নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

 

নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

 

নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

যে শিশুর কোমল মন নানাবিধ প্রতিকূলতা, অভাব আর সমাজের বহুবিধ অসংগতি দেখে বেড়ে ওঠে তাকে আলাদা করে জীবন বা প্রেমের সংজ্ঞা শেখানো বাহুল্যতা। প্রকৃতি তার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষাভাণ্ডার, প্রতিটি মানুষের আচরণ তাঁর গ্রন্থের এক একটি অধ্যায়। শিশুমনে তাই নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ, দেশের মানুষ তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

শৈশবজীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম তাঁকে বিপথগামী না করে, করেছেন সবার সম্মুখের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই আলোতে একদিন সমগ্র বাংলা আলোকিত হবে কে জানত। সংগীত, সুর আর অজানাকে জানবার অদম্য আগ্রহই সকল বাঁধাকে অতিক্রমের শক্তির সঞ্চারক হয়েছিল নজরুলের জীবনে। সেই শক্তিই তার স্বদেশপ্রেম বিষয়ক যেকোনো লেখনিতে ঝড় তুলেছিল।

নজরুলের রচনার সকল ক্ষেত্রেই এক চরমতার আভাস পাই সে হোক স্বদেশ বা প্রেম বা অন্য ধারা। প্রতিদিনের প্রকৃতি যে শিশুকে জীবন শেখায় তার কাছে দুর্বলতার কোনো ঠাঁই নাই। নজরুলের জীবন আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
মানুষের যেকোনো দুঃখ-কষ্টের মতো পরাধীন ভারতবাসীর অবরুদ্ধতার যন্ত্রণা নজরুলকে মর্মাহত করে দারুণভাবে।

তাই এর প্রতিরোধ তিনি প্রকাশ করেন একই তালিকায় অর্থাৎ বলিষ্ঠ চিত্তে। নজরুলপূর্ব কোনো কবি লেখনিতে এমন রক্তঝরা বাণীর ঝঙ্কার আমরা শুনতে পাইনি মূলত সেই একই কারণে। কারণ নজরুল যেভাবে জীবন দেখেছেন অন্য অনেক কবিই সেই জীবন কল্পনাও করতে পারেননি। হয়তো। জাতির জীবনের স্তরীভূত পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে আগুন জ্বলেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ নজরুল করেছিলেন তাঁর গানে বিদ্রোহের এক নবধারায়।

ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতবাসীর অপমান আর ব্যথাবেদনার কথা তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতেন এবং তা প্রকাশ করতেন বলিষ্ঠ চিত্তে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নজরুলের লেখনির মধ্যদিয়ে স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধের রূপটি সাধারণের কাছে ধরা পড়ে এবং মানুষের মনে তা স্থায়ী আসন সৃষ্টি করে। ঔপনিবেশিক কোন্দলের অগ্নিশিখায় জ্বলছিল তখন ভারতবাসীর মন।

সেই দহন জ্বালায় যেন ঘি ঢেলে দেয় নজরুলের উদ্দীপনা আর আশা জাগানিয়া সুর। সমগ্র ভারত জেগে উঠেছিল তরুণ লেখকের অগ্নিঝরা বাণীতে। প্রতিবাদে কম্পিত হয়েছিল নিপীড়িত অসহায় মানুষের মন। দরিদ্র ও অসহায়ের কবি নজরুল জানতেন সাম্য আর ঐক্যের বাণীই কেবল পারে অসম্ভবের পথকে সুগম করতে। নজরুলের স্বদেশপ্রেমের গানের মধ্যে যত আঙ্গিক পরিলক্ষিত হয় এমন আর কোনো কবির গানে চোখে পড়ে না।

নজরুলগীতি অখণ্ড-এ দেশাত্মবোধক ও উদ্দীপনামূলক নজরুলের যে ১০৯টি গান পেয়েছি তার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এই অধ্যায়ের মূল আলোচনা। প্রাপ্ত ১০৯টি গানকে আমি নিজের ভারনামতে শ্রেণিভুক্ত করেছি। আলোচনার সুবিধার জন্য সংগীতে নজরুল ইসলামের যে অসামান্য অবদান তা থেকে স্বদেশপর্বের গানসমূহের বৈচিত্র্য ও বিপুলতা নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হতে চাই।

তিনি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কতটা সফল তার স্বাক্ষর মেনে এই প্রজন্মের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার উপর। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ তাঁর এই গানটি যেমন সকল প্রজন্মের প্রাণ জাগানিয়া উদ্দীপনার ডাক তেমনি “শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ’-এর মতো গান প্রাণকে আন্দোলিত করে স্বদেশমাতৃকার বৈচিত্র্য রূপের মহিমায়। এ প্রসঙ্গে ড. করুণাময় গোস্বামীর উক্তিটি স্মরণীয়।

“বাংলা দেশাত্মবোধক গানের ধারায় স্বর্ণোজ্জ্বল অবদানের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর গান বিপুলতা, বৈচিত্র্য ও গভীরতার জন্য সমসাময়িককালে যেমন: অভিনন্দিত হয়েছে, পরবর্তীকালেও তা বাঙালি দেশাত্মবোধক গীতরচয়িতাদের অনুপ্রাণিত করেছে।

ভাষায়, সুরে ও ছন্দে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দেশাত্মবোধক গীতমালাকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন যে, তা শুধু সমকালীন আকাঙ্ক্ষাকেই পরিতৃপ্ত করেনি, দেশচেতনার স্থায়ী অনুভবকেও ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। রচিত হবার ষাট বছর পরেও, সেজন্য, এইসব গানের লোকপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল বা অতুলপ্রসাদের স্বদেশসংগীতের মতো নজরুলের দেশাত্মবোধক গানও বাঙালির চিরকালীন স্বদেশসংগীতে। পরিণত হয়েছে।

হারিয়ে ফেলা অতীতের মতো এ যুগেও নজরুলের স্বদেশপ্রেমের গানে ঐক্যের ধ্বনি শোনা যায়। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে তাঁর বিদ্রোহমূলক গানগুলোতে শোনা যায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আওয়াজ। তাঁর গানে সাম্যের বাণী ভুলিয়ে দেয় হিন্দু মুসলিম বিভেদ। ঠিক তেমনিভাবে দেশবন্দনার গানগুলোতে ঝিমিয়ে পড়া জাতি সজিব হয়ে ওঠে আপন উদ্দীপনায়।

নজরুলের স্বদেশপর্বের যে সকল গান রয়েছে তা নিয়েও খানিকটা মতভেদ রয়েছে। ড. করুণাময় গোস্বামীর নজরুল-গীতি প্রসঙ্গ গ্রন্থে সংখ্যার কোনো উল্লেখ নেই। উক্ত গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘নজরুলগীতি অখণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণে নজরুলের মোট ১১৫টি দেশাত্মবোধক গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আবার অন্যত্র ড. ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের নজরুলগীতি অখণ্ড সংস্করণে নজরুলের স্বদেশপর্বের গানের যে তালিকা রয়েছে তাতে ১০৯টি গানের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে ১০৯ থেকে ১১৫টির মতো নজরুলের স্বদেশপর্বের গান রয়েছে। যদিও এই সকল গানের মধ্যে স্বদেশের রূপটি ফুটে উঠেছে বহুবিধ বৈচিত্র্যতায়।

আলোচনার সুবিধার্থে নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার ভাবার্থ ব্যক্ত করবার প্রয়াসে স্বদেশপর্বের গানগুলোকে কয়েকটি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা প্রাসঙ্গিক মনে করি। যেমন-

 

নজরুলের গানে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ও পর্যালোচনা

 

১. শিকল ভাঙ্গার গান

২. বিজয়গাঁথার গান

৩. সাম্যবাদের গান

৪. নবযাত্রার আনন্দধ্বনি বার্তাবাহী গান।

৫. শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণের গান

৬. নারী জাগরণী গান

৭. দেশের গানে মাতৃরূপ দর্শন

৮. স্বদেশে বিশ্বরূপ লোকায়ণ

৯. স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

১০. দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গগীত

নজরুল ইসলামের স্বদেশি গান রচনার সময়টা ছিলো ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। এই ২২ বছরের রচনায় যে বাণী তিনি সর্বাগ্রে প্রকাশ করেছেন তা হলো সাম্যবাদ। যেখানে নেই কোনো ছোট-বড় ভেদ, নেই হিন্দু-মুসলমানের হানাহানি, নেই ধনী-গরিবের কোন্দল। পূর্বে আলোচিত চার কবি থেকে এই কবি একেবারেই ভিন্ন ধারায় স্বদেশের বাণী ব্যক্ত করেছেন।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

তাঁর প্রতিটি গানের বাণীতে কোনো করুণধারা নয়, বরং প্রচণ্ড গর্জনে অধিকার ছিনিয়ে আনার ঝঙ্কার শুনতে পাওয়া যায়। কখনো ইতিহাসের গৌরবগাঁথা, কখনো স্বদেশের কোমল রূপ-যাই ব্যক্ত করুন না কেন সম্পূর্ণ আলাদা এক স্বকিয়তা কবির ভাবনা প্রকাশ করার ভঙ্গিটি সকলে আপন করে নিয়েছে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment