আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা গীতিনাট্যে ব্যবহৃত রাগ-রাগিনী ও তাল। প্রতিটি গীতিনাট্যেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগ-রাগিনী ব্যবহৃত। রামতারণ সান্যাল প্রমুখ সুরকার বা গীতিকার রাগসঙ্গীতেরই আশ্রয় নিয়েছেন। এইসব গীতিনাট্যের মধ্যে নির্বোক্ত রাগ- রাগিনীগুলি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত।
বাংলা গীতিনাট্যে ব্যবহৃত রাগ-রাগিনী ও তাল

১. ইমনকল্যাণ
কল্যাণ এবং কেদার রাগের মিশ্রণে সৃষ্ট একটি রাগ।
২. ঝিঁঝিট
রাগ ঝিঁঝিট উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে খাম্বাজ ঠাটের রাগ বিশেষ। প্রকৃতি ক্ষুদ্র। এই রাগে সামান্য পরিমাণ কোমল গান্ধার ব্যবহার করা যায়। আলাপ ও রাগের বিস্তার করা হয় মন্দ্র ও মধ্য সপ্তকে। ঝিঁঝিট সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন।
৩. পিলু
পিলা ছোট্ট মিষ্টি রাগ। ছোট হলেও এই রাগটি ভীষণ হৃদয়কাড়া প্রেম-বিরহ-ভক্তির রাগ।
৪. খাম্বাজ
খাম্বাজ রাগটি হালকা মেজাজের রাগ। খাম্বাজ ঠাটের নিজস্ব রাগ- রাগ খাম্বাজকে একটি আদর্শ মেলোডি হিসাবে মানা হয়। এর মাধ্যমে আলাদা আলাদা কিংবা যুগপৎভাবে বিরহ-মিলনের সুরকে প্রকাশ করা যায়।
৫. বারোঁয়া
বারওয়া একটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় রাগ। এটা রাগ দেশী (রাগ) এর অনুরূপ। এটি রাগ সিন্ধুরার কাছাকাছিও, তবে কীভাবে এটি আরোহী (আরোহী) নড়াচড়ায় SR m এবং অবতরণের সময় কোমল গান্ধার (g) এর কাছে পৌঁছায় তাতে নিজেকে আলাদা করে। বারওয়া আগ্রা ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রিয়, এবং বারোয়ার বেশ কিছু রেকর্ডিং প্রবীণ এবং সেইসাথে আগ্রার সমসাময়িক কণ্ঠশিল্পীদের দ্বারা পাওয়া যায়।
৬. বিভাষ
বিভাস (কখনও কখনও ‘বিভাস’ও বলা হয়) ভৈরব ঠাটের অন্তর্গত একটি পেন্টাটোনিক রাগ। এই রাগ ভোর বেলায় গাওয়া হয়। এটি রাগ দেশকরের সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ কারণ দেশকারের শুদ্ধ ধা এবং শুদ্ধ রে পরিবর্তন এটিকে বিভাসে রূপান্তরিত করে।
৭. বাহার
বাহার রাগটি রাগ মালহারের সাথে খুব সাদৃশ্যপূর্ণ (কিন্তু এখনও স্বতন্ত্র) । এই রাগটি কাফি থাট থেকে এসেছে।
৮. যোগিয়া
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় এই রাগ নিয়ে লিখেছিলেণ – ভৈরব রাগের অনুষঙ্গে আরো একটি রাগের কথা বিশেষভাবে মনে আসে এবং সেটি হলো রাগ ‘যোগিয়া’। মনে হয় উত্তর ভারতের গ্রামাঞ্চলে যোগী শব্দটিই অপভ্রংশ যোগিয়া হয়ে গেছে। নিতান্তই দেহাতী অপভ্রংশ, যার মধ্যে একই সঙ্গে স্নেহ আর ভক্তি মিশে আছে। ‘বঁধু’ থেকে যেমন ‘বঁধুয়া’, সেই রকম। যোগী হলো প্রধান, প্রাজ্ঞ এবং পরিণত। কিন্তু যোগিয়া হলে তরুণ কিন্তু নবোদিত সূর্যের মতো দীপ্ত, ভোরের মতো উদাস এবং সুদূরের। তার পথচলা সদ্য শুরু হয়েছে, কিন্তু সে বহুদূরের যাত্রী। নবীন জটাধারী, সুন্দর কান্তি সে গৈরিকধারী যোগী সন্ন্যাসী। সংসার ছেড়ে সে চলেছে পরমার্থের সন্ধানে আর তার বিরহে ব্যাকুলা এই বিশ্বপ্রকৃতি। সেই বিরহই যোগিয়ার স্থায়ী ভাব। ভৈরব উদাসীন আর যোগিয়া যেন ভৈরবের প্রেমের সঞ্চার!
যোগিয়ার এই প্রেমভাব প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত একটি ঠুংরির বাণীতে। ‘পিয়া মিলন কি আশ…’ গানটি অমর হয়ে আছে ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর অমৃত কণ্ঠে। এই গানটি অবশ্যই শোনা চাই। তবে যোগিয়া রাগে ঠুংরির রেকর্ড আরো অনেক থাকলেও বাংলা গানের সংখ্যা তত নয। তার মধ্যে দুটি গানের কথা উল্লেখ করব। প্রথম গানটি হলো, ‘বাঁশি বাজে যোগিয়ায়, যামিনী হলো যে ভোর’, শিল্পী: প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। রেকর্ডটি অনেক পুরোনো, কিন্তু যোগিয়া রাগে বাংলা গানের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। গানটির গীতিকার কে, তা মনে করতে পারি না। আর অন্য যে গানিটর কথা বলব, সেটি একটি নজরুল গীতি। গানটির প্রথম লাইনটি হলো, ‘সাজিয়াছ যোগী বল কার লাগি, অরুণ বিবাগী’। গানটি রেকর্ড আছে বহু শিল্পীর কণ্ঠেই।
কিন্তু বাংলা গান দুটির বাণী লক্ষ্য করুন। দুটি গানের বাণীতেই রাগের ইঙ্গিত দেওয়া আছে। প্রথম গানটিতে তো স্পষ্টতই বলা হচ্ছে, ‘বাঁশি বাজে যোগিয়ায়, যামিনী হলো যে ভোর’। অর্থাৎ যোগিয়া রাগের সময় যে ভোর বেলা সেটাও বলে দেওয়া হলো। কাজী নজরুল ইসলাম ‘যোগিয়া’ নামটি সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও, ‘যোগী’ শব্দটির মধ্যেই তার আভাসটুকু রেখেছেন।
যদিও কোনো গানের বাণীতে কোনো রাগের নাম থাকলেই যে, গানটি নিশ্চিতভাবে সেই রাগেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। যেমন, ধরা যাক, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটির কথা। এর অন্তরার সেই ঐ লাইনটির কথা ভাবুন- ‘বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে সুদূর দিগন্তে’ লক্ষ্য করুন, এই অংশটুকু দুবার উচ্চারণ করা হচ্ছে।
প্রথমবারের উচ্চারণে গানটির আগের অংশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, কিন্তু দ্বিতীয়বারে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সুর যেন হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক বাঁক নিয়ে আমাদের চেতনাকে কোন এক অলৌকিক স্নিগ্ধতার গভীরে পৌঁছে দেয়, তার কুল কিনারা পাওয়া যায় না। সেই স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লাগে দ্বিতীয়বার এবং শুধুমাত্র ‘ললিত বসন্তে সুদূর দিগন্তে’ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ‘… সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী’ পর্যন্ত এবং তারপরেই গানটি আবার ফিরে যায় তার আগের ভাবে। কিন্তু এর থেকে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, গানটি আসলে ‘ললিত-বসন্ত’ রাগে আধারিত, তাহলে খুবই ভুল হবে। গানটিতে ললিত রাগের স্পর্শও নেই। পুরোটাই বাহার রাগাশ্রিত, শুধুমাত্র ওই অংশটিতে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে মাত্র। তবে সে বসন্ত আমাদের চেনা বসন্ত রাগটি নয়। এ আরেক রকম বসন্ত, যা অতিপ্রাচীন রাগ এবং শুদ্ধবসন্ত বা আদিবসন্ত নামে পরিচিত।
রাগের নামটি শুনেই গানের রাগ অনুমান করতে গেলে এমন বিভ্রান্তি অবশ্য খুবই সম্ভব। তবে অনেক গানের মধ্যেই রাগের নাম অনেক সময় ভারী সুন্দরভাবে এবং সুকৌশলে গীতিকাররা উচ্চারণ করতেন; এ বিষয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
৯. টোড়ি
১০. আলাইয়া
১১. আড়ানা বাহার
১২. সারং
১৩. পরজ-কালাংড়া
১৪. কুকুভ
১৫. ললিত
১৬. সাহানা
১৭. জয়জয়ন্তী
১৮. মল্লার
১৯. হাম্বীর
২০. পরজবাহার
২১. মূলতান-খাম্বাজ

এর সঙ্গে নিবলিখিত তালগুলিও তখন এসব গীতিনাট্যে প্রচলিত ছিল:
১. ত্রিতাল
২. চৌতাল
৩. কাওয়ালি
৪. আড়াঠেকা
৫. মধ্যমান ঠেকা
৬. জলদ মধ্যমান
৭. ঝাঁপতাল
৮. ঢিমে তেতালা
৯. একতালা
১০. খ্যামটা
১১. ঠুংরী
এত উপাদান থাকা সত্ত্বেও গীতিনাট্যের আবেদন সস্তা রুচিকে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এই কারণেই গীতিনাট্যের সমস্ত উপাদান ও আয়োজন প্রায় ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। উনিশ শতকের বাংলাদেশে সঙ্গীতের যে চর্যা শুরু হয়েছিলো তার পিছনে কতখানি শিল্পচেতনা ছিলো তা বলা কঠিন।

তবে আসরে বা বৈঠকে চলতি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সে দিন আভিজাত্যের নিদর্শন বলে গণ্য হতো। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল। সম্ভবতঃ তারই প্রভাব গীতিনাট্যের গানের মধ্যে। ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দ থেকে বাল্মীকি-প্রতিভা’র রচনাকাল : ১৮৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত গীতিনাট্যধারার এটাই ছিল সাধারণ চেহারা ।
আরও দেখুন :