঘন ঘন ছাইল- মিশ্র মল্লার
১২. আয় লো সজনী- মল্লার
১৩. কী ঘোর নিশীথ- গারা
১৪. জয়তি জয় জয় রাজন- সিন্ধুড়া
১৫. না জানি কোথা এলুম- লুম-খাম্বাজ
১৬. হায় কী হল- ভৈরবী
১৭. কী করিমু হায় বেহাগ
এই তালিকার অনুসরণে বলা যায়, এই গীতিনাট্যে ২৬টির মতো রাগ-রাগিনী ও ১৮টির মতো মিশ্ররাগ ব্যবহৃত। এখানেও ভাবানুযায়ী রাগ-রাগিনীগুলি সংযোজিত।
প্রথমটির ক্ষেত্রে গানই মুখ্য; দ্বিতীয়টি সংলাপেরই সহযোগী; শেষেরটিতে সংলাপের বক্তব্য পুনর্বর গানের মধ্যে প্রকাশিত। বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্যে আসলে সঙ্গীত (সুর) ঐ সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। কালমৃগয়াও সমজাতীয় রচনা। তবে নাটকীয়তার দিক থেকে তেমন বিশেষ চমৎকারিত্ব নেই। দৃশ্যবন্ধের মধ্যে শৈথিল্য চোখে পড়ে।
এখানে সঙ্গীত (সুর) নাট্যরসের সহায়ক হয়ে উঠেছে। মায়ার খেলা ঠিক এর বিপরীতে। গীতিনাট্যের গানগুলি এককভাবে সাধারণতঃ গাওয়া হয় না। মায়ার খেলার গানগুলি কিন্তু বিছিন্নভাবে বা এককভাবে গাইবার বিশেষ উপযোগী অর্থাৎ স্বতন্ত্র সঙ্গীতের মাধুর্য রয়েছে।
এ দিকে লক্ষ্য রেখেই শ্রীশান্তি দেব ঘোষ ঠিকই বলেছেন যে, ইতালীয় অপেনার সঙ্গে এই গীতিনাট্যের মিল রয়েছে। বস্তুতঃ বাল্মীকিপ্রতিভাব গানগুলি নাট্যপ্রধান এবং মায়ার খেলার গানগুলি আবেগ -প্রধান। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণযোগ্য:
বাল্মীকিপ্রতিভা থেকে
প্রথম দস্যু – আজকে তবে মিলে সবে করব লুটে ভাগ-
এ-সব আনতে কত “ন্ডভন্ড করনু যজ্ঞ-যাগ
দ্বিতীয় দস্যু – কাজের বেলায় উনি কাথা যে ভাগে,
ভাগের বেলায় আসেন আগে আরে দাদা
প্রথম দস্যু – এত বড়ো আস্পর্ধা তোদের, মোরে নিয়ে এ কি হাসি-তামাশা।
এখখনি মুণ্ড করিব খা, খবর্দার রে খবদার!
মায়ার খেলা থেকে-
সখীগণ – অলি বার বার ফিরে যায়,
অলি বার বার ফিরে আসে-
তবে তো ফুল বিকাশে।
প্রথমা – কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না,
মরে লাজে, মরে ত্রাসে।
বাল্মীকি প্রতিভা হচ্ছে গানের আকারে সংলাপ- মায়ার খেলা সংলাপের ছলে গান: রবীন্দ্রনাথের কথায় গানের সূত্রে নাট্যের মালা এবং নাট্যের সূত্রে গানের মালা। বাল্মীকি প্রতিভার এই সংলাপধর্ম আবার অন্য দুখানি গীতি-নাট্যের তুলনায় অনেক বেশী; বাক-রীতির সঙ্গে অভিন্ন:
- বালো হো হো হো
- হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
- রাখো রাখো রাখো বাঁচাও আমায়
- দূর দূর দূর, আমরে আর হুঁস ন
- এ পাপ আর না, আর না, আ: না
কালমৃগয়াতে এই বৈশিষ্ট্য নেই। মায়ার খেলাতে মাত্র একটি গানে (ভালোবেসে দুখ সেও সুখ) এই বিশেষত্ব চোখে পড়ে (যেমন- না না না, সখা; মন দাও দাও, দাও সখী)। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয়- নৃত্যনাট্যের গানের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আরও দেখুন :