হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

 

হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

 

হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

লক্ষ্মৌতে অতুলপ্রসাদ সেন স্থানীয় মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। অনুন্নত বস্তিবাসীদের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। তাদের সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের কথা তাঁকে ভাবিত করলো। একজন ব্যারিস্টার নগরের অত্যন্ত মান্য ব্যক্তি। তিনি নিজে গিয়ে যখন এই সকল হরিজনের সেবা করতে লাগলেন, লক্ষ্মৌবাসীর মনে অতুলপ্রসাদ সেনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর প্রেম জাগ্রত হলো।

তাঁরই জন্য যেন লক্ষ্মৌবাসী এতোকাল ভূষিত ছিলো এবং সবার অজান্তেই স্বীয় কর্মের জন্যে অতুলপ্রসাদ সেন লক্ষ্মৌবাসীর মনে মুকুটবিহীন রাজার আসনটি লাভ করলেন। লক্ষ্মৌর ছোট-বড় আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের রাজা অতুলপ্রসাদ সেন। কারো কাছে তিনি দাদা ভাই-ভাইসাহেব বা সেন সাহেব।

সকলের অত্যন্ত প্রিয় তিনি বিশেষ করে রিক্সাওয়ালা, ভিখারী আর হরিজন শ্রেণির কাছে। বন্যাপীড়িতদের জন্য, নিরক্ষর বক্তীবাসীর অক্ষরজ্ঞানের জন্য, গরিব ছাত্রদের লেখাপড়াসহ শিক্ষা- সংস্কৃতির প্রসার ও প্রচারে সদা কর্মব্যস্ত তিনি। এ ক্ষেত্রে সুনীলময় ঘোষের মন্তব্য তুলে ধরা হলো-

“লখনাউ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরিকল্পনা অতুলপ্রসাদ লখনাউবাসীর বিশেষ করে দরিদ্র-বস্তীবাসীদের জীবনযাত্রার প্রতি গভীরভাবে মনসংযোগ করেছিলেন। মুচি-মেঘর-সমাজে, অনুন্নত শ্রেণীর পল্লীতে নিজে গিয়ে নর্দমা পরিষ্কার, রাস্তা পরিষ্কার, জল পরিশোধনের ব্যবস্থা- সর্বোপরি একটি সুস্থ জীবন অতিবাহনের পরিবেশের জন্য যা যা প্রয়োজন তিনি তাতে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।

এমন ধারার কাজ ও সেবা ইতোপূর্বে লখনউ তথা ভারতের কোন শহরে কোন জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। ‘হরিজন সেবার কথা তখনও ভারতবর্ষে তেমনভাবে প্রচারিত হয়নি কেউ তেমন করে ভাবেওনি। মাতা হেমস্তশশীর আদর্শে এবং পিতা রামপ্রসাদ সেনের কর্মপ্রবর্তনায় এবং সর্বোপরি মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের সর্ব- মানুষের সেবার জাগ্রত-প্রেরণা সেদিন অতুলপ্রসাদকে ব্যারিস্টারীর বৈভব অতিক্রম করে অবহেলিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করেছিল।

বহু রাতদিন অতুলপ্রসাদ তাদের সাথে থেকে থেকে তাদের বাসস্থান-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানাবিধ প্রতিষেধক ব্যবস্থা তদারকি করতেন। ”

গান্ধীজী অতুলপ্রসাদ সেনের এই হরিজন সেবার কথা শুনেছিলেন বলেই তাঁর প্রতি গভীর আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা জানাতে লক্ষ্মৌতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ ভারতীয় ইতিহাসে এমনভাবে হরিজন সেবার কাজটি আগে কেউ কখনো করেননি বা ভাবেননি। গান্ধীজী লক্ষ্মৌতে এসে হরিজন পল্লী ও অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করেছিলেন।

অতুলপ্রসাদের রাজনীতির অন্যতম নীতিগত আদর্শ ছিলো- ভারত ঐতিহ্যে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত চেতনার উন্মেষ ঘটানো এবং সকল ভারতবাসীকে এই চেতনাবোধের গৌরব উপলব্ধি করানো। তিনি হরিজন সেবা থেকে শুরু করে সর্বত্র এই একটি লক্ষ্যে স্থির থেকে কাজ করছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের মনে এই একাত্মতা অনুভূত না হলে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য বহু দূরের ভাবনার বিষয় হয়েই থাকবে।

 

হরিজন সভার প্রতি মমতা ও দায়িত্বপালন

 

কিন্তু দুর্ভাগ্য ভারতের সর্বত্র তখনো হিন্দু- মুসলমান ঐক্যের প্রশ্নে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভাব সর্বত্র বিরাজিত ছিলো। হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করে কবি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, পার্থক্য শুধু নামে। যার যার ধর্ম কেবলই মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ তা কখনই বিভেদের কারণ হতে পারে না। হিন্দু- মুসলমানের ঐক্যবোধকেই তিনি তাঁর সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবনের প্রধানতম আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

বহু মুসলমানের সাথে তাঁর রাজনৈতিক হৃদ্যতার সম্পর্কছিলো। আর গরিব- কুঠিরবাসী, রিক্সাওয়ালা, ফেরিওয়ালা মুসলমানের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘ভাই দাদা’। তাঁর এই উদ্যাগ হিন্দু-মুসলমানের সমনেতৃত্ব বিকাশে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও কবি হিন্দু- মুসলমানদের ঐক্যের কথা বলে গেছেন।

তাঁর বহু সাধনায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ঐক্যের সেতু রচিত হয়েছিল তা যেন কোনোক্রমেই ইংরেজ শাসক নষ্ট করতে না পারে সে বিষয়ে তিনি সকলকে সজাগ থাকতে বলেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকাল থেকে ইংরেজশ্রেণি হিন্দু- মুসলমানের ঐক্য নষ্ট করবার নানাবিধ পায়তারা করতেন। এই ঐক্যকে বিষিয়ে তুলতে পারলেই তাদের কার্যসিদ্ধি অনেক সহজতর হয়ে উঠবে বলে অতুলপ্রসাদ সেন সকলকে সাবধান থাকতে বলতেন।

এই উদ্দেশ্যে কবি নিজের খরচে ১৯০৩ সালে দুস্থ ও অসহায় মানুষের সাহায্য ও সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ‘গুড উইল ক্লাব’। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। এই ক্লাবের উদ্যোগে শহরে গঠিত হয় অনেক ‘সেবাশ্রম সমিতি’। তাঁর সমাজ উন্নয়নের বাসনা ও দুস্থদের প্রতি প্রেমবোধ দেখে প্রতিটি সেবা সমিতিই তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত করেছিল।

১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের পরের বছর ‘সাউধ সেবা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এ সমিতির মাধ্যমে গড়ে ওঠে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মুষ্টিভিক্ষা সংগ্রহ করতো এবং তাতেই অসহায় দুস্থ মানুষের সেবা চলতো। অতুলপ্রসাদ সেনের সভাপতিত্বে এই সমিতির ছেলেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্যা-দুর্ভিক্ষ বা যেকোনো বিপদে অসহায়ের পাশে দাঁড়াবে এই ছিলো তাদের মূলমন্ত্র ।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

অতুলপ্রসাদ সেন ছোট ছোট সভা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। নেতৃস্থানীয় সম্প্রদায় নেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাসহ হিন্দু-মুসলমান যুবকদের এক করে রাখবার প্রয়াসে নিরলস আত্ম-উদ্বোধনের বাণী ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ছোট বড় সকল সভাসমিতিতে আকুলতা ভরা কাতর হৃদয় নিয়ে। এই উদ্দেশ্যে রচনা করেন হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যের গান-‘পরের শিকল ভাঙিস পরে /নিজের নিগড় ভাঙ রে ভাই।

আরও দেখুন :

Leave a Comment