আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় হাসির গানে স্বদেশচেতনা
হাসির গানে স্বদেশচেতনা
হাসির গানে স্বদেশচেতনা
রজনীকান্ত সেনের প্রতিটি হাসির গানের অন্তরালে রয়েছে ব্যক্তিজীবন বা সমাজজীবনের অসংগতি। পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসূত নব্য বাবুয়ানার মুখে কষাঘাত করাই ছিলো এ সকল গানের মূল উদ্দেশ্য। তাই তৎকালীন দেশপ্রেমী শিল্পী-সাহিত্যিকদের মতো রজনীকান্ত সেনও গানে-কবিতায় সকল অনাচার, মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতবাসীকে পাশ্চাত্য সভ্যতার মোহগ্রস্ততা থেকে বাঁচাবার জন্য কখনো তীর্যকবাক্য, কখনো হাসি-ঠাট্টার পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
অন্যান্য কবি শিল্পীর মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানে মূলত ব্যঙ্গাত্মক রূপটি স্পষ্ট ফুটে ওঠে; অপরদিকে রজনীকান্ত সেনের হাসির গান মানেই হাসির অন্তরালে করুণাধারার অশ্রুপাত। তবে সমাজের মিথ্যাচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে মানবতা ও মনুষ্যত্বের জয়গানই মূলত কবিদের হাসির গান রচনার মূল উদ্দেশ্য। শুধু ব্যক্ত করবার ঢংটি আলাদা।
রজনীকান্ত সেন বহুবিধ কারণে হাসির গান রচনা করেছিলেন। যেমন দেশব্রতের অন্তরালে আত্মসুখের অন্বেষণ, পণপ্রথা, ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবের ভণ্ডামি, বিদেশি চাল প্রভৃতি। এতো সকল বিষয়কে আশ্রয় করে হাসির গান রচনা করলেও আমাদের আলোচ্য বিষয় মূলত তাঁর হাসির গানের মধ্যদিয়ে স্বদেশ প্রেমবোধ জাগ্রত করবার প্রয়াসকে তুলে ধরা। যেমন-
“তোর ঘরের পানে তাকা
এটা করা রুমালের মত,
বাইরে একটু আতর মাখা।
এই গানটিতে হাস্যরসের মধ্যদিয়ে সমাজের মূল অসংগতিকে তুলে ধরেছেন কবি। এই দেশের মানুষের স্বাধীনতা নেই অথচ বিলেতি পোশাকে আবৃত অন্তসার শূন্য-এই পরিস্থিতিই বিশাল গানের ছত্রে ছত্রে বহুবিধ উপমায় সাজিয়েছেন কবি। দেশভক্তি ও শ্রদ্ধার অভাবেই মূলত অন্তর আর বাইরের এই অমিল। যেকোনো বড় পরিবর্তনে প্রয়োজন সংঘবদ্ধতা ও সুশিক্ষার।
রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল থেকে শুরু করে সকল কবিই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ইংরেজের থেকে মুক্তির উপায় বা প্রাথমিক শর্ত হলো নিজেদের কুসংস্কার ও অনাচার থেকে মুক্ত হওয়া। কুসংস্কার আর অর্থলোভে যে জাতি নিমজ্জিত, যে জাতি আত্মস্বার্থসিদ্ধি ছাড়া কিছু বোঝে না। যেখানে অর্থলোভে সাত বছরের শিশুকন্যাকে বুড়োর কাছে বিয়ে দেন বাবা।
বিধবা শিশু মেয়েকে একাদশীতে অভ্যস্ত করেন স্বয়ং পিতা। সে জাতির কাছে স্বাধীনতা বা মুক্তির মূল্য বোঝা ভীষণ দুর্বোধ্য। তাই কবি এই গানটির মধ্যদিয়ে হাস্যোচ্ছলে ভারতবর্ষের চরম দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। হাসির গানের ছলে রূঢ় আঘাতে কবি নব্য বাবুদের নিদ্রা ভাঙাতে চেয়েছেন। রজনীকান্তের হাসির গান মানেই সমাজ সমস্যাকেন্দ্রিক অনুভূতিপূর্ণ বাণী। কখনো তা আত্মজাগরণের ইঙ্গিত-তবে হাস্যচ্ছলে।
এ সকল গানের অধিকাংশই কবি রচনা করেছেন বাউলের সুরে। বাউলের সরল সহজিয়া সুরের লোকায়াত ভঙ্গিতে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের চরম সত্যকে। যার অন্তরালে রয়েছে মূলত কেবলই স্বদেশপ্রেম। কবির ভাষায়, ‘তোর বদলে গেল দেহের আকার, বদলে গেল মন,/ তবু নয়ন মুদে অচেতন। হাসির গান রচনা মূলত কান্তকবির দ্বিজেন্দ্রলালের অনুগামী অনুসরণ।
আমরা জানি রজনীকান্তের চরিত্রের সাথে ব্যঙ্গবিদ্রূপ একেবারেই শোভনীয় নয়। তাই তাঁর হাসির গানের মধ্যদিয়ে তিনি মোহগ্রস্ত, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ও ভণ্ড মানুষের অন্তরের স্বরূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির হাসির অনেক কবিতা গানে রূপান্তরিত হয়নি। কারণ তিনি তাতে সুর দিয়ে গান হিসেবে প্রচারের চেয়ে এর মূল বক্তব্যকে কবিতার আকারে প্রকাশেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
এই কবিতার মধ্যদিয়ে তিনি বাঙালির মোহগ্রস্ততা আর কুসংস্কারের আচ্ছন্নতাকে হাস্যরসের আবরণে তুলে ধরেছেন- যা মূলত ব্যঙ্গবিদ্রূপ নয়, বরং করুণ আবরণে আচ্ছাদিত।
“হাসির গানের ব্যপদেশে রজনীকান্ত সমাজের ক্ষতস্থানগুলি নির্দেশ করিয়া তাহাতে ওষুধ প্রয়োগের চেষ্টা করিয়াছেন। তাহার মুখে বরের দর সংগীত শ্রবণ করিয়া এক বিবাহ সভায় বরকর্তা যৌতুকের ফর্দ সংক্ষেপ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন এইরূপ শুনিয়াছি।… হাস্যরসের আবরণ দিয়া রজনীকান্ত তাহার মর্মবেদনাই প্রকাশ করিয়াছেন। তাহার কৌতুক হাসির সঙ্গে বেদনার অশ্রু মিশ্রিত। কমলাকান্তের ভাষা ঈষৎ পরিবর্তিত করিয়া রজনীকান্ত বলিতে পারিতেন ‘হাসির ছলনা করি কাদি।
অন্যত্র প্রমথনাথ বিশী বলেছেন,
“তাঁহার হাসির গান মূলত দ্বিজেন্দ্রলালের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও, এক জায়গায় রজনীকান্তের জিৎ। তাঁহার হাসিতে করুণায় যেমন মাখামাখি, দ্বিজেন্দ্রলালের তেমন নয়। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুশীতের বাতাস হয়, রজনীকান্তের হাসির গান বর্ষার জলভারাক্রান্ত পূর্বে বাতাস।
ডি এল রায়ের ‘আমরা বিলেত ফেরত ক’ভাই’ গানটির সুরে রজনীকান্ত রচনা করলেন হাসির গান ‘দেখ, আমরা দেওয়ানী হুজুর’। ইংরেজদের বহুবিধ সূক্ষ্ম অত্যাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে গানটিতে। সাথে বাঙালিদের জীবনকাল নিয়ে উদাসিনতাও এই গানটির স্পষ্ট ইঙ্গিত। উকিল রজনীকান্ত তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথাই ব্যক্ত করেছেন নিচের হাসির গান দু’টোতে, ‘দেখ, আমরা দেওয়ানী হুজুর,/ আমরা, মোটা মাইনের মঞ্জুর।
নিচের গানটিও ডি এল রায়ের ‘আমরা বিলেত ফেরত ক’ভাই’ এর অনুরূপ সুরে রচনা করেছেন রজনীকান্ত সেন-‘দেখ, আমরা জজের Pleader / যত, Public Movement – leader. উপরের দুটি গানের মধ্যেই দেশের আইন-কানুনের চরম দুর্দশার কথা ব্যক্ত করেছেন কবি। কেউ আইন জানে না অথচ ওকালতি বিদ্যে ফলাতে কেউ ছাড়ে না। কারণ ‘this is dishonest advocacy’; কবি গণ্ডারদেরও ছেড়ে কথা বলেননি অথবা অফিসের বড়বাবুর।
সকল ক্ষেত্রে অর্থলোভের ঘোড়দৌড়। নতুন টাকার গন্ধে সকলে মাতোয়ারা। কার ছেলে মরে কি কার বাপ তাতে ডাক্তারদের কিছুই যায় আসে না বরং ছুরি চালালেই মোটা অংকের টাকা। তাই কথায় কথায় অপারেশন। এ যেন আমাদের বর্তমান চালচিত্রেরই প্রতিচ্ছবি। কবির ভাষায়-দেখ, আমরা হচ্ছি পাশকরা, ডাক্তার মস্ত মস্ত; / ঐ Anatomy, Physiology তে একদম সিদ্ধহস্ত।
যে দেশের চিকিৎসা শাস্ত্র, আইন শাস্ত্রের এই অবস্থা সেই দেশের মানুষকে ইংরেজ শাসকের থেকে নিজেরাই বেশি শোষণ করছে বলে কবির দুঃখ বিলাপ। অসততা আর অনাচারে যখন মানুষের মন কলুষিত হয় তখন বড় কোনো বিষয়ের প্রত্যাশা তারা করতে পারে না। অর্থলোভী আর অসৎ ব্যক্তি দেশের জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। সে কেবল নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। কবি তাই এই সকল হাসির গানের মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষের করুণ চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
রজনীকান্তের হাসির গানের মূল্যায়ন বা নিগূঢ় সত্য হলো অতি সহজ কথায় হাসির ছলে বিষয়টিকে মর্মগোচর করবার চেষ্টা। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে হাসি উল্লাসের পরিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। গান যেমন গাইতে ভালোবাসতেন তেমনি অন্যকে গান শুনিয়েও পেতেন আনন্দ। যতদিন রাজশাহীতে ছিলেন ওকালতি শেষে তিনি প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় পাড়া-প্রতিবেশীদের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই গান শুনাতেন।
এমনকি মক্কেলের আনা হাড়ি হাড়ি মিষ্টিও তিনি গেয়ে গেয়ে বিলি করতেন। এমনি হাস্যরসে পরিপূর্ণ মানুষের অন্তরটি ছিলো চির দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। তাই যে কোনো সুযোগে দেশের মানুষকে তিনি গানের মধ্যদিয়ে হাসির ছলনায় সত্য উপলব্ধির আশ্বাস দিতেন। ঘুমিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে জাগিয়ে তোলার অন্তর থেকে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি। নিজের অসুস্থ শরীরের অপারগতা গানের মধ্যদিয়ে তিনি জয় করতে চেয়েছেন।
জাতিকে জাগাতে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে অন্যান্য সকল কবির মতো রজনীকান্ত সেনও একটি বলিষ্ঠ নাম। ‘মোহ-রজনী ভোর হইলে, জাগ নগরবাসী/পূর্ব্ব গগনে সূর্য্য-কিরণ, দুঃখ-তিমির-নাশী। আশা জাগানিয়া কবি চিরকাল গেয়ে চলেছেন সূর্য উদয়ের গান। সে আলোয় তিনি পথ দেখাতে চেয়েছেন। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে প্রাণে প্রাণ মিলানোর আহ্বান ছিলো কবির। নগরবাসীকে জাগিয়ে তুলতে গেয়ে চলেছেন সূর্য স্নানের গান।
এ গান হাসি আনন্দে ভরা, উৎসব আলোয় জগৎ সজ্জিত পরিপূর্ণ প্রাণ। তাই কবি ক্ষণিক সুখ বিলাসে নিমজ্জিত না থেকে বিশ্ব আনন্দে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এ বেলা আলস্যে ঘুমাবার নয়। এ বেলা বিশ্ব হাসিতে আত্মবিলোবার ক্ষণ। সেই আলোক আনন্দের পথে যুক্ত হতে সকলকে জেগে উঠতে আহ্বান জানিয়েছেন কবি। তিনি মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন।
বিবেক ভুলে গেছে কে রাজা! কে প্রজা ! কে প্রভু! কে দাস! অন্তসারশূন্য জাতি মেটে গর্বে বিভোর। অন্যকে ঠকাতে ঠকাতে নিজের ঠকের হিসাবে পূর্ণ, এ জাতি তা ভুলে বসে আছে। কবি এ সকল কর্মকাণ্ডকে পাপের পাঠশালা বলেছেন। যেখানে অন্তরের সাথে বাইরের কোনো মিল নেই। মুখ দিয়ে যা বলে অন্তর দিয়ে তা বিশ্বাস করে না।
এই বিভ্রান্তির ফাঁকা বুলি বেশি দিন থাকবে না বলে কবি সাবধান করেছেন। তাই বিবেককে জাগাতে কবি বাউলের সুরকে অবলম্বন করে লিখেছেন, ‘তারে যে ‘প্রভু’ বলিস্, ‘দাস’ হলি তুই কবে?/তুই, মেটে গর্ব্বে ফেটে মরিস্ তোর বিভবের গৌরবে!
আরও দেখুন :