আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্র নৃত্যের বৈশিষ্ট্য ও প্রাচীন নৃত্যের তুলনা। উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। শিল্প-সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর প্রবল উপস্থিতি। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, গান, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি রচনা এবং পরিণত বয়সে চিত্রকলাচর্চা-বাঙালির সকল আনন্দ-বেদনায়, সংকটে তাঁকে পেয়েছে পথিকৃতের ভূমিকায়। বাঙালির আধুনিক নৃত্যচর্চায়ও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
রবীন্দ্র নৃত্যের বৈশিষ্ট্য ও প্রাচীন নৃত্যের তুলনা
রবীন্দ্র নৃত্য বা রাবীন্দ্রিক নৃত্য এমন এক নৃত্য, যা সাধারণত রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র নাটক ও নৃত্যনাট্য তথা অন্যান্য যে কোনো রবীন্দ্র সাহিত্য (যেমন কবিতা বা ছোট গল্প যদি মঞ্চে উপস্থাপনযোগ্য করে পরিবেশন করা যায়, বা রবীন্দ্রনাথ নির্ভর কোন গীতিআলেখ্য) ইত্যাদির সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এর সূচনা করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই নৃত্য একদিনে হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নৃত্যের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে এই নৃত্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নৃত্যে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্র নৃত্যের বৈশিষ্ট্য
এখন রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত নৃত্য বা গান্তিনিকেতনী নৃত্যের বৈশিষ্ট্য কি, দেখা যাক। রবীন্দ্রনৃত্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে নিবলিখিত কয়টি উপাদান পাওয়া যায়-
(ক) নৃত্য সর্বাঙ্গসুন্দর অভিনয়ের উৎকৃষ্ট অঙ্গ।
(খ) কবি রচিত সাহিত্য বা কাব্যই এই নৃত্যের মূল বিষয়বস্তু ।
(গ) এই কাব্য রচনার সাথে সূরযোজনা করায় প্রকৃত সংগীতের সৃষ্টি। এই সংগীতই রবীন্দ্রনাট্যের মূলভিত্তি।
(ঘ) সেই সংগীতের অন্তনির্হিত ভাবকে নাদের অভিনয় দ্বারা দেহচ্ছন্দে ব্যঞ্জিত করে দর্শকের চিত্তে অনির্বচনীয় রসের উদ্বোধন।
প্রাচীন নৃত্যের তুলনা
ক) নৃত্য মূলত ভারতীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। অভিনয়দর্পণ’-এ বলা আছে, সংগীতের ভাবকে নৃত্যের তাল ও মুদ্রাদির কায়িক অভিনয়ের দ্বারা দর্শক মনে সঞ্চারিত করে রসের উদ্রেক করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যও অনেকটা তাই। এই নৃত্য গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ গানের উপর নির্ভর করে। গীতাভিনয়ের পরিপূর্ণতা নৃত্যাভিনয় ।
কিন্তু প্রাচীন পদ্ধতিকে কবি হুবহু গ্রহণ করেন নি, মূলত ঐ পদ্ধতির উপরেই তার নবসৃষ্টি নতুন রূপ ধরে আধুনিক কালের রসপিপাসা চরিতার্থ করেছে।
খ) প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যে মুদ্রার ছিল একান্ত প্রাধান্য। প্রথমে মুদ্রা প্রদর্শন, তারপর নৃত্য। কিন্তু ঐ প্রাচীন মুদ্রার অর্থ বর্তমান যুগে সাধারণের নিকট সহজবোধ্য নয়, দুর্বোধ্য মুদ্রাভিনয় ব্যাঙ্গাভিনয়ে পরিণত হতে পারে। তাই তিনি মুদ্রাকে যথাসম্ভব ত্যাগ করেছেন।
পূর্বে বলা হয়েছে দক্ষিণী নৃত্যের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যের রূপ অনেকটা অবিকৃত আছে। বর্তমান কথাকলি নৃত্যে মুদ্রার বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার নৃত্যনাট্যে-বিশেষ করে ‘চণ্ডালিকা য় কথাকলির আঙ্গিক অর্থাৎ ভঙ্গিমা ও তাল গ্রাহণ করলেও তার মুদ্রা অংশটি গ্রহণ করেননি।
গ) প্রাচীন নৃত্যে সংগীতের খুব একটা নিজস্ব পরিপূর্ণতা ছিল না; খন্ড খন্ড গানের সঙ্গে নৃত্য হত, এই ছিল প্রথা। বাদ্যের তালের উপর অনেকটা নির্ভর করেই সংগীতযুক্ত নৃত্য তার পূর্ণরূপটি প্রকাশ করত। কিন্তু রবীন্দ্রনৃত্যে সংগীতই হইল মূলভিত্তি, যার উপর নির্ভর করে সমস্ত নৃত্য প্রযোজনা গড়ে উঠছে।
গানের কথা অনুসরণ করে সাহানা, ভৈরবী, বাগেশ্রী, পরজ, বাউল, কীর্তন প্রভৃতি বহু বিচিত্র সুরের ধারা বয়ে চলেছে, এই সব ধারা-সম্মিলনে নৃত্যনাট্য একটা বিরাট সুরের রূপ ধারণ করেছে। এর সহিত নানাবিধ তালের নৃত্য মিলিত হয়ে কথার ভাব-ব্যঞ্জনাকে আরও ফুটিয়ে তুলছে। সংগীত ও নৃত্য চলছে পাশাপাশি; একে অন্যের প্রকাশকে রূদ্ধ করে না। এই সুরের মধ্যে ও তালের মধ্যেও নানা সংমিশ্রণ আছে।
মিশ্র সুর ও মিশ্র ভাল ও ভঙ্গীর সহযোগে রবীন্দ্রনৃত্য গড়ে উঠছে। এর কোনো বিশেষ নৃত্যপদ্ধতিকে আগাগোড়া অনুসরণ করেনি। মণিপুরী, কথাকলি, কথক, ভরতনাট্যম, লোকনৃত্য, ইউরোপীয় নৃত্য প্রভৃতির ভঙ্গী ও তাল কবি যেখানে যতটুকু প্রয়োজন মনে করেছেন ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন এই নানা মিশ্রণের দ্বারা তাঁর ভাবকল্পনুযায়ী এক অভিনব নৃত্যপদ্ধতি গড়ে উঠেছে ।
রবীন্দ্র নৃত্যের ইতিহাস
রবীন্দ্রনাথের সময়ে, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ বা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সাধারণ বাঙালি ঘরের ছেলে মেয়েরা নৃত্যচর্চা করবে তা প্রায় অকল্পনীয় ছিল। গ্রামাঞ্চলে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন উৎসব, পালাপার্বন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলগত নৃত্যের প্রচলন থাকলেও শহুরে কলকাতায় সেই সময়ে নৃত্য কেবল বাইজি, থিয়েটারের পেশাদার নর্তক-নর্তকী, যাত্রাপালা, খেমটাওয়ালী প্রভৃতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এদেরকে খুব একটা সম্মানজনক দৃষ্টিতে দেখা হত না।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিদ্যালয় শুরুর প্রায় প্রথম থেকেই তিনি সর্বাঙ্গীন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে গান, চিত্রকলা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করেন। মূলত সকলে মিলে একসাথে নৃত্যগীতের নির্মল আনন্দ উপভোগ করাই এর উদ্দেশ্য ছিল, রবীন্দ্রনাথের কাছে নৃত্য ছিল দেহের চলমান শিল্প। তাঁর মাধ্যমেই বাঙালি জীবনে নৃত্যকলা সমাদর লাভ করতে শুরু করে। নাচকে সম্মানজনক স্থান দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নেচেছেন, নাচ করার জন্য উৎসাহিত করেছেন, নৃত্যোপযোগী নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। নৃত্য তাঁর কাছে ছিল নির্মল আনন্দ উপভোগের মাধ্যম।
এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, “সকল দেশেই নৃত্য কলাবিদ্যার অন্তর্গত, ভাবপ্রকাশের উপায়রূপে শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে ভদ্রসমাজে তা লোপ পেয়ে গেছে বলে আমরা ধতে রেখেছি, সেটা আমাদের নেই। অথচ জনসাধারণের নৃত্যকলা নানা আকারে এখনো আছে, কিন্তু ওরা ছোটলোক। ওদের যা আছে সেটা আমাদের নয়। এমন কি সুন্দর সুনিপুণ হলেও সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয়।”
শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের সূচনালগ্ন থেকে গান, অভিনয় ও অঙ্কনচর্চা শুরু হলেও নৃত্যচর্চা শুরু হয় ১৯০৮ সালে। অবশ্য তখনও তা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেই বছরে পুজোর ছুটিতে বিদ্যালয়ের ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানো হয় ‘শারদোৎসব’ নাটকটি। সেখানেই প্রথম অভিনয় ও নৃত্যকে একসঙ্গে পরিবেশন করা হয়। দিনেন্দ্রনাথের পরিচালনায় “আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়”, “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে” ও “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ” গানের সঙ্গে বালকেরা নৃত্য পরিবেশন করেছিল। এখান থেকেই ক্রমশ জন্ম নেয় এক নৃত্য আন্দোলন।
‘শারদোৎসব’ নাটকটি এরপরেও শান্তিনিকেতনে ১৯১১ ও ১৯১৯ সালে অভিনীত হয়। এর মাঝে ১৯১৪ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অন্ধ বাউলের চরিত্রে নেচেছিলেন। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে ‘ফাল্গুনী’ ছাড়াও ‘ডাকঘর’ ও ‘অচলায়তন’ নাটক অভিনীত হয়। এই সময়ে কোনো বিশেষ ধ্রুপদী নাচের মাধ্যমে নৃত্য পরিবেশন করা হত না, প্রত্যেকেই গানের ছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেরা স্বাধীনভাবে পদচালনা করতেন। ‘অচলায়তন’ নাটকে শোন পাংশুরা যখন যে যার নিজের মত নাচছিলেন, তখন সে নাচের সঙ্গে পিয়ার্সন নিজের দেশের প্ৰচলিত রীতিতে ওই দলের সঙ্গে নাচে যোগদান করেছিলেন। এইভাবে ক্রমশ নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে নৃত্য অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯২২ সালে ‘শারদোৎসব’ ও ঋণশোধ এবং ১৯২৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বসন্ত’ নাটকে নৃত্য পরিবেশিত হয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চার বিকাশে বা রাবীন্দ্রিক নৃত্যকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ও পরবর্তীকালে শান্তিদেব ঘোষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইতিপূর্বে ১৯২০ সালে আগরতলা থেকে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধিমন্ত সিংহ নামক এক মনিপুরী নৃত্যগুরুকে আনিয়েছিলেন, অল্পবয়সীদের মনিপুরী নৃত্য শেখানোর জন্য।
প্রতিমা দেবীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থনে ১৯২৪ সালে ছাত্রীদের নাচের ব্যবস্থা করেন। বিশ্বভারতীতে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত পার্সি ভদ্রলোক ডঃ জাহাঙ্গীর ভকিলের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিমা দেবী জানতে পারেন ভকিল পত্নী গুজরাটি মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত গরবা নৃত্য জানেন। প্রতিমা দেবী তখন তাঁকে শান্তিনিকেতনে ছাত্রীদের শেখাতে অনুরোধ করেন। ১৯২৫ সালে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে বেশ কিছু গান এই গরবা নৃত্যের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। প্রতিমা দেবী ত্রিপুরার মহারাজকে অনুরোধ করে ১৯২৫ সালের শেষদিকে আরেক জন মনিপুরী নৃত্যশিল্পী নবকুমার সিংহ শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসেন।
১৯২৬ সালে ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে প্রতিমা দেবী ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পূজারিণী’ কবিতাটি নৃত্য ও মূকাভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপনের পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথকে জানালে তিনি অতিদ্রুত ‘নটির পূজা’ নাটকটি রচনা করেন। এই নাটক পরিবেশনে অভিনয় শিক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন, গান ও নৃত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব যথাক্রমে দিনেন্দ্রনাথ ও নবকুমার সিংহ নিয়েছিলেন।
১৯২৭ সালের জানুয়ারিতে তা পুনরায় কলকাতায় অভিনীত হয়। এই সময়েই ‘নটরাজ’ ও সেটিই সামান্য পরিবর্তন করে ‘ঋতুরঙ্গ’ নাটকটি অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে সব নাচই মনিপুরী নৃত্যের আদলে পরিবেশন করা হত। তবে ১৯২৮ সালে দোলের দিন শান্তিনিকেতনে আবার ‘ফাল্গুনী’ নাটকটি অভিনীত হয়, রবীন্দ্রনাথ আবার অন্ধ বাউলের চরিত্রে অভিনয় ও নৃত্য করেন, পূর্বের ন্যায়, কোন বিশেষ ধারার নৃত্যশৈলী অনুসরণ না করে। আবার ১৯২৯ সালে মাঘোৎসব উপলক্ষে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ‘নটরাজ’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’-এর গানগুলি গরবা ও মনিপুরী নৃত্যের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৩১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ‘গীতোৎসব’ ও ‘শিশুতীর্থ’ উপলক্ষে হাঙ্গেরি দেশের কন্যা ব্রুনার নৃত্য খুব উল্লেখযোগ্য। তিনি “আমি চিনি গো চিনি তোমারে” গানের সাথে নিজের দেশজ নৃত্য সহযোগে নেচেছিলেন। এছাড়াও শ্রীমতি দেবী “এসো নীপবনে” গান ও কবিগুরুর স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করা ‘ঝুলন’ কবিতার সঙ্গে ইউরোপীয় modern dance অবলম্বন করে নেচেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে এক মাদ্রাজি ছাত্র বাসুদেবন “যেতে যেতে একলা পথে” গানের সঙ্গে নিজ প্রদেশের পদ্ধতিতে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।
প্রতিমা দেবী নিজে নাচ জানতেন না, কিন্তু তাঁরই জন্য শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চা বিকাশলাভ করেছিল। তাঁর আগ্রহের কারণেই রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু নৃত্যাভিনয়ের উপযোগী নাটক রচনা করেছিলেন। প্রতিমা দেবীর উদ্যোগে বেশ কিছু কবিতা মূকাভিনয়ের মাধ্যমেও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর থেকেই ছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে কিভাবে মনিপুরী নৃত্যকে উপস্থাপন করা হবে তার শিক্ষা পেতো।
শান্তিনিকেতনে নৃত্যের বিকাশে দ্বিতীয় যে ব্যক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য তিনি হলেন শান্তিদেব ঘোষ। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বিভিন্ন নৃত্যের প্রয়োগ নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন শৈলীর নাচ শেখার জন্য নানা স্থানে ভ্রমণের উৎসাহ দিয়েছেন।
শান্তিনিকেতনে ৭ ই পৌষের মেলায় বিভিন্ন বাউল ও বৈষ্ণব আখড়া বসত। সেখান থেকে ও পূর্বে জয়দেবের কেঁদুলির মেলায় আগত বাউলদের থেকে শান্তিদেব ঘোষ বাউল নৃত্যে অনুপ্রাণিত হন ও পরে রবীন্দ্রনাথের বাউল আঙ্গিকের গানের সঙ্গে এই জাতীয় নৃত্য প্রয়োগ করতেন।
১৯৩১ সালে বীরভূমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বাংলার ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্ত। তাঁর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্ররা সিউড়িতে লোকনৃত্য সম্মেলনে রায়বেশে নৃত্য ও ময়মনসিংহের মুসলমান যুবকদের জারি গানের সঙ্গে রুমাল হাতে নৃত্য দেখতে যান, পরে শান্তিনিকেতনে সাতদিন ধরে রায়বেশে নৃত্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই বছরেই দোল উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘নবীন’ অনুষ্ঠানে “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান” বাউল আঙ্গিকে এবং “এ বেলা তোর ডাক পড়েছে” রায়বেশে ও জারি নৃত্যের আদলে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৩১ সালের মে মাসে শান্তিদেব ঘোষ ধ্রুপদী নৃত্য শিক্ষার অভিপ্রায়ে তৎকালীন কোচিন রাজ্যে (বর্তমানে কেরল) কবি ভাল্লাথোল প্রতিষ্ঠিত ‘কলামণ্ডলম’ নামক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি কথাকলি নৃত্যের সারি ও কলাসন জাতীয় নাচ ও মুদ্রা শিখে আসেন। এই বছরেই শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে “ওই বুঝি কালবৈশাখী” গানে তিনি কলাসন নাচের মুদ্রা ও ভঙ্গিমা ব্যবহার করেছিলেন।
১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে শান্তিদেব ঘোষ চার বার শ্রীলঙ্কা যান, সেখানকার বৌদ্ধমন্দিরে প্রচলিত পুরুষদের দলবদ্ধ ক্যান্ডি নাচ শিখে আসেন। পরে রবীন্দ্রনাথের উদ্দীপক গানের সঙ্গে এই নাচের মুদ্রাগুলি ব্যবহার করেছিলেন।
এছাড়াও শান্তিদেব ঘোষ ১৯৩৭ সালে রেঙ্গুনে গিয়ে সেখানকার ‘রামপোয়ে’ নৃত্য শেখেন। ১৯৩৯ সালে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে তিন মাস ধরে শুরকর্তার নৃপতির ব্যবস্থাপনায় রাজবাড়ির নাচ ও পরে একমাস বালি দ্বীপে গিয়ে সেখানকার লোকনৃত্য শিখে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন সময়ে এইসকল নৃত্যের প্রয়োগ করেন।

শান্তিনিকেতনে গানের ভাব অনুযায়ী নৃত্যরচনা করে ছাত্রীদের শেখানোর দায়িত্বও ছিল শান্তিদেব ঘোষের। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাটক ও নৃত্যনাট্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন নাচের মুদ্রা ও অঙ্গ ভঙ্গিমার প্রয়োগ ব্যবহার করেছেন। যেমন জাপানি নো ও কাবুকি নাচ তিনি ‘চিত্রাঙ্গদা’র মদন ও ‘চণ্ডালিকা’র’র দইওয়ালার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়াও বেশ কিছু গানে তিনি ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্য ও শ্যাম (বর্তমান ভিয়েতনাম) দেশীয় নৃত্যের দ্বারা উপস্থাপন করেন। আবার ‘পরিশোধ’ নৃত্যনাট্যটি ভারতীয় কত্থক নৃত্য দ্বারা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল।
১৯৩১ সালে জাপানি কুস্তি বা জুডো প্রদর্শনীর উদ্বোধনী সঙ্গীত “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”-এ শারীরিক ব্যায়ামের কয়েকটি অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করেন। এমনকি ১৯৩৬ সালে মুখোশ ধারণ করে নৃত্যের আয়োজন হয়েছিল ‘সীতা হরণ’ নাটকের জন্য। এই নানাদেশীয় মুখোশ ও সাজসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন নন্দলাল বসু। এছাড়াও অন্যান্য রবীন্দ্র নৃত্য ও নৃত্যনাট্যের জন্যও উপযুক্ত মঞ্চসজ্জা ও নৃত্যশিল্পীদের সাজপোশাকের নির্বাচনে নন্দলাল বসুর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় একাধিক নাচের শিক্ষক বিশ্বভারতীতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা মনিপুরী, কথাকলিসহ বিভিন্ন শৈলীর নাচ শেখাতেন। রবীন্দ্র নৃত্যে এই দুই নৃত্যের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অবশ্য পরবর্তীকালে রুক্মিনী দেবী আরুন্ডেল ভরতনাট্যম, গুরু ভেম্পতি চিন্না সত্যম কুচিপুড়ি, ঝাভেরি বোনেরা মণিপুরি, যতীন গোস্বামী অসমের সত্রিয় নৃত্যধারায় রবীন্দ্রনৃত্য পরিকল্পনা করে এই নৃত্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ নৃত্য সম্বন্ধে লিখেছেন, “আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পর মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটুকুকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।” নৃত্য তাঁর কাছে বিশ্বপ্রকৃতির ছন্দের সুসম্পূর্ণ রূপলীলা; নৃত্য তাঁর কাছে মুক্তির আনন্দ, তাই তো তিনি লিখেছেন,
“নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া,
বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।”
রাবীন্দ্রিক নৃত্য ভারতীয় নৃত্যধারাকেই নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার প্রয়াস। কিন্তু তা শাস্ত্রের কঠোর শৃঙ্খলে কখনো আবদ্ধ নয়। নৃত্যের মাধ্যমে মনের ভাবকে সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও যেমন রাগরাগিনীর কঠোরতাকে বর্জন করা হয়েছে, নৃত্যের ক্ষেত্রেও তাই। (উদাহরণ স্বরূপ, অন্যান্য ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের মত কিন্তু এই নৃত্যে ঘুঙুর পরা হয় না।) আসলে অতি নিয়মের বেড়াজালে যাতে তা সঙ্গীত বা নাটকের চরিত্রের ভাব থেকে না বিচ্যুত হয় সেদিকেই বেশি লক্ষ্য রাখা হয়।
বর্তমানে ২০১৪ সাল থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র নৃত্যের বি. মিউজ ডিগ্রির পাঠক্রম চালু করা হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জীবনের ধ্রুবতারা- শান্তিদেব ঘোষ।
আরও দেখুন :