আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশচেতনার গান। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিষয়টি বেশ জটিল। সেখানে রয়েছে নানা মাত্রিক ভাবনার মিশ্র চরিত্র, তাতে স্ববিরোধিতারও অভাব নেই। তাঁর স্বদেশভাবনা যেমন রাজনৈতিক চিন্তা, তেমনি সমাজভাবনা-নির্ভর। সেখানে যুক্ত হয়েছে ভারতবর্ষীয় ইতিহাসের উপলব্ধি – যে-উপলব্ধির মধ্যমণি প্রাচীন ভারত, সনাতন ভারত। যে-ভারতের চরিত্র সমাজপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান নয়। আবার সে-সমাজভাবনায় একপর্যায়ে এসে যুক্ত হয়েছে পল্লিপুনর্গঠন ও উন্নয়ন বিষয়ক আধুনিক চেতনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশচেতনার গান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশচেতনার গান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ পর্যায়ের গানের তালিকা
১ . আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ,
কী মায়া গো কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো
মরি হায়, হায় রে মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা,
আমি নয়নজলে ভাসি ॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে তখন খেলাধুলা সকল ফেলে,
ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি।
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায় ঢাকা তোমার পল্লীবাটে
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার
রাখাল তোমার চাষি
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে
দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা,
তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি ॥
২ . ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা তোমাতে বিশ্বময়ীর,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে
তোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার,
মরণ তোমার বুকে তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥
অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা ও মা,
অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা
তবু জানিনে যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা আমার জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে, শক্তিদাতা ॥
৩ . যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে। দেশের মাটি একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো,
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়
তবে পরান খুলে একলা চলো রে॥
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলোরে যদি সবাই ফিরে যায়,
ওরে ওরে ও অভাগা, যদি গহন পথে যাবার কালে
কেউ ফিরে না চায় তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে ॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে॥
৪ . তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা বলে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিড়ে হয়তো রে ফল ফলবে না।
আসবে পথে আঁধার নেমে তাই বলে কি রইবি থেমে
তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি হয়তো বাতি জ্বলবে না।
শুনে তোমার মুখের বাণী আসবে ঘিরে বনের
প্রাণী হয়তো দেশের মাটি তোমার আপন ঘরে পাষাণ হিয়া গলবে না।
বদ্ধ দুয়ার দেখলি বলে অমনি কি তুই আসবি চলে
তোরে বারেবারে ঠেলতে হবে হয়তো দুয়ার টলবেনা।
৫ . এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে
জয় মা বলে ভাসা তরী।
ওরে রে ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,
প্রাণপণে ভাই,
ডাক দে আজি
তোরা সবাই মিলে বৈঠা নে রে
দিনে দিনে বাড়ল দেনা, ও ভাই,
করলি নে কেউ বেচা কেনা
খুলে ফেল সব দড়াদড়ি হাতে নাই রে কড়া কড়ি।
ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে, মুখ দেখাবি কেমন করে ওরে,
দে খুলে দে পাল তুলে দে যা হয় হবে বাঁচিমরি।
৬ . নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।
ওরে মন, হবেই হবে
পাষাণসমান আছে পড়ে, প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,
আছে যারা বোবার মতন দেশের মাটি তারাও কথা কবেই কবে ॥
সময় হল, সময় হল যে যার আপন বোঝা তোলো রে
দুঃখ যদি মাথায় ধরিস সে দুঃখ তোর সবেই সবে।
ঘণ্টা যখন উঠবে বেজে দেখবি সবাই আসবে সেজে
এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে ॥
৭ . আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই,
মরব না তরীখানা বাইতে দেশের মাটি গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে
তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না,
কান্নাকাটি ধরব না। শক্ত যা তাই সাধতে হবে,
মাথা তুলে রইব ভবে দেশের মাটি সহজ পথে চলব ভেবে পড়ব না,
পাঁকের পরে পড়ব না।
ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে
বিপদ যদি এসে পড়ে সরব না, ঘরের কোণে সরব না।
৮ . আপনি অবশ হলি, তবে বল দিবি তুই কারে?
উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া, ভেঙে পড়িস না রে।
করিস নে লাজ, করিস নে ভয়,
আপনাকে তুই করে নে জয়
সবাই তখন সাড়া দেবে ডাক দিবি তুই যারে
বাহির যদি হলি পথে ফিরিস নে আর কোনোমতে,
থেকে থেকে পিছন-পানে দেশের মাটি চাস নে বারে বারে।
নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে, ভয় শুধু তোর নিজের মনে
অভয়চরণ শরণ করে বাহির হয়ে যা রে॥
৯ . আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাইছেড়ে ভাই কদিন থাকে?
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে আয় বলে ঐ ডেকেছে কে,
সেই গভীরঘরে উদাস করে আরকে কারে ধরে রাখে?
যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই প্রাণের টানে টেনে আনে সেই প্রাণের
বেদন জানে না কে? মান অপমান গেছে ঘুচে,
নয়নের জল গেছে মুছে সেই নবীন আশে
হৃদয় ভাসে ভাইয়ের দেশের মাটি পাশে ভাইকে দেখে।
কত দিনের সাধন ফলে মিলেছি আজ দলে দলে
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয়রে মাকে।
১০ . আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো ক’রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
১১ . সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো
নিজেরে করো জয়।
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,
নিজের পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান নীরব হয়ে,
নম্র হয়ে, পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়।
১২ . নাই নাই ভয় হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার।
খনেখনে তুই হারায়ে আপনা সুপ্তিনিশীথ করিসযাপনা
বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার।
হলে জনে তোর আছে আহ্বান, আহ্বান লোকালয়ে
চিরদিন তুই গাহিবি যে গান সুখে দুখে লাজে ভয়ে।
ফুলপল্লব নদীনির্ঝর সুরে সুরে তোর মিলাইবে
স্ব ছন্দে যে তোর স্পন্দিত হবে আলোক অন্ধকার।
১৩ . ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে ওরে ভাই,
বাইরে মুখ আঁধার দেখে টলিস নে ওরে ভাই।
যা তোমার আছে মনে সাধ্যে তাই পরানপণে,
শুধু তাই দশজনারে বলিস নে ওরে ভাই।
একই পথ আছে ওরে চলো সেই রাস্তা ধরে,
যে আসে তারই পিছে চলিস নে ওরে ভাই!
থাক না আপন কাজে, যা খুশি বলুক-না যে,
তা নিয়ে গায়ের জ্বালায় জ্বলিস নে ওরে ভাই।
১৪ . এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা হাতে হাতে ধরগো।
আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন-স্বর্গ।
ওরে ঐ উঠেছে শঙ্খ বেজে, খুলল দুয়ার মন্দিরে যে
লগ্ন বয়ে যায় পাছে, ভাই কোথায় পূজার অর্ঘ্য?।
এখন যার যা কিছু আছে ঘরে সাজা পূজার থালারপরে,
আত্মদানের উতসধারায় মঙ্গলঘট ভরগো।
আজ নিতেও হবে, আজ দিতেও হবে
বাঁচতে যদি হয় বেঁচে নে, মতে হয় তো মরগো
১৫ . বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই।
শুধু তুই ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষী ঠেলিস নে ভাই।
একটা কিছু করে নে ঠিক, ভেসে ফেরা মরার অধিক
বারেক এ দিক বারেক ও দিক, এ খেলা আর
খেলিস নে ভাই
মেলে কিনা মেলে রতন করতে তবু হবে যতন
না যদি হয় মনের মতন চোখের জলটা ফেলিস নে ভাই।
ভাসাতে হয় ভাসা ভেলা, করিস নে আর হেলাফেলা
পেরিয়ে যখন যাবে বেলা তখন আঁখি মেলিস নে ভাই
জাতীয় সংগীত পর্যায়ের গান
১৬ . ভারত রে, তোর কলঙ্কিত পরমাণুরাশি
যত দিন সিন্ধু না ফেলিবে গ্রাসি
তত দিন তুই কাঁদ রে
এই হিমগিরি স্পর্শিয়া আকাশ
প্রাচীন হিন্দুর কীর্তি-ইতিহাস
যত দিন তোর শিয়রে দাঁড়ায়ে অশ্রুজলে তোর বক্ষ
ভাসাইবে তত দিন তুই কাঁদ রে
যে দিন তোমার গিয়াছে চলিয়া সে দিন তো আর
আসিবে না।
যে রবি পশ্চিমে পড়েছে ঢলিয়া
সে আর পুরবে উঠিবে না।
এমনি সকল নীচ হীনপ্রাণ
জনমেছে তোর কলঙ্কী সন্তান
একটি বিন্দু অশ্রুও কেহ তোমার তরে দেয় না ঢালি।
যে দিন তোমার তরে শোণিত ঢালিত সে দিন যখন
গিয়াছে চলি তখন, ভারত, কাঁদ রে ॥
তবে কেন বিধি এত অলঙ্কারে
রেখেছ সাজায়ে ভারতকায়।
ভারতের বনে পাখি গায় গান,
স্বর্ণমেঘ-মাখা ভারতবিমান
হেথাকার লতা ফুলে ফুলে ভরা,
স্বর্ণশস্যময়ী হেথাকার ধরা
প্রফুল্ল তটিনী বহিয়ে যায়।
১৭ . অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী,
গা লো সেই-সব পুরানো গান
বহুদিনকার লুকানো স্বপনে
ভরিয়া দে-না লো আঁধার প্রাণ ॥
হা রে হতবিধি, মনে পড়ে তোর সেই একদিন ছিল।
আমি আর্যলক্ষ্মী এই হিমালয়ে এই বিনোদিনী
বীণা করে লয়ে যে গান গেয়েছি সে গান
শুনিয়া জগত চমকি উঠিয়াছিল ৷
আমি অর্জুনের আমি যুধিষ্ঠিরে
করিয়াছি স্তন্যদান ।
এই কোলে বসি বাল্মীকি করেছে পুণ্য রামায়ণ গান।
আজ অভাগিনী আজ অনাথিনী
ভয়ে ভয়ে ভয়ে লুকায়ে লুকায়ে নীরবে নীরবে কাঁদি,
পাছে জননীর রোদন শুনিয়া একটি সন্তান
ওঠে রে জাগিয়া।
কাদিতেও কেহ দেয় না বিধি ॥
হায় রে বিধাতা জানে না তাহারা সে দিন গিয়াছে
চলি যে দিন মুছিতে বিন্দু অশ্রুধার কত-না করিত
সন্তান আমার
কত-না শোণিত দিত রে ঢালি ॥
১৮ . শোনো শোনো আমাদের ব্যথা দেবদেব
প্রভ-দয়াময় আমাদের ঝরিছে নয়ন,
আমাদের ফাটিছে হৃদয় চিরদিন আঁধার না রয় রবি উঠে,
নিশি দূর হয়। এ দেশের মাথার উপরে এ নিশীথ হবে না কি ক্ষয় ।
চিরদিন ঝরিবে নয়ন ? চিরদিন ফাটিবে হৃদয় ?
মরমে লুকানো কত দুখ ঢাকিয়া রয়েছি ম্লান
মুখ কাঁদিবার নাই অবসর কথা নাই, শুধু ফাটে বুক।
সঙ্কোচে ম্রিয়মাণ প্রাণ, দশ দিশি বিভীষিকাময়
হেন হীন দীনহীন দেশে বুঝি তব হবে না আলয় ।
চিরদিন ঝরিবে নয়ন, চিরদিন ফাটিবে
হৃদয় কোনো কালে তুলিব কি মাথা।
জাগিবে কি অচেতন প্রাণ ।
ভারতের প্রভাতগগনে উঠিবে কি তব জয়গান।
আশ্বাসবচন কোনো ঠাঁই কোনোদিন শুনিতে না পাই শুনিতে
তোমার বাণী তাই মোরা সবে রয়েছি চাহিয়া। ব
লো, প্রভু, মুছিবে এ আঁখি চিরদিন ফাটিবে না হিয়াঃ
১৯ . ঢাকো রে মুখ, চন্দ্রমা, জলদে।
বিহগেরা থামো থামো।
আঁধারে কাঁদো গো তুমি ধরা
পাবে যদি গাও রে সবে গাও রে শত অশনি-মহানিনাদে
ভীষণ প্রলয়সঙ্গীতে জাগাও জাগাও,
জাগাও রে এ ভারতে বনবিহঙ্গ, তুমি ও সুখগীতি গেয়ো না।
প্রমোদমদিরা ঢালি প্রাণে প্রাণে
আনন্দরাগিণী আজি কেন বাজিছে এত
হরমে ছিড়ে ফেল্ বীণা আজি বিষাদের দিনে
২০ . দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহিয়ে
নগরে প্রান্তরে বনে বনে। অশ্রু ঝরে দু নয়নে,
পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।
জ্বলিয়া উঠে অযুত প্রাণ এক সাথে মিলি
এক গান গায় নয়নে অনল ভায় শূন্য কাপে অভ্রভেদী বজ্রনির্ঘোষে !
ভয়ে সবে নীরবে চাহিয়ে ভাই বন্ধু
তোমা বিনা আর মোর কেহ নাই।
তুমি পিতা, তুমি মাতা, তুমি মোর সকলই।
তোমারি দুঃখে কাঁদিব মাতা, তোমারি দুঃখে কাঁদাব।
তোমারি তরে রেখেছি প্রাণ, তোমারি তরে ত্যজিব।
সকল দুঃখ সহিব সুখে তোমারি মুখ চাহিয়ে।
পূজা ও প্রার্থনা পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
২১ . যেথায় সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে সবহারাদের মাঝে
যখন তোমায় প্রণাম করি আমি প্রণাম আমার
কোনখানে যায় থামি
তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে
সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে
অহঙ্কার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের
রিক্তভূষণ দীন দরিদ্র সাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে
ধনে মানে যেথায় আছে ভরি
সেথায় তোমার সঙ্গ আশা করি,
সঙ্গী হয়ে আছ যেথায় সঙ্গীহীনের ঘরে
সেবায় আমার হৃদয় নামে না যে সবার পিছে,
সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে
২২ . আর নহে, আর নয়, আমি করি নে আর ভয়।
আমার ঘুচল কাদন, ফলল সাধন হল বাঁধন ক্ষয় ॥
ওই আকাশে ওই ডাকে। আমার আর কে ধরে রাখে-
আমি সকল দুয়ার খুলেছি, আজ যাব সকলময়
ওরা ব’সে ব’সে মিছে শুধু মায়াজাল গাঁথিছে—
ওরা কী যে গোনে ঘরের কোণে আমায় ডাকে পিছে।
আমার অস্ত্র হল গড়া, আমার বর্ম হল পরা-
এবার ছুটবে ঘোড়া পবনবেগে, করবে ভূবন জয় |
২৩ . বাঁধা দিলে বাঁধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কি করবি বড়াই, সরতে হবে।
লুঠ-করা ধন ক’রে জড়ো কে হতে চাস সবার বড়ো-
এক নিমেষে পথের ধুলায় পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে ।
নীচে বসে আছিস কে রে, কাঁদিস কেন?
লজ্জাডোরে আপনাকে রে বাঁধিস কেন?
ধনী যে তুই দুঃখধনে সেই কথাটি রাখিস মনে-
ধুলার পরে স্বর্গ তোমায় গড়তে হবে-
বিনা অস্ত্র, বিনা সহায়, লড়তে হবে ॥
২৪ . এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোর পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে
সে পথে তোর যেতেই হবে ॥
অভয় মনে কন্ঠ ছাড়ি গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায় ঢেউযে তোরে খেতেই হবে
পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি ছুটি তোরে পেতেই হবে
চলার পথে কাঁটা থাকে, দ’লে তোমায় যেতেই হবে।
সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে
জীবনকে তোর ভ’রে নিতে
মরণ আঘাত খেতেই হবে ।
২৫ . সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে ভ্রমিছ দীনপ্রাণে।
সতত হায় ভাবনা শত শত, নিয়ত ভীত পীড়িত
শির নত কত অপমানে
জানো না রে অধ-ঊর্ধ্বে বাহির
অন্তরে ঘেরি তোরে নিত্য রাজে সেই অভয় আশ্রয়।
তোলো আনত শির, তাজো রে ভয়ভার
সতত সরলচিতে চাহো তাঁরি প্রেমমুখপানে ॥
বিচিত্র পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
২৬ . ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ ।
এই আঁধার সাঁঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ।
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্ৰ,
তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে
আপন আলো জ্বেলেছ তোমার যা আছে
তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে,
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।
তুমি আঁধার বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ,
তুমি ছোটো হয়ে নাও গো ছোটো,
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন করে ফেলেছ।
২৭ . ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও,
বাঁধ ভেঙে দাও, দেশের মাটি বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও ॥
শুকনো গাঙে আসুক জীবনের বন্যার
উদ্দাম কৌতুক- ভাঙনের জয়গান গাও ।
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক.
যাক ভেসে যাক, দেশের মাটি যাক ভেসে যাক।
আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ
কোন্ নূতনেরই ডাক।
রুদ্ধ তাহারি দ্বারে দুর্বার বেগে ধাও
২৮ . আমি তোমারি মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা-
তবে আমার মানবজনা কেন বঞ্চিত করা ॥
পবিত্র জানি যে তুমি পবিত্র জন্মভূমি,
মানবকন্যা আমি যে ধন্যা প্রাণের পুণ্যে
ভরা কোন স্বর্গের তরে ওরা তোমায়
তুচ্ছ করে রহি তোমার রক্ষোপরে।
আমি যে তোমারি আছি নিতান্ত কাছাকাছি,
তোমার মোহিনীশক্তি দাও আমারে হৃদয়প্রাণহারা ॥
আরও দেখুন :