আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বিজয়গাঁথার গান
বিজয়গাঁথার গান
বিজয়গাঁথার গান
নজরুলের স্বদেশপর্বের অনেক গানেই পাই বিজয়গাথার সন্ধান। কারণ বিজয়ী বীরদের ভুলে গেলে, অস্বীকার করলে কোনো বীরের আর জন্ম হবে না। সকল বিজয়ের পেছনে রয়েছে বহু বীরের আত্মত্যাগের গল্প। তাই বীরকে স্বাগত জানাতে হবে, জয়ধ্বনি দিয়ে বরণ করতে হবে সেই নির্ভীক নাবিককে। সকলের অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা বন্ধন-জয়ীকে জাগিয়ে তুলতে হবে সকল বিজয়গাঁথার গানে।
“ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজা, উভুলে আকাশ পথে।
মাগে, তোমার রথ আনা ঐ রক্ত-সেনার রথে
মুক্তির রখ দুয়ারে উপস্থিত, বিজয় পতাকা নিয়ে অপেক্ষমান মুক্তিসেনার দল। নজরুলের এই পর্বের গানসমূহের মধ্যে বিজয়ের আশা দিয়ে, বিজয়ের আনন্দঘোরে, বিজয় ছিনিয়ে আনবার সংকল্প যেন! নিরাশার কথায় অর্জিত জয়ও ফিকে হয়ে না যায়। আর বিজয়গাঁথার গানে লাগে দিবাস্বপ্নের ঘোর । বিজয়ভেরী বাজালেই মনে হয় বিজয় সুনিশ্চিত।
তাই বিজয়গাঁথার গান নজরুলের কাছে বিজয়কে ত্বরান্বিত করা, সুনিশ্চিত করা, ‘নাই দেরী আর নাই মা দেরী, মুক্ত তোমার হতো। গানের এ অংশ থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। জয়ধ্বনির একটি প্রচণ্ড শক্তি আছে। সে শক্তিতে সকল জাতি, সকল ধর্মের মানুষ বিজয়ীর বেশে শামিল হয় মহাযজ্ঞে। এখানে স্বদেশের প্রেমে, মায়ের ভক্তিতে সকল জৈন-পার্শি- বৌদ্ধ-শাক্ত খ্রিষ্টান-বৈষ্ণব একই মাতৃছায়ায় আশ্রিত। তাই কবি সকল আর্যাবৃত্ত তথা ভারতবর্ষের জয়গান গাইছেন মুক্ত কণ্ঠে। যেমন-
“কল কল্লোলে ত্রিংশ কোটি কণ্ঠে উঠেছে গান
জয় আর্য্যাবৃত্ত, জয় ভারত জয় হিন্দুস্থান ॥
এমন অনেক বিজয়গাঁথার গান আছে কবি নজরুলের যেখানে সাম্যের কথা ওঠে এসেছে। কারণ বিজয় মানেই সাম্যতা, সকল ভেদাভেদের অবসান হলেই তবে বিজয় ত্বরান্বিত হয়। শ্যামলা বরণা বৃক্ষলতায় শোভিত আমাদের জন্মভূমি, রোদ-বৃষ্টি মেঘবিষাণের আর জলদ-মন্ত্রের এই দেশে যুগে যুগে কত বীরের জন্ম হয়েছে। এমন সুন্দর ভূমিতে শত্রুবেশে আগতজনেরও বন্ধু হতে সময় লাগে না।
আর বিজয়ী বীর তোর স্বদেশ মায়ের কোলে আসন নিয়েছে স্বগৌরবে। তাই এ মায়ের কোলে হিন্দু-মুসলমান সকলের সহ-অবস্থান। সকলে সমস্বরে গায় এর মায়ের বিজয়গাঁথার গান। জনগণই এই মায়ের শক্তি। তাই জয় জয় বলে এই জনগণকে জেগে উঠতে বলেছেন কবি। কবি অনাগত বীরকে আহ্বান করেছেন মায়ের সকল বেদনা, কলঙ্ক বিমোচন করতে। কবি বলেন :
“এসো যুগ-সারথি নিঃশঙ্ক নিৰ্ভয় ।
এসো চির-সুন্দর অভেদ অসংশয়।
জয় জয় !
জয় জয় ।
এস বীর অনাগত
বজ্ৰ সমদ্যত।
এস অপরাজেয় উদ্ধত নিদয়।
অপরাজেয় উদ্ধত যুগঅগ্রনায়ককে কবি জয় জয় বলে আহ্বান করেছেন। সকল মৌন জনগণে সেই জ্যোতির্ময় ঘুমিয়ে আছে। সে জেগে উঠলেই সকল ক্রন্দন দূর হবে। আবার নতুন দিনের শুরু হবে। কবি তাঁর বিজয়গাঁথার সাথে সেই সকল নবআলোকবর্তিকাবাহী বীরদের জয়গান করেছেন। কবির কাছে জনগণই সকল অধিপতি। এই নিঃশঙ্ক, নির্ভরকে কবি দেবতাজ্ঞানে পূর্ণ করতে চান।
“জয় হে জনগণ-অধিপতি জয়।
হে দেবপূজা-নিঃশঙ্ক নিৰ্ভয়
তাঁর রচিত আরো কিছু এ ধারার গান রয়েছে যেখানে বিজয়ীর বিজয়ের বন্দনা করা হয়েছে দেশমাতৃকার জন্য সর্বস্ব উৎসর্গের কারণে-
ক. “চলরে চপল তরুণদল বাঁধন-হারা
চল অমর সমরে চল ভাঙি’ কারা
ঝাগায়ে কানন নব পথের ইশারা .
খ. “বল নাহি ভয় নাহি ভয়।
বল্ মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ”
গ. “শুধু নদীয়ার নহ তুমি
আজ বাঙলার গৌরব।
দিক দিগন্ধে লুটাইয়া পড়ে তব যশঃ-সৌরভ।
ঘ. “সালাম সালাম জামালউদ্দীন আফগানী তসলীম।
এশিয়ার নব-প্রভাত-সূর্যাপুরুষ মহামহিম
ঙ. “চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোক।
চীন ভারতের জয় হোক !
ঐক্যের জয় হোক । সাম্যের জয় হোক
এই গানটির মধ্যে কবি এই দুই দেশের বীরদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ‘১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের নেতা চিয়াং কাইশেক কলকাতা সফরে এলে গ্রামোফোন কোম্পানির অনুরোধে নজরুল *চীন ও ভারত মিলেছি আবার’ গানটি রচনা করেন। এটিই তাঁর রচিত সর্বশেষ উদ্দীপনাগীতি।
আরও দেখুন :