আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্র গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য ও রূপক সাংকেতিক নাটক
রবীন্দ্র গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য ও রূপক সাংকেতিক নাটক

রবীন্দ্র গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য ও রূপক সাংকেতিক নাটক
বাংলা সাহিত্যে কাব্য বলতে শুধু কবিতা বোঝায় এবং কবিতার রচয়িতাকে বলা হয় কবি। সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্য শব্দের অর্থ আরও ব্যাপক। সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথ বলেছেন, “বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’ অর্থাৎ যে বাক্যে রস আছে তাই কাব্য। এখানে এমন কথা বলা হয়নি। যে, শুধু ছন্দোবদ্ধ বাক্যকেই ‘কাব্য’ আখ্যা দেওয়া হয়, রসাত্মক বাক্যময় গদ্যরচনাও কাব্যপদবাচ্য। এই পদবাচ্যের অর্থসূত্র ধরেই সংস্কৃত আলংকারিকরা কাব্যকে শ্ৰব্য ও দৃশ্য-এই দু’ভাবে ভাগ করেছেন।
শ্রব্যকাব্য পদ্য, গদ্য ও চম্পু এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। মহাকাব্য, খন্ডকাব্য, কোশকাব্যপদ্যের, কোশ ও আখ্যায়িকাগদ্যের এবং গদ্য ও পদ্যমিশ্রিত রচনা চম্পুর অন্তর্গত। লেখার প্রচলন ও লেখাকে স্থায়ী এবং সাধারণ্যে প্রচার যোগ্য করবার পূর্ববর্তীকালে এই তিন শ্রেণীর কাব্য আবৃত্তি করা হতো, সুর করে পাঠ করা হতো। শ্রোতারা শুনে বিষয়বস্তুর রস উপভোগ করতেন।
আর যেখানে আসরে বসে পাত্রপাত্রীর মুখভঙ্গি দেখে কন্ঠ শুনে কাব্যের সম্পূর্ণ আস্বাদন করা অপরিহার্য ছিলো, ব্যাচার্থগত তাই হলো দৃশ্যকাব্য। দৃশ্যকাব্য বলতে মূলত নাট্য সাহিত্যই বোঝাত । দৃশ্যকাব্যের দুটি ভাগ- রূপক এবং উপরূপক। রূপকের আবার দশটি উপবিভাগ আছে, উপরূপকের আঠারেটি। কিন্তু বর্তমানে রূপ কথাটাকে আমরা যে অর্থে ব্যবহার করি প্রাচীনকালে সে অর্থে ব্যবহৃত হতো না।
যত রুম পদ্ধতিতে দৃশ্যকাব্যের উপস্থাপনা হতে পারে, সেদিক থেকে কোন রকমের ত্রুটি যাতে না থাকে, সেজন্যেই এ ধরনের উপবিভাগের প্রয়োজন হয়েছিলো বলে মনে করা যায়। সংস্কৃত শাস্ত্রের ‘নাট্যবেদ’ কথাটিতে নাটককে বেদ বলা হয়েছে এ কারণে যে, ঋগ্বেদ থেকে কথোপকথন, সামবেদ থেকেসঙ্গীত, যজুঃ থেকে ভাবকল্পনা এবং অর্থব থেকে সাজসজ্জাদির উপকরণ সংগ্রহ করে নাট্যবেদ রচিত হয়েছে।
নাট্যবেদ বা গান্ধর্ববেদের আদি নিদর্শন হিসাবে ভারতপ্রণীত নাট্যশাস্ত্র এই নাট্যকারদের প্রধান অবলম্বন। ভারত নাট্যশাস্ত্রের মোট ৩৭টি অধ্যায়ে দৃশ্য-কাব্য বা অভিনয়কলার আলোচনাসূত্রে সঙ্গীত, ছন্দ বাচনভঙ্গি, ভাবব্যঞ্জনা ও নাটকীয় সিদ্ধ লক্ষ্য ইত্যাদির প্রয়োগরীতি বিশেষত নাট্যকলায় ভাব, রাগ ও তালের রসনৈপূণ্য এবং গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে নাটক নেই।
কিন্তু পুরুরবা ও উবর্শী সংবাদ (ঋ ১০.৯৫) এবং যম-যমী সংবাদ (ঋ ১০.১০) – ভাবানুভূতির ব্যঞ্জনায়, কল্পনার ঐশ্বর্য্যে নাটকীয় দ্বন্দেরব ও রসমাধুর্য্যে নাট্যকাব্যের নিদর্শনরূপে পরিগণিত। জীবনের সাধ ও সাধনা এবং জীবনে বন্ধনমুক্তির আবেগ ক্ষণকালের সংলাপসূত্রের মাধ্যমে চিরকালের সামগ্রী হয়ে সাহিত্যে ধরা দিয়েছে।
প্রাকৃতভাষায় লেখা ‘কর্পূরমঞ্জরী’ কবিতা ও সঙ্গীতবহুল ছিলো। সংস্কৃত দৃশ্যকাব্যে প্রকৃতি ও মানবের সম্বন্ধে বিভিন্ন রূপকল্পে তুলে ধরা হয়েছে। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলা, বিক্রমোবশী, মালবিকাগ্নিমিত্র, মেঘদূত এবং ভবভূর্তির উত্তররামচরিত ও মালতীমাধব এ নাটকগুলোতে মানবহৃদয়ের আশানিরাশা, সুখদুঃখের অন্যতম ব্যঞ্জনা নিয়ে পাঠক ও দর্শকের হৃদয়সংবেদ্য হয়েছে।
আদি মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে ‘নাটকীয় ঘটনার প্রাধান্য দেখা যায়। কবি রাধাকৃষ্ণ ও বড়াইর সরস ও সতেজ উক্তি-প্রদ ক্তি দ্বারাই শ্রেষ্ঠ নাট্যকাব্যের ন্যায় সকল রস ও ভাবগুলি ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। নাটকীয় উৎকর্ষে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।’
চৈতন্যদেবের সময়ে রায় রামানন্দের ‘জগন্নাথ বল্লভ এবং রূপগোস্বামীর ‘বিদগ্ধমাধব’ (সংস্কৃত নাটক) অভিনীত হয়েছে। বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত থেকে জানা যায় যে, শ্রীচৈতন্যের জন্মের সময় লোকে রাত জেগে মনসার গান শুনত, চন্ডী-বাশুলীর গান গাইত, শিবের গান গেয়ে ভিক্ষা করতো। যোগীপাল মহীপালের গানও গাইতো। কৃষ্ণলীলার গান তখন সাধারণ লোকের প্রিয় পালা ছিলো। তখন থেকে লোকসাহিত্যের প্রধান রূপ ছিলো গীত ও পাঁচালি।
পাঁচালি ছিলো এক ধরনের গান ত্তির নাম কখনো তা মৃদঙ্গ, মন্দিরা, চামর সহযোগে গীত হতো। একজন মাত্র ‘গায়েন’ কখনো গাইতো, কখনো দ্রুত আবৃত্তি করতো, মাঝে মাঝে নাচতও। অন্যেরা দোহার হিসেবে হত তার সহযোগী। অবশ্য নৃত্য-গীত সম্বলিত উত্তর-প্রত্যুত্তরে কৃষ্ণলীলাও অভিনীত হত – তার নাম ছিলো নাটগীত। স্বয়ং চৈতন্যদেবও ‘রুকিরনীহরণ’ নামের এমনি এক নাট্যের রুকিরনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
পালাগান, কৃষ্ণলীলা, পাঁচালি, কথকতা, যাত্রা, ঝুমুর ইত্যাদি নৃত্যগীত বহুল লোকাভিনয় (Folk drama) সপ্তদশ, অষ্টাদশ, এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতেও বাঙ্গালির রসপিপাসুচিত্তে অনাবিল আনন্দ বর্ষণ করতো। জাগতিক অভাব-বেদনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা ক্ষণকালের বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মনকে সজীব করে নেবার অবকাশ পেতো।
উক্ত আলোচনা থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, গীতিনাট্য (নাট গীতি নামেও যা অভিহিত ছিলো)। নামে বেশ কয়েক রকম নাটকের প্রচলন আমাদের দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে।
যে নাট্যে সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গীতেরও অবতারণা থাকে এবং সঙ্গতই সংলাপেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেগুলো গীতিনাট্য । রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব (১৯০৯), অচলায়তন (১৯১৫) ফাল্গুনী (১৪১৮) এসব রূপক-সাংকেতিক নাটা কর মূলভাব অধিকতর তাৎপর্যময় করে তুলতে গানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এক ধরনের গীতিনাট্য আছে, যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকলের কথাবার্তা সুরে রচিত।
রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকী প্রতিভা (১৮৮১) কালমৃগয়া (১৮৮২), মায়ারখেলা (১৮৮৩) এ ধরনের গীতিনাট্য। গীতিনাট্যে নৃতের প্রচলনও আমাদের দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে। লোকাভিনয় তার প্রমাণ। হৃদয়াবেগকে সাধারণ সংলাপে যত না সুন্দর করে অভিব্যক্ত করা যায়, তার চেয়ে বেশী সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তোলা যায় কবিতার ছন্দে, সাংগীতিক ব্যঞ্জনায় তা হয়ে ওঠে অপূর্ব রসাত্মক।
নাটকে দেহছন্দের নৃত্যভঙ্গি আরও বেশী চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। এজন্যেই আমাদের দেশে নাচ ও গান গীতিনাট্যের অংশরূপে দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নটীরপূজা (১৩৩৩), শাপমোচন (১৩৩৮), চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য (১৩৪২) প্রভৃতি এ পর্যায়ের নৃত্যনাট্য।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম গীতিনাট্য ‘বাল্মিকী-প্রতিভা’ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অভিনীত হয়। এ নাট্যরচনার মূলে ছিলো-
(১) বিহারিলাল চক্রবর্তীর ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের চিত্রকল্প সম্বন্ধে কবির উপলব্ধি,
(২) হার্বার্ট স্পেনসারের সঙ্গীত সম্বন্ধীয় প্রবন্ধে বর্ণিত বিষয় বস্তুর নাট্যিক উপস্থাপনার প্রয়াস
(৩) কবির সঙ্গীত রসপিপাসু চিত্তের সূক্ষ্ণ অনুভূতি যার ফলে দেশী ও বিলেতি সুরের সংমিশ্রনে বাঙলা সঙ্গীতে নবতর সুর সংযোজনার এটি একটি নিরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা।
এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উল্লেখ্য ঃ
‘বাল্মিকী-প্রতিভা’ পাঠযোগ্য কাব্যগ্রন্থ নহে, উহা সঙ্গীতের একটি নূতন পরীক্ষা অভিনয়ের সঙ্গে কানে না শুনিলে ইহার কোন স্বাদ গ্রহণ সম্ভবপর নহে। ইউরোপীয় ভাষায় যাহাকে অপেরা বলে, বাল্মিকী-প্রতিভা তাহা নহে, সুরে নাটিকা, অর্থাৎ সঙ্গীতই ইহার মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে নাই, ইহার নাট্য বিষয়কে সুর করিয়া অভিনয় করা হয় মাত্র, স্বতন্ত্র সঙ্গীতের মাধুর্য্য ইহার অতি অল্পস্থলেই আছে’। (জীবনস্মৃতি)

‘বাল্মিকী-প্রতিভা’ গীতিনাট্য অভিনয়ের পর রবীন্দ্রনাথের চিত্তে এলো আত্ম-প্রত্যয় এবং গীতিনাট্য রচনার উদ্দীপনা। পর বৎসরই তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২)। এ গীতিনাট্য রচনার আগে এবং ‘বাল্মীকী প্রতিভা’ রচনার পরে, এক বৎসরে তিনি অপূর্ব উদ্দীপনা নিয়ে রচনা করেন কাব্যনাট্য ‘রুদ্রচন্ড’ (জুন, ১৮৮১) এবং ‘ভগ্নহৃদয়’ (জুন ১৮৮১)।
‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ কাব্য এ সময়েরই রচনা। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায়ঃ “বাল্মিকীপ্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া যে উৎসাহে লিখিয়াছিলাম সে উৎসাহে আর কিছু রচনা করি নাই। রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য এ দুটি গ্রন্থে আমাদের সেই সময়কার একটা সঙ্গীত উত্তেজনা প্রকাশ পাইয়াছে।… একটা দম্ভরভাঙ্গা গীতিপ্লিবের প্রলয়াবদ্ধ এ দুটি নাট্য লেখা। এই জন্য উহাদের মধ্যে ভালবেতালের নৃত্য আছে এবং ইংরেজি-বাংলার বাছবিচার নাই।’ (জীবনস্মৃতি)
‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (১৮৮৩) রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক, যা গানের ধাঁচে ঢালা নয়, অথচ সঙ্গীতমুখর। এই নাটকটিতেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের তাত্ত্বিক-মানসের কাব্য রচনার কাছাকাছি সময়ে রচিত এবং প্রভাতসঙ্গীতের তত্ত্বটিই যেন নাট্যকারে সন্ন্যাসীর চরিত্রের মাধ্যমে এবং সাংগীতিক ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে ‘জীবন স্মৃতিতে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন,
উল্লেখ্যঃ ‘আমার নিজের প্রথম জীবনে আমি যেমন একদিন আমার অন্তরের একটি অনির্দেশ্যতাময়, অন্ধকার গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য বাহিরের সহজ অধিকারটি হারাইয়া বসিয়াছিলাম, অবশেষে সেই বাহিরে হইতেই একটি মনের আলোক হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ করিয়া মিলাইয়া দিলো- এই প্রকৃতির প্রতিশোধেও সেই ইতিহাসটিই একটু অন্যরকম করিয়া লিখিত হইয়াছে।
পরবর্তী আমার সমস্ত কাব্যরচনার ইহাও একটি ভূমিকা। আমারতো মনে হয়, আমার কাব্যরচনার এই একটি মাত্র পালা। সে পালার নাম দেওয়া যাইতে পারে, সীমার মধ্যে অসীমের সহিত মিলনসাধনের পালা ।… কাব্য হিসাবে প্রকৃতির প্রতিশোধের স্থান কি তাহা জানি না, আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এই একটিমাত্র আইডিয়া অলক্ষ্যভাবে নানাবেশে আজ পর্যন্ত অমার সমস্ত রচনাকে অধিকার করিয়া আসিয়াছে।
বস্তুত: কবিরচিত বিভিন্ন পর্বের কাবেই নয়, গীতিনাট্য থেকে সাংকেতিক নাট্য এবং নৃত্যনাট্যের অনুক্রমণের মধ্যে রূপের মধ্যে রূপাভীতের লীলারসধারার বিচিত্র ব্যঞ্জনা নানা রূপকল্পে সর্বত্রই ধরা দিয়েছে। রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য প্রকৃতির প্রতিশোধের দীর্ঘদিন পর ‘মায়ার খেলা’ নামক গীতি রচিত হয়। কবিমানসের গীতিসুরটি এ নাট্যে অপূর্ব ছন্দে অভিষিক্ত। ‘বালিকী-প্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া” যেমন গানের সূত্রে নাট্যের মালা, ‘মায়ার খেলা” তেমনি নাটোর সূত্রে গানের মালা।
ঘটনাস্রোতের ওপর তার নির্ভর নয়, হৃদয়া এ নাট্যের প্রধান উপকরণ। মায়ারখেলা’ রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চিত্ত ছিলো গানের রসে মন্ডিত। রবীন্দ্রনাথ ১৩৩৮ সালের পঁচিশে বৈশাখে শান্তিনিকেতনে আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞতাসূত্রে বলেছিলেন, ‘আমি সেই বিচিত্রে। দূত। নাচি নাচাই, হাসি হাসাই, ছবি আঁকি, যে আবিষ্কার বিশ্বপ্রকাশের অহেতুক আনন্দে অধীর, আমি তারই দূত।
যে বিচিত্র বহু হয়ে খেলে বেড়ান দিকে দিকে সুরে গানে, নৃত্যে, চিত্রে, বর্ণে বর্ণে, রূপে রূপে, সুখ-দুঃখের আঘাতে- সংঘাতে, ভালোমন্দের দ্বন্দে তাঁর বিচিত্র সের বাহনের কাজ আমি গ্রহণ করেছি, রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য তাঁর রঙ্গশালার বিচিত্র রূপকগুলোকে সাজিয়ে তোলনার ভার পড়েছে আমার পর। এই আমার একমাত্র পরিচয়”।
রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য এবং রূপ -সাংকেতিক নাট্যসহ সব ধরনের নাটকগুলোর বিশেষ লক্ষণীয় দিক গান। গীতিনাট্য রচনার বহুদিন পর কবি রূপক-সাংকেতিক নাটক রচনা করলেও এ নাটকগুলোর মূল তাৎপর্য গানেই ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি, ব্যঞ্জনাত্মক সংলাপগুলোও সঙ্গীতে পুণর্বার রূপান্তরিত হয়েছে। বস্তুত: রূপক-সাংকেতিক নাটকের অর্থগৌরব তার গীতিগৌরবেই বিধৃত।
এসব নাটকের আরেকটি গুণ চিত্রধর্মিতা। এ চিত্রধর্মিতার ব্যঞ্জনা গানের ভাষায় হয়েছে রূপময়। শারদোৎসবে নাটকে ১০টি, রাজায় ২৫টি, অচলনায়তনে ২৩টি, মুক্তধারায় ১৪টি, ফাল্গুনীতে ৩১টি, রক্তকরবীতে ৮টি, এবং তাসেরদেশ নাটকে ৩০টি গান আছে। এ গানগুলো নাটকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আবার রূপক-সাংকেতিক নাটকের অধিকাংশ গানই হচ্ছে নৃত্যকেন্দ্রিক।
বিশেষত শারদোৎসব, রাজা, ফাল্গুনী ও তাসেরদেশ এই রূপক- সাংকেতিক নাটকগুলোর বেশ কটি গান নৃত্যের আবেগময়তা ও ছন্দসুষমায় মন্ডিত। গানের সঙ্গে নৃত্যে ভঙ্গি এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, রবীনদ্রনাথের গীতিনাট্য নৃত্য ছন্দকে গানের সুর থেকে কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না। যদি তা হয়, তবে নাট্যচরিত্র তার আবেগময়তা হারায়।
রবীন্দ্রনাথের সহজাত মানসধর্মই ছিলো গীতি-প্রবণতা। এই প্রবণতাই তাঁর শৈশবচিত্তকে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’র দোলায় মুগ্ধ করেছিলো। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তাঁর শিক্ষারত্নের নানা ঘটনার মধ্যে মনে পড়ার মতো চিরসুখকর স্মৃতি যদি কিছু থাকে, তবে ঐ জল পড়ে পাতা নড়ে’র দোলাটুকু।
এরপর যে রহস্যমধুর স্মৃতি তাঁর কিশোর চিত্তে তিনি সযত্নে লালন করে ছিলেন এবং তাঁর জীবনের অনেক মুহুর্ত মধুর হয়ে উঠেছে সেই স্মৃতিমন্থনে, তা ছিলো ঠাকুর বাড়রি অনেককালের খাজাঞ্জি কৈলাস মুখুজ্যের শিশুতোষ ছড়া বলার শব্দচিত্র ও ছন্দ। কবি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে বলেছেনঃ
এই ছড়াটার প্রধান নায়ক ছিলাম আমি এবং তাহার মধ্যে একটি ভাবি নায়িকার নিঃসংশয় সমাগমের আশা অতিশয় উজ্জ্বলভাবে বর্ণিত ছিলো। এই যে ভূবন মোহিনী বধুটি। ভবিতব্যতার কোল আলো করিয়া বিরাজ করিতেছিলো, ছড়া শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত। … বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানা বর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য্য মুখচ্ছবি দেখিতে পাইতো তার মূল কারণ ছিলো সেই দুত উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা ও ছন্দের দোলা। শিশুকালের সাহিত্য রসভোগের এই দুটো স্মৃতি এখনো জাগিয়া আছে।’
রবীন্দ্রনাথ জীবন ও জগতকে সর্বদাই অখন্ডরূপে দেখেছেন। কবির মতে, সমগ্রকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলেও সেই বিচ্ছিন্নতাও সমগ্রেরই অংশ এবং বিশ্বলীলার রূপ-বিভূতি-
র সঙ্গে একান্ত সম্পৃক্ত। সঙ্গীত কাব্য বা নাটক প্রতিটি ধারারই বিবর্তন আছে, স্বতন্ত্র মহিমাও আছে। কিন্তু সেই ধারাগত বিবর্তন বা স্বতন্ত্র্যই একমাত্র সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। তার মধ্যেও বিধৃত আছে নিগূড় এবং ব্যপকতর তাৎপর্য। বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে গেলে যা আলাদা বলে মনে হয়, সমগ্রভাবে দেখলে তার মধ্যে এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্যসূত্রও উপলব্ধি করা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই সত্য উপলব্ধি সম্বন্ধে ‘আত্মপরিচয়’ এ বলেছেন

কাব্য সম্বন্ধে একথা বললেও সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে তা কবির রচনার সমস্ত ধারায়ই সত্যবলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। কবিচিত্তের সহজাত ছন্দ সচেতনতা, সৌন্দর্য্য এবং শিল্পবোধ নানা বিবর্তনের মাধ্যমে কাব্য গীতিনাট্য রূপক-সাংকেতিক নাট্য এবং অবশেষে নৃত্যনাট্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে নব নব প্রকাশের মধ্যে পেয়েছেন বিরাট ব্যাপ্তি ।
আরও দেখুন :