আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সেনাবাহিনীতে যোগদান
সেনাবাহিনীতে যোগদান
সেনাবাহিনীতে যোগদান
বর্ধমানে শিয়ারসোল স্কুলে পড়ার সময় নজরুল তাঁর শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের সংস্পর্শে আসেন। নিবারণচন্দ্র ঘটক মূলত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন। নিবারণচন্দ্র ঘটকের সংস্পর্শেই কবি স্বদেশ তথা ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর আত্মিক অনুরাগ উপলব্ধি করতে পারলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর মনে আগ্রহ জন্মাতে থাকে।
তখনই তাঁর মনে স্বদেশ নিয়ে বহুবিধ ভাবনা জট বাঁধতে থাকে এবং তাঁর লেখনির মাধ্যমে সেগুলো প্রকাশ করতে থাকেন। স্বদেশের প্রতি প্রেমবোধ করি এই সময়টাতেই উপলব্ধি করেন। অনেকের মতে শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের অনুপ্রেরণাই তাঁকে স্বাধীনতার জন্য লেখায় উৎসাহিত করে। এমনকি এই উৎসাহ উদ্দীপনাই নজরুলকে ব্রিটিশবাহিনীতে যোগদানে তাড়িত করেছিল।
নিবারণচন্দ্র ঘটক ছিলেন গুপ্ত বিপ্লবী সংঘ যুগান্তরের সদস্য। তাই তিনি চাইতেন নজরুল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হয়ে বিপ্লবী তরুণদের যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়ে দেশমাতাকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত করুক। নজরুল নিবারণচন্দ্র ঘটকের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং যুদ্ধে চলে গেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাংলা ছাড়া অন্য সকল প্রদেশের রেজিমেন্ট ছিলো।
বাঙালি সেনাদের নিয়ে রেজিমেন্ট গঠনের দাবি উঠলে ইংরেজদের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করবার সেনাবাহিনী গঠনের জন্যে ইংরেজ সরকার বাঙালি পল্টন গঠনের দাবি মেনে নিলেন। সর্বত্র শুরু হলো বাঙালি সৈন্য সংগ্রহের অভিযান। পাড়ায় পাড়ায় পোস্টার লাগানো হলো সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বানে। শিয়ারসোল স্কুলের শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন নজরুল।
তাই দশম শ্রেণির ছাত্র নজরুল এ সুযোগটিকে হাত ছাড়া হতে দিতে রাজি নন। এই সুযোগ সরাসরি সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজেকে দেশের স্বার্থে যোগ্য করে তুলবার। দশম শ্রেণির প্রি-টেস্ট সন্নিকটে, সবকিছু বাদ দিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্যে। মূলত সশস্ত্র ইংরেজবিরোধী সংগ্রামে সমগ্র বাংলাকে মুক্ত করবার সুদূরপ্রসারী ভাবনায় নজরুল শারিরীক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী হন।
স্বদেশপ্রেমী নজরুল জানতেন সেদিন বহু দূরে নয় যেদিন ইংরেজবাহিনী এ বাংলা অর্থাৎ সমর্থ ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হবে এবং সে লক্ষ্যেই স্বাধীনতার কল্পনার বীজ বপন করতে থাকেন। নজরুলই একমাত্র কবি যে শুধু লেখনিশক্তিতে নয় বরং পেশীশক্তিতেও নিজেকে যোগ্য করে তুলবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।
সে লক্ষ্যেই তিনি রাণীগঞ্জ থেকে কলকাতায় এলেন এবং সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ হলো অগ্নিদীপ্ত তরুণ নজরুলের। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন। সেনাবাহিনীতে নজরুল তিন বছরকাল ছিলেন এবং এই সময়টি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
কলকাতা থেকে নজরুল নওশেরাতে প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পানির সাথে করাচি চলে আসেন। করাচি ব্যারাকেই তাঁর অধিকাংশ সময় কাটে। যদিও সরাসরি কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে যেতে হয়নি 1 তবে তাঁর কর্তব্যকর্মে প্রশংসনীয় ছিলেন তিনি। তাই খুব দ্রুত তিনি সেনাবাহিনীতে পদোন্নতিও লাভ করেন। অর্থাৎ তিনি খুব অল্প সময়েরই মধ্যে হাবিলদার মাস্টার হন।
সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন জীবনের এই তিনটি বছর নজরুলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশপ্রেমী নজরুলের কবিমন এখানেই প্রকৃত অর্থে পাখা মেলতে থাকে। যেহেতু তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে হয়নি, তাই জীবনের এই স্থিরতা তাঁকে অফুরন্ত সময় এনে দেয়। সুযোগ করে দেয় প্রতিভা বিকাশের, কাব্যচর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টির।
করাচি ব্যারাকেই তাঁর চলতে থাকে অবিরাম গল্প, কবিতা রচনার উৎসব। কলকাতার পত্রপত্রিকাতেও তখন করাচি থেকে পাঠানো তাঁর গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। উদীয়মান এই কবিকে সকলে সাদরে গ্রহণ করে নেন। জীবনে প্রথম রচিত গানও তাঁর স্বদেশপ্রেমের গান, যেটি করাচি থেকে লেখা। সওগাত পত্রিকাতে সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

বসন্ত সোহিনী রাগে ও দাদরা তালে গ্রথিত এ গানটি সওগাত, ২য় বর্ষ, বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এটিকে নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গানটি বিষের বাঁশী কাব্যে সংকলিত হয়।
“বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও
ভীম বস্ত্র-বিষাণে দুর্জয় মহা আহ্বান তর।
বাজাও! অগ্নি-তুৰ্য্য কাঁপাক সূর্য্য।
আরও দেখুন :