স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

 

স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

 

স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯১১ সালের পরে দেশাত্মবোধক গানের ধারা সংকুচিত হয়ে আসে। ড. করুণাময় গোস্বামীর নজরুলগীতি প্রসঙ্গে (পৃ. ১১৯) গ্রন্থের তথ্যানুসারে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে (১৯০৫-১৯১১) কেন্দ্র করে যে বিপুল সংখ্যক গান রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, মুকুন্দ দাস, প্রমথ নাথ রায় চৌধুরী,

কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, অমৃতলাল বসু, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সরলা দেবী চৌধুরানী, মনোমোহন চক্রবর্তী, বাসিনীকুমার ভট্টাচার্য প্রমুখ কর্তৃক তা ১৯১১ সালের পরে আর বিশেষ ডালপালা মেলে ধরেনি। তখন স্বদেশি গানের ভাণ্ডারে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে মুখ্যসংগীত রচয়িতাদের অকালপ্রয়াণ এবং আন্দোলনের গতিধারার পরিবর্তন।

কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ ১৯০৭ সালে, রজনীকান্ত সেন ১৯১০ সালে ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯১৩ সালে পরলোক গমন করেন। এই অকালমৃত্যু একটি বড় বিপর্যয় ডেকে আনে স্বদেশি গান রচনার ক্ষেত্রে। অন্যদিকে অতুলপ্রসাদ সেন মূলত প্রেমসংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বদেশি গান রচনার যে মূল স্তম্ভ, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের পরে আর স্বদেশি গান তেমন রচনা করেননি।

তিনি নানা কারণে স্বদেশি গানের ধারা থেকে সরে দাঁড়ান। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের গতি ও ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে সমর্থন করতে পারছিলেন না বলেই তিনি স্বদেশি গান রচনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এছাড়া রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিপ্লবের যে ধারা শুরু হয় তা মানবতার আর আত্মমুক্তির চিন্তায় বিভোর রবীন্দ্রনাথ তাকে সমর্থন দিতে পারেনি।

তিনি নিজেকে নিভৃত আলোর রচনাশৈলীতে নিমগ্ন হন এবং নিয়োজিত হন শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার কাজে। এ সময়ে তিনি যে কয়টি আত্মজাগরণমূলক গান রচনা করেছেন তার সবটাই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। স্বদেশের প্রতি অনুরাগ সেখানে মুখ্য নয়। কারণ কবির ভাবনা তখন মিশেছিল বিশ্বভাবনার সাথে। বিশ্বঘরে পদার্থিত কবির কাছে দেশ বিশ্বেরই একটি অংশ। এই বিশ্বকে আলিঙ্গনের মধ্যদিয়ে তিনি দেশকে আপন করেছেন।

 

স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

 

স্বদেশপর্বের গান রচনার এই ভাটালগ্নে কেবল মুকুন্দ দাস সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন ও দেশাত্মবোধের ভাবনাকে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দেন তাঁর যাত্রা ও গানের মধ্যদিয়ে।

যদিও সামগ্রিকভাবে অন্যান্য অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশবোধটি তুলে ধরবার প্রয়াস রয়েছে যেমন, তেমনি অন্যান্য পর্যায়ের গানসহ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসবকে কেন্দ্র করে তাঁর রচিত স্বদেশ ভাবনার গানে স্বদেশ চেতনার বোধটিকে নিংড়ে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে অবচেতনায়।

এখানে উল্লেখ করা অবশ্য প্রাসঙ্গিক যে, বঙ্গভঙ্গের পর থেকে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশভাবনা ও জাতীয়তাবাদ বিষয়টি থেকে নিজেকে সরিয়ে দেন। যে সকল গান তিনি বঙ্গভঙ্গের পর রচনা করেছেন তার সবটাই মূলত কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রচিত। যেখানে স্বাদেশিকতাবোধ বা জাতীয়তাবোধের উল্লেখ নেই। কারণ সেই সময় রবীন্দ্রনাথের প্রাণ মিশেছিল বিশ্বচেতনায়। সমগ্র বিশ্বকে একটি বিন্দুতে তিনি কল্পনায় মত্ত ছিলেন। তাঁর রচনার উদাহরণে বলতে পারি-

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো

সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।

এই বিশ্বযোগে কবির কাছে কেবল স্বদেশের ভাবনা থেকে বিশ্বভাবনায় পরিণতি লাভ করে। সমগ্র বিশ্বকে আপন করে তিনি নিজের দেশ, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীতে ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একের পর এক গানে সকল বন্ধন ছিন্ন করবার আয়োজন। তাই নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

 

স্বদেশি গান রচনার ভাটাকাল

 

তিনি যা শুরু করেছিলেন। তাই আমরা অগ্রসরে ব্যস্ত আছি কেবল। একজন রবীন্দ্রনাথের জন্ম যদি এ বাংলায় না হতো, বাঙালি আরো শতবর্ষ পিছিয়ে থাকতো। তাই বিশ্বভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ এই কবিকে, কবির সৃষ্টিকে তাঁর প্রিয় জন্মভূমিকে শ্রদ্ধাভরে প্রণতি জানাই।

আরও দেখুন :

Leave a Comment