আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় গীতিনাট্যের মঞ্চকলা ও রূপসজ্জা
গীতিনাট্যের মঞ্চকলা ও রূপসজ্জা
গীতিনাট্যের মঞ্চকলা ও রূপসজ্জা
রবীন্দ্রনাট্যকলার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চকলার বিবর্তনও নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। এই ধারাবাহিক বিবর্তনের পথে মঞ্চকলা নিয়ে যে বিচিত্র সমীক্ষা ও পরীক্ষা করা হয়েছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চোখে পড়ে এর এক প্রান্তে রয়েছে গীতিনাট্যের যুগ, প্রান্তে নৃত্যনাট্যের পর্ব আর বাল্মীকি প্রতিভা তারই ভূমিকা রচনা করেছে।
অপর বাস্তবিকপক্ষে নাট্যকলার সঙ্গে মঞ্চকলার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। শুধুমাত্র জীবনচেতনা বা কাব্যচেতনা নয়, অভিনয় দোগ্যতা মঞ্চের উপযোগিতা দর্শকের উপস্থিতি ও রসবোধ- এসবের দিকে তাকিয়ে নাটক রচনা করতে হয়। এদিক থেকে নাট্যকারের স্বাধীনতা যেমন (রচনা দিক থেকে) সীমাবদ্ধ তেমনি নায়িত্ব অনেক বেশী।
শুধু তাই নয়, দেশকালের পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ বলেই বিশেষ বিশেষ যুগে প্রত্যেক দেশেই বিশিষ্ট মঞ্চকলার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক পরিবর্তন ও বিজ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সমতা রেখেই মঞ্চ কলাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। Amott এভাবে দু শ্রেণীর মঞ্চকলার কথা উল্লেখ করেছেন- that of convention and that of illusion.’ এই সঙ্গে তাঁর অভিমত হচ্ছে বর্তমান যুগ largely dominated by the theatre of illusion.
বাল্মীকি-প্রতিভার আগে যেসব নাট্যাভিনয় হয়েছিল, মঞ্চকলার দিক থেকে উনিশ শতকের মঞ্চকলারই পরিচয় পাই সেইসব অভিনয়ে। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয়:
‘অভিনয় দর্শনের জন্য কলিকাতার সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ ও ভদ্রলোকেরা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। অভিনয়ও খুব নিপুণতার সহিত সম্পদিত হইয়ছিল। স্টেজও যতদুর সুদৃশ্য ও সুন্দর করিয়া সাজান হইয়াছিল।’
এই সঙ্গে
‘দৃশ্যগুলিকে বাস্তব করিতে যতদূর সম্ভব, চেষ্টার কোনও ত্রুটি করা হয় নাই। বনদৃশ্যের সীনখানিকে নানাবিধ তরুলতা এবং তাহাতে জীবন্ত জোনাকী পোকা আটা দিয়া জুড়িয়া অতি সুন্দর এবং সুশোভন করা হইয়াছিল। দেখিছে, সত্যিকারের বনের মতোই বোধ হইত। এই সব জোনাকি পোকা ধরিবার জন্য অনেকগুলি লোক নিযুক্ত করিয়া, তাহাদের পারিশ্রমিক স্বরূপ এক একটি পোকার দাম দুই আনা হিসাবে দেওয়া হইয়াছিল।
পুনশ্চ-
‘ঝড়বৃষ্টির একটি দৃশ্য ছিল- তাহাতে সত্য সত্যই ঝর ঝর করিয়া জলধারা পড়িয়াছিল, তখন অনেকেরই তাহা প্রকৃত বৃষ্টি ধারা বলিয়া এম উৎপাদন করিয়াছিল’।
অন্যত্র-
সীনও যেখানে যেমনটি দরকার, পুকুরঘাট রাস্তা; স্টেজ আর্ট যতটুকু রিয়ালিস্টিক হতে পারে হয়েছিল। একটা বনের দৃশ্য ছিল, অন্ধকার বনের পথ…. সেই বনের সীন এলেই রবি ঠাকুর অন্ধকার বনপথে জোনাকি পোকা মুঠো মুঠো করে ছেড়ে দিতেন।
রঙ্গমঞ্চের এই ঐতিহ্যের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মঞ্চের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। বাংলার লৌকিক মঞ্চকলার বা নাট্যকলার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে অনেক পরে।
হয়তো বা মঞ্চকালার ঐ কৃতিমতা প্রথম থেকেই তাঁর চোখে পড়েছিল। তাই বলা হয়েছে, সম্ভবত: এ কথা ভেবেই ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বাল্যকালে নাটক ও অভিনয়ে যে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ স্পষ্টবোধের অগোচরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। তাহা বাংলাদেশের যাত্রাগান, কৃষ্ণলীলা, নিমাই সন্যাস নহে, তাহা সম্পূর্ণ ইউরোপীয় আদর্শে গড়া থিয়েটারের অনুসরণে রচিত নাটকের অভিনয়।
এইসব অভিনয়ের ক্ষীণ স্মৃতি-কণিকাগুলি বালকের অচেতন স্তরে সঞ্চিত ছিল এবং উত্তরকালে পূর্ণাঙ্গ আর্টরূপে কবির জীবনে প্রকাশ পায়। মঞ্চের এই বাস্তবানুকৃতির প্রবণতার সঙ্গে রূপসজ্জার মধ্যেও পাশ্চাত্য আদর্শের অনুকরণও লক্ষ্য করা যায়। মঞ্চসজ্জায় দামী ভেলভেট, সিল্কের কাপড় ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। সেই সঙ্গে পোষাকের মধ্যেও রীতিমতো বনেদিয়ানা ফুটে ওঠে।
বাল্মীকির পোশাক তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় আদর্শে- পিঠের দিকে যে লম্বা জোব্বা মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিলিতী রাজরাজাদের mantle এর আভাস পাওয়া যায়। তার সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা।
দস্যুদের সাজসজ্জাদের মধ্যে যে ‘বাস্তবতা’ দেখি, তা মনগড়া দুটি কারণে- এক, তরুণ প্রযোজকগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব বা অল্পতা, আর সেই বাস্তবের রূঢ়তা ও স্থূলতা একটু শোভন সহনীয় না করে নিয়ে উপায় ছিল না; তাই এদের কাবুলীওয়ালাদের মতো সাজ ‘ইয়া গোঁফ এবং ইয়া পাগড়ি’।
রীতিমতো ভীতিব্যঞ্জক সেই পোশাক! বাংলাদশের দস্যু বা ডাকাতদের যে স্বাভাবিক বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে খালি গায়ে কালিগুলি মাখা! অথচ মঞ্চে পুরোপুর এই সজ্জা শোভন নয়। এই জন্যেই বলছি, এ বাস্তবতা মনগড়া বা মনোকল্পিত।
মঞ্চকলার সঙ্গে চিত্রকলার একটা যোগ ছিল। তৎকালীন ভারতীয় চিত্রশিল্পে রবিবর্মা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তাঁর রূপকল্পনার মধ্যে পশ্চিমী Illusion সৃষ্টির প্রবণতাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। পরবর্তীকালে অবশ্য সাজসজ্জার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। দস্যুদের আগের রূপসজ্জার বদলে দেখা দিল ধুতি, ফতুয়া, পাগড়ির বদলে মাথায় ‘একটা ফেটি বাঁধা’। ইন্দিরা দেবীর অভিমত- এইসব অভিনয়ের আদ্য মধ্য আস্তরূপের রূপসজ্জা বিশেষভাবে আলোচনার যোগ্য। খুবই স্বাভাবিক যে অদিযুগে মঞ্চকলা বা সাজসজ্জার এই আদর্শ পরবর্তীযুগে অনুসৃত হয় নি।
বস্তুত: Amott রমঞ্চের কথা বলতে গিয়ে যে Illusion-এর কথা বলেছেন, এই পর্বের মঞ্চকলায় ঐ আদর্শই লক্ষ্য করা যায়। পোশাকে আগেকার জৌলুষ ছিল “সখাদের বেশ ছিল খুব টকটকে রঙ্গের সাটিনের পাঞ্জাবি ও ধুতি, তার সঙ্গে ঈষৎ গোঁফের রেখা। আর মায়াকুমারীদের হাতের দন্ডের মুন্ডে ইলেকট্রিক আলো জলছিল আর নির্ভছিল, বোধ হয় বিলিতি পরীর অনুকরণে। তখন সব বিষয়ে বিলিতী অনুকরণটাই প্রবল ছিল।
এ থেকে সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ইউরোপীয় মঞ্চকলার গীতিনাট্যগুলি নাট্যকলার দিক থেকে উৎকর্ষ লাভ করলেও মঞ্চকলর দিক থেকে এই গীতিনাট্যগুলিতে কোনো উল্লেখযোগ্য মৌলিকতা দেখা যায় নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনো মৌলিক নির্দেশের কথা জানা যায় না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তনা যে, স্টেজসজ্জায় তখনো তাঁদের হাত পড়ে নি ।
মনে হয় প্রকারান্তরে তিনিও এই কথাই বলতে চেয়েছেন। ঘরোয়া পরিবেশের গণ্ডী অতিক্রম করে বাস্তবতার মোহ কাটিয়ে রবীন্দ্রমঞ্চকলা পরবর্তী কালে বিবর্তনের পথে এগিয়ে গেছে।
আরও দেখুন :