স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

বিলেতে থাকাকালীন সময়ে উন্নত ইংল্যান্ডকে তিনি স্বচক্ষে দেখেন এবং নবজাগরণের সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্য পাঠ তাঁকে দিয়েছিল ব্যতিক্রমী নৈতিক দর্শন ও জীবনবোধ। যে কারণে ইংরেজদের তথা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াতে চাননি। তিনি মনে করতেন ইংরেজদের কাছ থেকে বাঙালির অনেক কিছু শিখবার আছে, নেবার আছে।

দেশের দুর্দশায় তিনি গভীর দুঃখ পেলেও এই দুঃখ-দুর্দশার কারণ নিরূপণে তাঁর ভাবনার অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। এসবের কারণ হিসেবে তিনি কখনই একা ইংরেজদেরকে দায়ী করতে রাজি ছিলেন না। তিনি কল্পনা করতেন বিলেতের মতো উচ্চশিক্ষায় দীক্ষা পাবে স্বদেশ। সাহিত্য-শিল্পে নিজেদের বিকশিত করতে ইংরেজদের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

ইউরোপের উন্নয়নের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন ভাবনা এদেশের মানুষের মনেও নবজাগরণের জোয়ার এনে দিয়েছিল। তাই তিনি স্বদেশকে ভালোবাসার সাথে স্বদেশে রাজনীতি তথা ইংরেজ শাসনকেও শ্রদ্ধা করতেন। যদিও আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবিক দিক বিবেচনায় যদি ইংরেজদের আগমন এ বঙ্গে না হতো হয়তো উন্নয়নের সূর্য অকল্পনীয় হয়ে থাকতো বা আরো বহু সময় লাগতো উন্নয়নের এ ধারায় আসতে।

অন্ধকারাচ্ছন্নতা ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ বাঙালিকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিলো ইউরোপীয় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র বাণী। যে বাণী বাঙালির মনোজগতের দুয়ার খুলে দিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত দেশপ্রেমের লক্ষণ এদের মধ্যে নেই। জাতীয় নেতাদের আপসকামী মনোভাবেও তিনি আহত হতেন। তিনি কেবল আবেগ দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে লড়তে বলেছেন। তাই তিনি লিখেছেন-

“তারপর এই সৌখীন বন্দেমাতরম্ ধ্বনির উপর আমার বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছে। এর সঙ্গে যে Sincerity নাই, Feeling নাই, তাহা আমি বলি না। কিন্তু সে Feeling ঐ বন্দেমাতরমেই নিঃশেষ হইয়া যায়; কাজ হয় না। কেবল ভাবপ্রবণতা, উত্তেজনা বা Feeling-কবির কাজ হইতে পারে, Patriot কর্মীর কাজ নহে। Patriot-এর কাজ স্বার্থত্যাগ, উৎসর্গ, সেবা ।

Principle-এর জন্য কয়জন দেশে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছে? দেশ উদ্ধার সন্ন্যাসীর কাজ, ত্যাগীর কাজ; ভোগী বা বিলাসীর কাজ নয়। আমাদের সেই ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। …হ্যাট টি পরিত্যাগ করিতে পারেন না. … সভাপতি না হইলে অহঙ্কারে কোন সভাতে পদার্পণ পর্যন্ত করেন না বলি, এসব কি দেশ-হিতৈষণা? এঁদের কি দেশের যথার্থ Leader বলিয়া মানিব?

কিছু ছাড়িতে চাও না, দেশ উদ্ধার করিবে Conference করিয়া, ধিক্!’ সাহেবদের দেবতা বর্ণনা করে কংগ্রেসী নেতাদের প্রতি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন-

আমরা বিলেতফের্তা কটায়,

দেশে কংগ্রেস আদি ঘটাই

আমাদের সাহেব যদিও দেবতা

তবু ঐ সাহেবগুলোকে চটাই।

দেশীয় শিল্পের উন্নতিতে ইংরেজদের নানাবিধ উদ্যোগের পক্ষে বাঙালির সামগ্রিক উন্নয়নে ইংরেজদের ভূমিকাকে তিনি অস্বীকার করতে নারাজ ছিলেন। দেশের দুর্দশায় তিনি বারবার দুঃখ পেয়েছেন তথাপি ইংরেজ হটাবার পক্ষে তিনি ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙালিদের মধ্যকার বিরাজমান হিংসা, রেশারেশি ও কুসংস্কার থেকে আত্মিক মুক্তি না করতে পারলে বাহ্যিক কোনো মুক্তিই প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দেবে না ।

যদিও অসংগতিপূর্ণ এ ভাবনা তাঁকে বহুবিধ সমালোচনার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। রাজশক্তির বিরুদ্ধে যারা তাঁকে দেশ ও স্বদেশের শত্রু বলে মনে করতেন, তাদের তৎপরতায় তিনি বহুবিধ জটিলতায়ও পড়েছেন। তবুও তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তিকে এদেশের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করতেন-মূলত দেশকে ভালোবাসার জন্যেই।

ব্রিটিশ রাজশক্তি বিস্তৃত হলে এদেশের আরো উন্নতি হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। এ যেন অন্ধ দেশপ্রেমের ভাবনাতুর এক উদাহরণ। এমন কি তিনি সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুতে শোক সংগীত’ রচনা করেন। এ প্রসঙ্গে শ্রী সুধীর চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন-

“ভাবতে একটু কষ্ট লাগে যখন জানি, সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুতে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে ‘গুণগ্রাহী শোক সঙ্গীত’ রচনা করে কোরাসের দল গঠন করে কলকাতার বিভিন্ন পথে পদব্রজে সেই গানটি গেয়ে পরিক্রমা করেছিলেন। উক্ত শোকসংগীতের উদাহরণ-

গিয়াছে চলি আজ বৃটন মহারাজ

রাখি এ বিদ্বেষ দ্বন্দ্ব,

ধর্ম কর আজ দুঃখ বেদনাই

কর্ম কর আজ বন্ধ।

এদেশে মানুষের মনে নবজাগরণের ভাবনার উদ্রেক হয় ইউরোপীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে। তাই তিনি ইংরেজদের কর্মকে কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক মনে করতেন। দ্বিজেন্দ্রলালের মনোভাব শেলী, শেক্সপিয়র, টমাস পেইন, ফ্রান্সিস বেকন ও হার্বাট স্পেন্সার-এর সাহিত্য ও দর্শনে মুগ্ধ ছিলো। তাই তিনি সেই সমৃদ্ধ ও উন্নত পাশ্চাত্য চেতনাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন স্বদেশপ্রেমের বেলাতেও।

স্বদেশকেও সেই জ্ঞানের আলোকচ্ছটায় আলোকিত করবার বাসনা ব্যক্ত করেছেন তিনি। এই জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে, উন্নয়নের জোয়ার থেকে বাঙালিকে আত্মাহুতি দিতে বাধা দিয়েছেন। স্বদেশভক্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা দ্বিজেন্দ্রলাল সেই ভাবনায় শত্রুকেও নিজের ও স্বদেশের কল্যাণের স্বার্থে সহ্য করবার কথা বলেছেন। তা সেই উত্তাল সময়ে কারোর পক্ষেই বোঝা সহজতর ছিলো না, বরং প্রায় সকলেই তাঁর ভাবনার সমালোচনা করেছেন।

নিজে স্বদেশপ্রেমী বলে সারাজীবন ইংরেজদের যে অত্যাচার সহ্য করেছেন তবুও তিনি বণিক ও ব্যবসায়ী ইংরেজদের চটাতে নিষেধ করতেন। কিন্তু এই বণিক শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী রূপ দেশের মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, দেশের মানুষকে নির্মমভাবে শোষণ ও অত্যাচার করত। পঞ্চম জর্জের অত্যাচারী শোষক চরিত্রটি পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকচ্ছটার পেছনে যে অন্ধকার লোলুপ রূপটি ছিলো তা দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশচেতনায় উপলুব্ধ হয়নি।

বরং তিনি মানবমনের জড়তা, সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদমূলক ভাবনাকে বড় শত্রু বলে বিশ্বাস করতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর স্নেহভাজন প্রমথনাথ ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণায় বলেন-

“তাঁহার রচিত নাটকের অনেক স্থানে আছে যে, প্রতিষ্ঠিত কল্যাণকর কোন রাজশক্তির বিরুদ্ধে যাহারা অযথা অস্ত্রধারণ করে তাহারা কেবল শান্তি ও ধর্মের শত্রু নহে তাহারা দেশ ও দশের শত্রু। … তিনি আরও বলিতেন যে, স্বদেশভক্ত লোকও যে রাজভক্ত হইতে পারে ইহা যাহারা না বুঝে তাহাদের উপরে দয়া হয়।

দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশি আন্দোলনের ভাবনাটি ছিলো রবীন্দ্রনাথের মতোই ব্যতিক্রমী ধারার এবং ভিন্ন। বাহ্যিক আন্দোলন থেকে আত্মশক্তি, আত্মসংগঠন এবং সার্বিক উন্নয়নকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি এবং মানবিকতা প্রতিষ্ঠাকে তিনি সারাজীবন সমর্থন করে গেছেন। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ দূর না হলে দেশে শান্তি আসবে না, ভারত মুক্ত হবে না, রবীন্দ্রনাথের মতো এ ধারণাকে তিনিও কখনই সমর্থন করতে পারেননি।

তবে তাঁর ভাবনার সবচেয়ে বড় দুর্বল দিকছিলো ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে থাকা। তিনি ইংরেজদের কখনো শত্রু বলে মনে করতেন না বরং তাদের শাসন থাকলে দেশের উন্নতি হবে এমন ভাবনাতে ছিলেন বদ্ধ পরিকর। ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আমাদের মনে আত্ম-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার বোধের জাগ্রত হয়।

সেই স্বাধিকার বোধই ধাবিত করে আমাদের স্বাধিকার লাভের প্রচেষ্টায়। মোঘল সভ্যতার চরম নিজে ও অকেজো পরিস্থিতিতে এ বাংলায় ইংরেজ শাসনামল শুরু হয়। দেশের শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজ উন্নয়ন গতিবেগ, এমন কি জীবনীশক্তিতে সভ্যতার ক্ষয় ধরেছিল। জনসাধারণের আত্মিক দুরবস্থা অসাধু ও অযোগ্য লোকদের সিংহাসন নিয়ে হীন কলহ সমাজব্যবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এমনই এক চরম অবস্থাতে এ দেশে ইংরেজদের প্রবেশ।

“অকমর্ণ শাসকগোষ্ঠীর ও সামন্তশ্রেণীর চরম অপদার্থতা, তাদের শোচনীয় নৈতিক অধোগতি, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কুৎসিত ও ইন্দ্রিয়াসক সাহিত্যের পুষ্টি পাশ্চাত্য সভ্যতা, পবিত্র গৃহজীবনেও দুর্নীতিপরায়ণতার আবির্ভাব, ধর্মের নামে নানা ব্যভিচার, ব্যক্তি স্বাধীনতার একান্ত অভাব ভারতীয় সমাজকে ভীষণভাবে পঙ্কিল ও কলুষিত করে রেখেছিল। এমন দিনে অসার জীর্ণ, মৃতপ্রায় ভারতীয় সমাজে ইংরেজ শাসন বহন করে আনে এক উন্নততর সভ্যতার জীবনাদর্শ।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠাকে তাই মধ্যযুগীয় ভারত-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গবেষক নবযুগের শুভ অরুণোদয় বলে চিহ্নিত করেছেন। শতধাবিচ্ছিন্ন, আত্মঘাতী অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত ভারত ইংরেজ শাসনে ধীরে ধীরে ঐক্যগ্রথিত, কেন্দ্রীয়শাসিত হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে বৃহত্তর ও উন্নততর সমাজ ও সভ্যতার সম্ভাবনা তার জীবনে দেখা দেয় স্পষ্টভাবে।

এই সকল পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা ছিলো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। যে কারণে ইংরেজ শাসনামল ভারতের ইতিহাসে উন্নয়নের যে নবদুয়ার খুলে দিয়েছিল তা পাশ্চাত্য সভ্যতা তিনি অস্বীকার করতে পারেননি, বরং সারাজীবন এরজন্য কৃতজ্ঞতা পোষণ করেছেন। ইংরেজ বিতাড়িত হলে দেশ যদি আবার অরাজকতায় লিপ্ত হয় ও এই উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয় সেই আশঙ্কায় মূলত তিনি স্বদেশ ভক্তির সাথে সাথে রাজতন্ত্রকেও ভক্তি করতেন।

“দ্বিজেন্দ্রলাল স্বীয় জীবনের আদর্শ দ্বারা তাহার এক বিচিত্র সাক্ষ্য প্রদান করিয়া গিয়াছেন। দেশের হিতানুধ্যানে তিনি প্রাণপাত করিয়াছেন, মানি; কিন্তু, দেশকে ভালবাসিলেই যে ইংরাজজাতির প্রতি বীতরাগ ও অন্ধভাবে বিদ্বিষ্ট হইতে হইবে, তদীয় বাক্যে কর্মে বা চিন্তায়-এরূপ মতের তিনি তিলার্দ্ধও পোষকতা করিয়া যান নাই।

মাতৃভূমি ও আপন জাত- ভাই’দের মঙ্গলের প্রতি অপলক লক্ষ্য রাখিয়া, শাসকগণের অবৈধ, উদ্ধত ও অন্যায় কার্য্যের তিনি যখন প্রতিবাদ করিতে থাকিতেন তখন সন্দেহ হইত বুঝিবা মূলে তিনি মনে মনে ইংরাজ রাজের প্রতি বড়ই বেশী বিদ্বেষপরায়ণ।

কিন্তু যাঁহারা তাঁহার সঙ্গে মিশিয়াছেন তাহারা জানেন তিনি আসলে এ রাজত্বের কতদূর গুণগ্রাহী ও হিতার্থী ছিলেন, এবং যখন তিনি ঐরূপ কোন প্রতিকূল মন্তব্য পাশ্চাত্য সভ্যতা উত্তেজিত আগ্রহে ব্যক্ত করিতেন, প্রকৃতপক্ষে তখনও কিন্তু সৰ্ব্বৰ্থা এই রাজ্যের ভাবী ও স্থায়ী কল্যাণই তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকিত।

দেশবাসীরা যাহাতে পরানুগ্রহের জন্য লালায়িত না রহিয়া ক্রমে এখন ‘আপন পায়ে’ আপনারা ভর করিয়া দাঁড়াইতে শেখে, স্বজাতি ও মাতৃভূমির সর্ব্ববিধ শুভ-সাধনে, আত্মোন্নতি বিধানে তাহারা যাহাতে একান্ত মনে অবহিত হয়, এ জন্য তিনি নিত্য-নিয়ত, অতঃপর নিতান্তই চিন্তান্বিত ও যত্নবান ছিলেন; এবং সত্য বলিতে কি ঠিক সেইজন্য, যতদিন আমরা স্বরাজ্য লাভে যোগ্য ও সমর্থ না হই ততদিনের জন্য তিনি এই বৃটিশ রাজত্বেরও উন্নতি ও স্থায়িত্ব সর্বান্তকরণে কামনা করিতেন।

ইংরাজের আগমন যে এ-দেশে আমাদের এই বহুবিধ উন্নতির মূল: আর, এই উদার নৈতিক রাজত্বের উপরে যে আপাততঃ আমাদের যা-কিছু মঙ্গল, যত-কিছু- উন্নতি, এমন কি, প্রত্যুতঃ, আমাদের জাতীয় জীবন-মরণও একরূপ নির্ভর করিতেছে, ইহাই তাহার অকপট ধারণা বা বদ্ধ-মূল বিশ্বাস ছিলো।

এই বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া, সেই স্বদেশী- আন্দোলনের সময়ে অত উদ্দাম উত্তেজনার মধ্যেও, আমরা দেখিয়াছি-তিনি ঐ বৈর-বুদ্ধিসঞ্জাত বিদেশী বহিষ্কার বা “বয়কটের বিপক্ষে অমন তীব্র অভিমত পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রচার করিয়া, তাঁহার একান্ত অনুরাগী ও পরম গুণগ্রাহীদের কাছেও তৎকালে যথেষ্ট লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। স্বদেশপ্রেমী দ্বিজেন্দ্রলাল রূপকতা, হঠকারিতা সহ্য করতে পারতেন না।

স্বার্থান্বেষী দেশ নেতাদের তিনি রীতিমতো ঘৃণা করতেন। কেবল বক্তৃতা নির্ভর নেতাদের তিনি তাঁর বাক্যের চাবুকে দেশপ্রেম শেখাতে চেয়েছেন । তিনি কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই বরিশালবাসীর স্বদেশি আন্দোলনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে একান্ত নিষ্ঠায় স্বদেশি ধ্যানে তন্ময় ও তাদের আত্মহারা রূপ পরিলক্ষিত হয়। পল্লিগ্রাম পর্যন্ত বিদেশি দ্রব্য বর্জনে সমর্থ হয়েছে।

স্বদেশের এইরূপ বিচিত্র ও অপরূপ মূর্তি দেখে বিস্মিত মনে শ্রীদেব কুমার রায় চৌধুরী বরিশাল থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে পত্র লেখেন এবং তাঁর উত্তরে খুলনা থেকে তিনি লিখলেন তাঁর ত্যাজদীপ্ত দেশপ্রেমবোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ স্পষ্ট উপলব্ধির কথা-
“পূর্বেও শুনিয়াছিলাম, বরিশালই একত্র সাধনায় ‘স্বদেশী’ ভাবকে স্বভাবে পরিণত করিয়াছে।

আজ তোমার পত্রে সে কথার বিস্তৃত বিবরণ জানিয়া আমার যে কত আনন্দ হইল তাহা আমি ভাষায় ব্যক্ত করিতে পারি না। বরিশালবাসী আজ সমগ্র ভারতের আদর্শ, শিক্ষক, নমস্য। ওখানে কার্য্যতঃ তোমরা যে আদর্শ দেখাইতেছ তাহা কল্পনায় প্রত্যক্ষ করিয়া এই দূর হইতেও আমি নিজেকে ধন্য জ্ঞান করিতেছি।

এই যত সব বাক্য-সর্ব্বস্ব, কপটাচারী নেতাদের কানে ধরিয়া বরিশালে নিয়া দেখাইয়া দাও কেমন করিয়া কাজ করিতে হয়, স্বার্থত্যাগ করিতে হয়: দেশের যথার্থ যে প্রাণশক্তি, অর্থাৎ এই আমাদের অশিক্ষিত অগণিত চাষা ও গ্রামবাসীদের মধ্যে আপনাদিগকে মিলাইয়া মিশাইয়া দিয়া, কি করিয়া তাহাদিগকেও দেশভক্তির এই মহামন্ত্রে দীক্ষিত ও দৃঢ়-ব্রত করিয়া তুলিতে হয়।

কাজের সঙ্গে কোনই সম্বন্ধ নাই, শুধু কেবল বক্তৃতা, বক্তৃতা, আর বক্তৃতা। এই সৌখীন নেতা বা বক্তাদের (একসঙ্গে দুটো শব্দই বলিলাম; কারণ, বক্তা না হইলে এখন আর দেশের নেতা হওয়া যায় না।) উপরে আমার তো এখন ঘৃণাই জন্মিয়া গিয়াছে। এখন কি উপায়ে এই সব আত্ম-সৰ্ব্বর, ‘নাম-কাওয়াস্তে’ নেতাদের হাত থেকে দেশবাসীকে, বিশেষতঃ আমার ভবিষ্যৎ ভরসাস্থল, আশা- কল্পতরু, সোনার চাঁদ ঐ যুবকদিগকে রক্ষা করা যায়, তাই আমি অনেক সময় ভাবি।

তা নইলে ত আমি আর মঙ্গল দেখি না। এদের পাল্লায় পড়িয়া পরিণামে আমাদের দেশের যে নানারকম দুর্গতির একশেষ হইবে আমি তাহা দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি। নেতা যদি তেমন কেহ থাকেন, তিনি তোমাদের-ঐ অশ্বিনীকুমার দত্ত মহাশয়। দীর্ঘজীবী হউন তিনি। তাঁহাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ নমস্কার দিও। হৌন না তিনি কায়স্থ –আমি তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া বিবেচনা করি।

তাঁহাকে বলিও তিনিও যেন আবার ঐ কপটমতিদের চক্রান্তজালে আপনাকে জড়াইয়া না ফেলেন। তাহলে তাঁহারও সকল শ্রম, সব আশা পণ্ড হইবে এবং তিনি নিজেও পরে বিপদে পড়িবেন। এসব নেতারা কেবল পরের দোষই দেখিতে মজুদ। পূর্ব্ববঙ্গের ভাইদের এতকাল তাঁরা ত অবজ্ঞাই করিতেন, এখন তবুও যদিবা প্রকাশ্যে ততটা না করুন, মনে মনে ও কার্য্যতঃ যে তাহাদের তত আমল দিতে রাজী নন, এটা কিন্তু বেশ বোঝা যায়।

(বাঙ্গালরা ত কোনদিনই ‘কুছ কাম কা নেহি।) অথচ তাঁদের নিজেদের যে সৰ্ব্বাঙ্গে ঘা ওষুধ দিই কোথা’ অবস্থা, তা তাঁরা একটিবার ভুলেও ভাববার অবকাশ পান না। মাথায় থাকুক আমার ‘বাঙ্গাল’ ভাই-সব তাঁরাই তো মানুষ। জয় বরিশালবাসীর জয় জয় আমার ‘বাঙ্গাল’ ভাইদের জন্য।

সত্যনিষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর এই সত্যবাদিতার জন্যে অনেক সময় আহত হয়েছেন। মানুষজন তাঁকে ভুল বুঝেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। যুক্তিবাদী, তার্কিক ও বাস্তবদৃষ্টে তিনি শত্রুকেও আপন করে নিয়েছেন। তাঁর নাটকের অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্ত করতে চেয়েছেন যে কল্যাণকর কোনো রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা যেমন শাস্তি ও ধর্মের শত্রু তেমনি দেশেরও শত্রু।

কল্যাণকর রাজশক্তির পক্ষে অবস্থান মূলত তাঁর রাজনীতির মূল মন্ত্র ছিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশভক্ত লোকও রাজভক্ত হতে পারে।

 

স্বদেশভক্ত ও রাজভক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

“বাস্তবিক রাজ-ভক্তি ও দেশ-ভক্তির এমন বিচিত্র সমন্বয়, আধুনিক শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই কম লোকের জীবনে সংঘটিত হইতে দেখা যায়। সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড যখন মেবারে মারা গেলেন তখন দ্বিজেন্দ্রলাল স্বয়ং, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, যে গুণগ্রাহী শোকসংগীত রচনা করেন তাহা পাঠ করিলেও তাহার রাজ-ভক্তির অকৃত্রিম আন্তরিকতা উপলব্ধি হয়।

শুধু যে তিনি সে গানটি রচনা করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে; তদীয় নেতৃত্বে পরিচালিত “ইভনিং ক্লাবে র সভ্যগণের সহযোগে, “বহু যন্ত্রাদির সাহায্যে” তিনি সে গানটি গাহিয়া, কলিকাতার বিভিন্ন পথে পদব্রজে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছিলেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment