আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
স্বদেশি আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। রাজনীতি থেকে শুরু করে আর্থ- সামাজিক, শিল্প-সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রেই ১৯০৫ সালে এক যুগান্তকারী আন্দোলনের সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য এ আন্দোলেনের পূর্বেও বাংলা কবি-সাহিত্যিক সমাজের প্রায় সকলেই দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন যাদের মধ্যে অন্যতম রামনিধি গুপ্ত (১৭৪১-১৮৩৪), রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১),
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭- ১৮৮৭), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-৬৯), সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯২৫) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রাসাদ সেনের গান বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। এঁদের কারো গানে উঠে এসেছে দেশের অতীত গৌরব কাহিনি, কেউ করেছেন স্বদেশের বর্ণনা। “দেশাত্মবোধক গান যা রচনা করেছেন তাঁদের সকলের গান এক ধরনের নয়।
কারও কারও গানে দেশের অতীত গৌরব কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, কারও গানে স্বদেশের গুণগান করা হয়েছে, কারণ গানে দেশমাতৃকার বন্দনা করা হয়েছে, কারও গানে সোজাসুজি বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। এ সকল ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলালের নাম গীতিকবি হিসেবে অত্যন্ত গৌরবের, বিশেষত স্বদেশচেতনাবাহী সংগীত রচনার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।
তাঁর নাটকের জন্য রচিত গানসমূহ বেশি জনসমাদর পায়। মঞ্চের জন্য রচিত এই সকল নাটকে অনেক স্বদেশপর্বের গান ব্যবহৃত হয়েছে-যা নাট্য অভিনেত্রীদের কণ্ঠে গীত হতে হতে অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর রচিত নাটকগুলো মূলত ইতিহাসের পটভূমিকায় ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত হতো।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে এবং তার পরবর্তী সময়ে স্বদেশপর্বের এই গানগুলো ঐতিহাসিক নাটকের পাত্র-পাত্রীর কণ্ঠে গীত হতো এবং মানুষ তা দেখে আবেগতাড়িত হতো। বহু মঞ্চে একই নাটক মঞ্চায়ন হতো। কারণ নাট্যকার দিজেন্দ্রলাল খ্যাতিমান নাট্যকারের সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর নাটকে ব্যবহৃত গানসমূহ শুনতে শুনতে মানুষের অন্তরমর্মে গ্রথিত হয়ে যেত।
সেই স্বদেশি গান আজো আমাদের কাছে তেমনি আদরের ও সম্মানের। ১৯০৫ সালে রচিত তাঁর ‘প্রতাপ সিংহ’ নাটকটি জনমনে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই নাটকের দেশপর্বের গানসমূহ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে সাধারণ মানুষের মনে বলিষ্ঠ স্বদেশানুভূতির সঞ্চার করে।
“সেদিন ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন, বাঙ্গালীর সেই চিরস্মরণীয় ‘অরন্ধন’ ও রাখী বন্ধনের পুণ্যাহ। সেদিন সকালবেলায় নয় কি দশটা বাজিয়াছে, এমন সময়ে, “কুস্তলীনের” হেমেন্দ্র বসু। (এইচ্ বোস) মহাশয় হঠাৎ দ্বিজেন্দ্রলালের কাছে আসিয়া ব্যস্ত সমস্তভাবে তাঁহাকে বলিলেন, -“আজ বিকালে গোলদীঘিতেও একটা প্রকাণ্ড সভা হবে। সেখানকার জন্য একটা গান লিখে দিন
এখনই চাই ছাপতে হবে।” বসু মহাশয়কে বিদায় দিয়া দ্বিজেন্দ্রলাল – তদ্দন্ডেই আমার সম্মুখে বসিয়া, অনধিক দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে একটি ‘আশ্চর্য্য রকমের উৎকৃষ্ট, অগ্নিগর্ভ গান- ঠিক যেন খেলার ছলে রচনা করিয়া ফেলিলেন।
দেশমাতৃকার প্রয়োজনে এমনি বহু তাৎক্ষণিক গান তিনি রচনা করেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে তাঁর রচিত স্বদেশপর্বের গান আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেরই মন স্বদেশের দৈন্য দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছে।
তেমনি এ গানেই আবার দুঃখ শোক থেকে পরিত্রাণের জন্য উজ্জীবিত হয়েছে। ‘প্রতাপ সিংহ’ নামক সর্বজন প্রসিদ্ধ নাটকটি তেমনি একটি স্বদেশের প্রতি আত্মজাগানিয়া সৃষ্টি । স্বদেশমূলক বা স্বদেশের প্রেরণামূলক কোরাস শ্রেণির গান রচনাতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জাতীয় সংগীত রচনায় তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান মেলে।
প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের সুরের মিলনে তাঁর কোরাস গানসমূহ এক অপূর্ব মাত্রায় পরিপূর্ণ। যদিও পূর্বের আলোচনায় পেয়েছি এই গানগুলোতে ভারতীয় রাগ-রাগিণী মূল উপজীব্য থাকা সত্ত্বেও তা অনুধাবন করা কঠিন। কারণ তিনি রাগ-রাগিণীর সাথে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকায় ইউরোপীয় সুরের চলনটির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। যেমন-তেমনভাবে শুধু জুড়ে দিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি।
বরং এই দুই ধারার সুরের সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে স্বদেশপ্রেমের গানের বাণীকে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেশের প্রতি অন্তরের গভীর প্রেম জাগানিয়া গানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং এই কাজে শ্রেষ্ঠ হওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। সুরের রসে তিনি গানের বাণীকে স্বদেশের মর্মবাণী করে তুলেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুর সমন্বয়ের মাধ্যমে এক সামগ্রিক শিল্পরূপ সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথও প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে বিদেশি সুরের প্রভাবে রচনা করেন তাঁর অনন্য সৃষ্টি গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ – ‘কালমৃগয়া’ ও ‘মায়ার খেলা’। দেশি-বিদেশি সুরের সমন্বয়ের কাজটিতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগামী। যদিও পরবর্তী জীবনে তাঁর রচনায় বিদেশি সুরের প্রয়োগ আর দেখা যায়নি। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সামগ্রিক সুর রচনাতেই বিদেশি সুরের প্রভাব রয়েছে।
তবে তা অত্যন্ত পরিমিতি ও পরিশীলিত বোধের মধ্যদিয়ে। স্বদেশি গান রচনার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ স্পষ্টত পরিলক্ষিত। মূলত বিদেশি সুরের কাটা কাটা সুরের ঢং-টির কারণে জাতীয়তাবাদী সুর রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অধিক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে রথীন্দ্রনাথ রায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
“দ্বিজেন্দ্রলালের রণ-সঙ্গীত “ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে”, “সেথা গিয়েছেন তিনি সমরে আনিতে” প্রভৃতি গান সুবিখ্যাত। উচ্ছ্বসিত আবেগ ও বলিষ্ঠ উদ্দীপনা এই জাতীয় সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য। ‘ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে’, জাতীয় ভূপালীভঙ্গিম গানটি বাংলা গানের ইতিহাসে একটি অদ্বিতীয় সঙ্গীত। দ্বিজেন্দ্রলালের এই শ্রেণীর গানে একটি ওজস্বিতা ও পৌরুষদৃপ্ত ভঙ্গি ফুটে উঠেছে।
যদিও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে সরাসরি স্বদেশি সভায় বক্তৃতা করেননি। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি এই আন্দোলনের পক্ষে এদেশবাসীর মনে অনুপ্রেরণার বীজ বপন করে চলেছিলেন। মাতৃপ্রেমে উত্তপ্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একান্ত আগ্রহেই স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ও প্রচারকের কাজ করেন।
রাজনৈতিক নেতাদের নানাবিধ আচরণের কারণে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র আন্দোলনে না জড়ালেও তাঁর লেখনির মধ্যদিয়ে সকলের মনে স্বদেশি ভাব জাগাতে বিপুল সহায়তা করেছেন। তিনি দেশমাতার প্রতি কতোটা তন্ময় ছিলেন সমন্বয়ের সাথে কতটা একাত্ম ছিলেন তা দেবকুমার রায় চৌধুরীর বক্তব্যে আরো স্পষ্ট হবে :
“সে সময়ে প্রায় প্রতিদিনই হরেক রকমে, ‘নানান বেশে, বিচিত্র ভাবে ও বিবিধ “ঢঙ্গে’ কত- সব বিপুল আয়োজন সহকারে কলিকাতার ইতর-ভদ্র, সংখ্যাতীত, উন্মত্ত জনসংঘ মন মাতানো স্বদেশী সঙ্গীত গাইতে গাইতে, শহরময় পথে-পথে পরিভ্রমণ করিয়া বেড়াইত; আর, সেই নয়নরঞ্জন, মনঃপ্রাণ-মোহন, অপূর্ব্ব শোভা-যাত্রার দৃশ্য দেখিয়া দেশপ্রাণ কবি আমাদের তখন আপন উদ্বেলিত অন্তরের উদ্দাম ভাবাবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া,
কখনও এতটুকু বালকের মত ‘আহ্লাদে আটখানা’ হইয়া ছুটিয়া আসিয়া স্বজন-বন্ধুদের জড়াইয়া ধরিতেন; কখনও উৎসাহভরে, উচ্চকণ্ঠে “বন্দেমাতরম্” বলিয়া আনন্দে হাতে তালি দিতে-দিতে ঐ সব সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে নৃত্য করিতে থাকিতেন; আবার কখনও বা বাষ্প সিক্ত লোচনযুগল ঊর্ধ্বপানে উন্মুক্ত করিয়া,

প্রেমাকুল প্রাণে মা, মা বলিয়া, যথার্থই যেন কাহার অপার্থিব ধ্যানে বিভোর হইয়া যাইতেন! এ-সব অবস্থার তাঁহার সেই হর্ষোজ্জ্বল, রক্তিম মুখে কিংবা উল্লাস-বিস্ফারিত নয়নন্বয়ে উৎসাহ, আনন্দ ও উদ্দীপনার যে এক জ্বলন্ত জ্যোতিঃপুঞ্জ বিকীর্ণ হইতে থাকিত, “না দেখিয়া, আজ কাহারও সাধ্য নাই যে, সে শোভা আংশিকরূপেও অনুমান কি কল্পনা করিতে পারে।
আরও দেখুন :