স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

 

স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

 

স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

কবি অতুলপ্রসাদ সেন দেশের স্বাধীনতার সূর্যকে লালনের স্বপ্নে বিভোর রাখতে গান রচনা, সভাসমিতি ছাড়াও বহু সংগঠন তৈরি করেছেন। এই সকল সংগঠন তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ছিলো দেশবাসীর চিত্তকে সদা জাগ্রত রাখা।

স্বাধীনতা প্রত্যাশী জাতি যেন ঝিমিয়ে না পড়ে, যেন ঘরের কোণে সময় অতিবাহিত না করে, যেন দেশের যে কোনো প্রয়োজনে পথে নামতে কুণ্ঠাবোধ না করে, তাই সারা জীবনব্যাপী তিনি বহুবিধ সংগঠন তৈরি করেছেন। যেমন বঙ্গীয় যুবক সমিতি, গুড উইল ক্লাব, মানডে ক্লাব, আওয়ার ডে ক্লাব ছাড়াও লক্ষ্মৌতে কংগ্রেসের অধিবেশন, প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন, অল ইন্ডিয়া লিবারেল ফেডারেশনের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

উত্তর ভারতীয় সাহিত্য সম্মিলনেরও তিনি প্রধান বার্ণিকের ভূমিকা পালন করেন। হিন্দীসভা ও “হিন্দী গ্রন্থাগার’ নির্মাণ করেন। তিনি একজন দেশপ্রেমী বাঙালি হয়েও ভারত ভূ-খণ্ডের অন্য সকলের ভাষা ও অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি লিবারেল ফেডারেশনের হয়ে লক্ষ্মৌ মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের নির্বাচনও করেছিলেন।

অন্তরের দিক থেকে সদা চঞ্চল ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন অথচ বাহ্যিক অবয়বে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অদম্য এক অনন্য পুরুষ। সদাব্যস্ততায় তাঁর সকল আনন্দ। দেশের কাজে, দশের কাজে, নিজের ওকালতি কাজে নিজে সর্বদা ডুবে থাকতেন। আর গান রচনায় পেতেন সকল কাজের অনুপ্রেরণা। স্বদেশসাধনায় ব্যপ্ত কবি তাঁর জীবদ্দশায় অনেক গুণী ব্যক্তির সাহচার্য পেয়েছিলেন।

তন্মধ্যে শরত্চন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ধূর্জটীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সরলা দেবী, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ জনের একান্তের সহচর ছিলেন। একদিকে বিশ্বপ্রেমিক অন্যদিকে স্বাদেশিকতা ও দেশমাতার অনন্য সাধক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অসহযোগ আন্দোলনের নেতা গান্ধীজীরও তিনি স্নেহধন্য হতে পেরেছিলেন স্বীয় গুণে। অতুলপ্রসাদ সেনের জন্য রবীন্দ্রনাথ দুটি কবিতা রচনা করেন।

ধীরে ধীরে অতুলপ্রসাদ পরিণত হয়েছিলেন সকলের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথের পরম বন্ধু। ১৯৩২ সালে ‘পরিশেষ’ কাব্যটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনকে। পরম বন্ধু অতুলপ্রসাদের মৃত্যুর পর শোকাহত রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘অতুল প্রসাদ সেন’ কবিতাটি। এটির অংশবিশেষ,

“বন্ধু, তুমি বন্ধুতার অজস্র অমৃতে

পূর্ণপাত্র এনেছিলে মন্ডা ধরণীতে।

ছিলো তব অবিরত

বঞ্চিত করোনি কভু কারে

হৃদয়ের সদাব্রত তোমার উদার মুক্তদ্বারে।

অতুলপ্রসাদ সেনের ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতাকে অন্তরে লালন করে তাঁর মানসিক বিকাশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। একবার মহামতি গোখলে লক্ষ্মৌ এলে অতুলপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথের ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’ গান গেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি গোখলেকে লক্ষ্ণৌর ‘বঙ্গীয় যুবক সমিতি’ আয়োজিত অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে নিয়ে যান।

 

স্বদেশ রক্ষার্থে গঠিত সংগঠন ও ভূমিকা

 

গোখলে এই সংগঠনের কার্যাবলি দেখে দারুণ অনুপ্রাণিত হন। শুধু লক্ষ্মৌতেই নয় দেশের প্রতিটি শহরে যুবকদের এইরূপ সমিতি থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন গোখলে। তিনি এই সমিতির মাধ্যমে আর্ত-মানবতার সেবাসহ সকলের মনে দেশাত্মবোধ জাগরণের বিপুল কার্যকারিতার কথা ব্যক্ত করেন।

লক্ষ্মৌ পৌরসভা থেকে যেবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পৌর সংবর্ধনা জানানো হয় সেবার এই বঙ্গীয় যুবক সমিতির শিল্পীরা ঐকতান বাদনের মাধ্যমে মধুর সুর মূর্ছনায় আকাশ বাতাস বিহ্বল করে তোলে। লক্ষ্মৌতে যেবার কংগ্রেসের অধিবেশন হলো তখনো দেখা গিয়েছে অতুলপ্রসাদ বিপুল আগ্রহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। যখনই যেকোনো কাজে বাধা এসেছে বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঝড়ের বেগে তিনি তা সমাপন করেছেন।

তাঁর কর্ম-চঞ্চলতা কখনো কোমল আবার প্রয়োজনে কঠোর নির্দেশে পরিণত হত, তার অনুরোধে লক্ষ্মৌ কংগ্রেসের অধিবেশনটি বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। অতুলপ্রসাদ এমনই এক অদম্য শক্তি আর উদ্দীপনার নাম-যা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। বরং পরম আদরে আপন করে নেয় তাঁকে। কারণ তাঁর প্রতিটি আচরণে থাকতো স্বদেশপ্রেমের আর্তি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ‘আওয়ার ডেযাত্রার মাধ্যমে অতুলপ্রসাদ সেনও দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য টাকা উত্তোলন করেন। সীতাপুরে আওয়ার ডে’ ফান্ড কনসার্টে কবি ‘হও ধর্মেতে ধীর, হও কর্মেতে বীর’ স্বরচিত গান গেয়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীকালে স্বদেশপ্রেমের এই গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য দরদভরা একটি হৃদয় নিয়ে অতুলপ্রসাদ সারাজীবন কাজ করে গেছেন।

তাঁর স্বদেশপ্রেমের গানের সংখ্যা মাত্র তেরোটি অথচ স্বদেশের জন্য নিবেদিত এই প্রাণের তুলনা এই গানের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করলে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। দেশমাতাকে যেমন তিনি সাধনা করেছেন তেমনি একজন স্বদেশকর্মীর মতো পথে নেমে কাজ করেছেন। এদিক দিয়ে অতুলপ্রসাদ সেন একটি বিস্ময়কর চরিত্র। অথচ কখনো মনের বিরুদ্ধ-বিষয়ে আপস করেননি তিনি।

যখন দেখলেন সমগ্র দেশ জুড়ে হিংসাত্মক রেষারেষি আর দেশ নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই আর কর্তৃত্বের বড়াই তখন তিনি গান্ধীজীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করা সত্ত্বেও তাঁর অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি নিজেই বহু আরাধ্যের কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজেকে যুক্ত করেছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া লিবারেল ফেডারেশন’-এর সাথে।

এলাহাবাদে ১৯৩৩ সালে লিবারেল পার্টির সম্মেলনে অতুলপ্রসাদের অসাধারণ ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বাঘা রাজনীতিবিদ যেমন স্যার অতুল চ্যাটার্জী, স্যার বি.এল. মিত্র, সরোজিনী নাইডু, দাশ অরবিন্দ ঘোষ, অধ্যাপক এম এম ঘোষ, গোখলে, স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর মতো অনেকই কংগ্রেসের মূলধারা থেকে সরে যান। অতুলপ্রসাদের অতুলনীয় সেই বক্তব্যের খানিক অংশ তুলে ধরা হলো

“The constitution proposed in the white paper is certainly not Dominion Status nor any real self-government. It is a catalogue of safeguards rather than proposal for real autonomy. …I deplore separate electorates more than British dominion has to be maintained no better means could be devised than separate electorats…..

We are not the architects of our own destiny but suppliants before another nation for favour. No self- respecting India can help feeling humilitation for such an object position.”

অতুলপ্রসাদ সেনের জীবনে যত কাজ, কবিতা, গান বা প্রবন্ধ রচনা করেছেন তাতে স্থান রয়েছে সর্বার্থে প্রেম। তিনি এই প্রেম কখনো মানবের জন্য, কখনো দেশের জন্য, কখনো এ দুটিকেই মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করেছেন। স্বদেশের মাটি আর মানুষ তাঁকে সারাজীবন ভাবিয়েছে। নিজ গৃহে যে সুখ তিনি পাননি তাই কুড়িয়ে নিয়েছেন পথের মানুষের কাছ থেকে।

অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী অতুলপ্রসাদ তাই তাঁর কর্মের সর্বত্র একটি মায়াময় আভাস রেখে গেছেন। দুশো ছয়টি গান, চারটি প্রবন্ধ আর কয়েকটি কবিতা একজন গীতিকবিকে চিরস্মরণীয় করে তুলবার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু তিনি তাঁর সকল রচনায় তুলে ধরেছেন বাস্তবজীবনে প্রেম-বিরহ আর দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতের ছবি। যে কারণে আমাদের সামনে তাঁর প্রতিটি গান জীবনের গল্পের মতো করে একের পর এক ছবি দেখাতে থাকে।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের উপদেশে ১৯২৫ সালে আত্মউদাসীন কবির প্রথম গানের বই গীতিসংকলন প্রকাশ পায়। ২০৬টি গানের সমাহারে দ্বিতীয় গ্রন্থ গীতিগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে কলকাতা থেকে। দীপ্ত গীতিময় এই কবির স্বদেশ প্রেমবোধ ছিলো অতুলনীয়। তাঁর গানে স্বদেশ চেতনাবোধ বিশ্লেষণ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর।

আরও দেখুন :

Leave a Comment