দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশপর্যায়ের গানের তালিকা

১ . আজি গো তোমার চরণে, জননী আনিয়া অর্ঘ্য করি মা দান;

ভক্তি-অশ্রু-সলিল- সিক্ত শতেক ভক্ত দীনের গান।

মন্দির রচি মা তোমার লাগি, পয়সা কুড়ায়ে পথে পথে মাগি,

তোমারে পূজিতে মিলেছি জননী মেহের সারিতে করিয়া স্নান!

(কোরাস) জননী বঙ্গভাষা, এ জীবনে চাহি না অৰ্থ চাহি না মান

যদি তুমি দাও তোমার ও-দুটি অমল কমলচরণে স্থান!

জ্ঞান কী জননী জ্ঞান কী কত যে আমাদের এই কঠোর ব্রত।

হায় মা! যাহারা তোমার ভক্ত, নিঃস্ব কী গো মা তারাই যাত!

তবু সে লজ্জা তবু সে-দৈন্য, সহেছি মা সুখে তোমারি জন্য,

তাই দু-হস্তে তুলিয়া মঞ্চে ধরেছি যেন সে মহৎ মান।

(কোরাস) জননী বঙ্গভাষা এ জীবনে

চাহি না অৰ্থ চাহি না মান যদি তুমি দাও তোমার

ও-দুটি অমল কমলচরণে স্থান!

নয়নে বহেছে নয়নের ধারা জ্বলেছে জঠরে

যখন ক্ষুধা মিটায়েছি সেই জঠরজ্বালায় পিইয়া

তোমার বচনসুধা মরুভূমে সম যখন তৃষায়,

আমাদের মাগো ছাতি ফেটে যায়, মিটায়েছি

মাগো সকল পিপাসা তোমার হাসিটি করিয়া পান।

(কোরাস)— জননী বঙ্গভাষা, এ জীবনে চাহি না অৰ্থ চাহি না মান,

যদি তুমি দাও তোমার ও-দুটি অমল-কমল চরণে স্থান !

পেয়েছি যা কিছু কুড়ায়ে তাহাই

তোমার কাছে মা এসেছি ছুটি,

তাহাই গুছায়ে যতনে সাজাব তোমার চরণ দুটি।

বাসনা, চাহি নাকো কিছু, তুমি মা আমার –

এই জানি শুধু নাহি জানি আর তুমি গো

জননী হৃদয় আমার, তুমি গো জননী আমার প্রাণ।

(কোরাস)— জননী বঙ্গভাষা, এ জীবনে চাহি না

অৰ্থ চাহি না মান যদি তুমি দাও তোমার ও-দুটি অমল কমল চরণে স্থান।

২ . একবার গালভরা মা ডাকে।

মা বলে ডাক মা বলে ডাক মা বলে ডাক মাকে।

ডাক এমনি করে আকাশ ভুবন সেই ডাকে

যাক ভরে আর ভায়ে ভায়ে এক হয়ে যাক যেখানে যে থাকে।

দুটি বাহু তুলে নৃত্য করে ডাকরে মা মা বলে,

আর নেচে নেচে আয়রে মায়ের ঝাঁপিয়ে পড়ি

কোলে মায়ের চরণ দুটি জড়িয়ে ধরে আন

রে মায়ে লুটে ছেলের শুনলে সে ডাক

দেখব সে মা কেমন করে থাকে।

দিয়ে করতালি মা মা বলি ডাক রে এমনিভাবে,

উঠে প্রবল বন্যা ভাবে ভূবন ভাসিয়ে দিয়ে যাবে,

মায়ের বুকের উপর আছড়ে পড়ে চক্ষু দুটি মুদে,

আমার গান ভেসে যাক প্রাণ ভেসে যাক দেখি শুধুই মাকে।

৩ . ওরে আমার সাধের বীণা, ওরে আমার সাধের গান,

(তোর ওই) কোমল সুরে ব্যথা ঝরে, আকুল করে আমার প্রাণ!

(ও তোর) শত তানে একই কথা, শত লয়ে একই ব্যথা –

(শুধু) নিরাশার কাতরতা, হতাশার অপমান।

(কোরাস) পার যদি জাগো বীণা, ধরো আরও উচ্চতান,

গাইব আমি নূতন গানে নূতন প্রাণে কম্পমান।

(যখন) বীণার সুরে গলা সেধে, গাইতে যাই রে ফেলি কেঁদে,

(শুধু) মিশে যায় সে মনের খেদে- আঁখির জলে অবসান।

(কোথায়) আনন্দেতে উঠব নেচে মরা মানুষ উঠবে বেঁচে,

(আমি) পাই না সুধাসাগর ছেঁয়ে ভাগ্যে শুধুই বিষপান!

(কোরাস) পার যদি জাগো বীণা, ধরো আরও উচ্চতান,

পাইব আমি নূতন গানে নূতন প্রাণে কম্পমান ।

(বীণা) পার যদি জাগো তবে, বেজে ওঠো উচ্চরবে,

(আজ) নূতন সুরে গাইতে হবে, আমি সঙ্গে ধরি তান:

(ছেড়ে) লোকসজ্জা, সমাজ-ভয়, যাতে,

সবাই আবার মানুষ হয়, কর এই বরদান।

(কোরাস) পার যদি জাগো বীণা, ধরো আরও উচ্চতান,

গাইব আমি নূতন গানে নূতন প্রাণে কম্পমান।

৪ . কীসের শোক করিস ভাই আবার তোরা মানুষ হ।

গিয়েছে দেশ দুঃখ নাই আবার তোরা মানুষ হ।
পরের পরে কেন এ রোষ, নিজেরাই যদি শত্রু হস?

তোদের এষে নিজেরই দোষ-আবার তোরা মানুষ হ।

ঘুচাতে চাস যদিরে এই হতাশাময় বর্তমান

বিশ্বময় জাগায়ে তোল ভায়ের প্রতি ভায়ের টান।

ভুলিয়ে যা রে আত্মপর, পরকে নিয়ে আপন কর

বিশ্ব তোর নিজের ঘর আবার তোরা মানুষ হ।

শত্রু হয় হোক না যদি সেথায় পাস

মহৎ প্রাণ তাহারে ভালো বাসিতে শেখ,

তাহারে কর হৃদয়দান। মিত্র হোক ভণ্ড যে- তাহারে দূর করিয়া দে

সবার বাড়া শত্রু সে আবার তোরা মানুষ হ।

জগৎ জুড়ে দুইটি সেনা পরস্পরে রাঙায়

চোখ পুণ্য সেনা নিজের কর,

পাপের সেনা শত্রুর হোক ধর্ম যথা

সেদিকে থাক ঈশ্বরেরে মাথায় রাখ

স্বজন দেশ ডুবিয়ে যাক- আবার তোরা মানুষ

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

৫ . কেন আর ভাঙাঘরে মারিস তোরা সিধকাটি?

ছিন্ন তরুর মূল হতে কেন তুলে দিস মাটি?

বিষে জর্জর প্রাণে, কেন হানিস বিষবাণে?

পাপের বন্যাভরা দেশে, আনিস নরক খাল কাটি?

কেন শীর্ণ মলিন মুখে, মারিস্ কুঠার মায়ের বুকে?

দু-দিন গেলে দিস রে ফেলে পুরাস প্রাণের আকাঙ্ক্ষাটি।

৬ . বাজ ভেরি আজ উচ্চ নিনাদে উড়ুক পতাকা মৃত্যু আঁকা

নাচুক তাথিয়া থিয়া থিয়া থিয়া বিজয় নরের রক্ত মাখা

থাক ঘুরে থাক বিবির নিয়ম আজ আছে নারী কাল

আছে যম বাজিস যে ভেরি কম ঝম ঝম শুধু সে

রোদন ঢাকিয়ে রাখা বাজ ভেরী বাজ ঝনন ঝনন

সনন সনন ঘুরুক ঢাকা না উঠিলে সনে কারো হাহাকার

সুখটি পূর্ণ হয় নাকো আর বলিহারি বিধি বিধাতা

তোমার এখন সে কথা থাকুক ঢাকা জীবন

মরিবে মরণ বাঁচিবে নৃত্য কাঁদিবে রোদন নাচিবে আকাশের তারা খসিবে,

উড়িবে ধরণীর ধূলি মেলিয়া পাখা বাজ ভেরি

বাজ ঝনন ঝনন সমন সমন ঘুরুক ঢাকা।

৭ .  ভেঙে গেছে মোর স্বপ্নের ঘোর ছিড়ে গেছে মোর বীণার তার।

এ মহাশ্মশানে ভগ্ন পরাণে আজি মা কি গান গাহিব আর।

মেবার পাহাড় হইতে তাহার নেমে গেছে এক গরিমা হায়

ঘন মেঘরাশ ঘেরিয়া আকাশ হানিয়া তড়িৎ চলিয়া যায়।

(কোরাস) মেবার পাহাড় শিখরে তাহার

রক্তনিশান ওড়েনা আর এ হীন সজ্জা, এ ঘোর লজ্জা

ঢেকে দে গভীর অন্ধকার।

গাহে নাকো আর কুঞ্জে তাহার পিকবর

আজ হরফগান ফোটে নাকো ফুল,

আসে না আকুল ভ্রমর করিতে সে মধু পান আর

নাহি বয় শিহরি মলয় আর নাহি হাসে আকাশে চাঁদ

মেবার নদীর স্নান দুটি তীর করে নাকো আর সে কলনাদ।

(কোরাস) মেবার পাহাড় শিখরে তাহার

রক্তনিশান উড়েনা আর এ হীন সজ্জা,

এ ঘোর লজ্জা ঢেকে দে গভীর অন্ধকার।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

 

দ্বিজেন্দ্রলালের হাস্যপরিহাস ও ব্যাঙ্গানুকৃতি পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা

৮ . আজি এই শুভদিনে শুভক্ষণে উড়ায়ে দিই জয়ধ্বজায়

উপাধি পেয়েছি যা রাখতে তা তো হবে বজায়

আমাদের ভক্তি যা এ- এ যে গো মানের দায়ে

এখন তো উচিত কার্য এদিক ওদিক বুঝে চলাই

সাধে কি বাবা বলি গুতোর চোটে বাবা বলায়।

আজি এই শুভরাতি জ্বালাব বাতি ঘরে ঘরে ভক্তিভাবে

নৈলে যে চাকরী যাবে, নৈলে যে চাকরী যাবে।

আমাদের ভক্তি যা এ- এ যে গো পেটের দায়ে

নিয়ে আয় চেরাগবাতি নিয়ে আয় দিয়েশলাই

সাধে কি বাবা বলি, শুভোর চোটে বাবা বলায় ।

জয় জয় মোঘল ব্যাঘ্র মোঘল ব্যাঘ্র

ব’লে জোরে ডঙ্কা বাজাই

পাহারা ফিরছে দ্বারে চাকরী যাবে সেটা যেন ভুলে না যাই।

আমাদের ভক্তি যা এ- এ যে গো প্রাণের দায়ে

কী জানি পিছন থেকে কখন ফাঁসি পড়ে গলায় সাধে

কি বাবা বলি গুতোর চোটে বাবা বলায়।

আমরা সব রাজভক্ত রাজভক্ত বলে চ্যাচাই উচ্চরবে

কারণ সেটার যতই  চাকরী যাবে অভাব ততই সেটা বলতে হবে।

আমাদের ভক্তি যা এ মানের পেটের প্রাণের দায়ে

দেখে সে রক্ত আঁখি, ভক্তি যা তা ছুটে পালায়

সাধে কি বাবা বলায়, গুতোর চোটে বাবা বলায়।

ভোলানাথ শুয়ে আছেন, ঈশ্বর তারে সুখে রাখুন

কালী জিব মেলিয়ে আছেন, তা তিনি মেলিয়ে থাকুন

শ্রীকৃষ্ণ হয়ে বাঁকা, থাকুন তিনি পটেই আঁকা

আমরা সব নিয়ে শরণ মোগলদেবের

চরণতলায় সাধে কি বাবা বলি, গুতোর চোটে বাবা বলায়।

৯ . আমরা বিলাত ফেরত ক ভাই, আমরা সাহেব সেজেছি সবাই।

তাই কি করি নাচার, স্বদেশী আচার করিয়াছি সব জবাই।

আমরা বাংলা গিয়েছি ভুলি, চাকরী যাবে আমরা শিখেছি বিলেতি বুলি

আমরা চাকরকে ডাকি বেয়ারা আর মুটেদের ডাকি কুলি।

রাম কালীপদ হরিচরণ, নাম এসব সেকেলে ধরণ

তাই নিজেদের সব ‘ডে’ ‘রে’ ও ‘মিটার’ করিয়াছি

নামকরণ আমরা সাহেব চাকরী যাবে সঙ্গে পটি আমরা মিস্টার

নামে রটি যদি সাহেব না বলে বাবু কেহ বলে মনে মনে ভারী চটি ।

আমরা ছেড়েছি টিকির আদর, আমরা ছেড়েছি

ধুতি ও চাদর আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোট পরে

সেজেছি বিলেতি বাদর আমরা বিলেতি ধরণে হাসি,

আমরা ফরাসি ধরণে কাশি আমরা পা ফাক করিয়া

সিগারেট খেতে বড্ডই ভালবাসি।

আমরা হাতে খেতে বড় ডরাই আমরা স্ত্রীকে ছুরি

কাটা ধরাই আমরা মেয়েদের জুতো মোজা,

দিদিমাকে জ্যাকেট পরাই। আমাদের সাহেবিয়ানার

বাঁধা এই যে রংটা হয়না সাদা, তবু চেষ্টার ত্রুটি নেই,

ভিনোলিয়া মাখি রোজ গাদা গাদা ।

আমরা বিলেত ফেরত কটায়,

দেশে কংগ্রেস আদি ঘটাই আমাদের সাহেব যদিও দেবতা,

তবু ওই সাহেবগুলোই চটাই আমরা সাহেবিরকমে হাটি,

স্পিচ দেই ইংরেজি খাঁটি কিন্তু বিপদেতে দেই বাঙালিরই মত চম্পট পরিপাটি।

১০ . চম্পটি চম্পটি চম্পটি

চম্পটির দল আমরা সবে।

একটু মেশালরকমভাবে।

আমরা কজনই এইটি ভবে।

যা কিছু দেশি রং রেখেছি সায়েবি ঢং একটু তবু নেটিভ গন্ধ,

কী কর্ব তা রবেই রবে। জননী বঙ্গভাষা ইংরেজিতে কহি কথা,

সেটা পাপার উপদেশ হ্যাট্টা কোট্টা পরি কেন-

কারণ সেটা সভ্য বেশ চক্ষে কেন চশমা সাজ:

কারণ সেটা ফ্যাশন আজ – চশমা শূন্য ছাত্রমহল,

কোথায় কে দেখেছে করে। বঙ্গভাষা কইতে শিখছি,

বছর দুতিন লাগবে আরো তবে এখন কইছি যে,

সে তোমরা যাতে বুঝতে পার টেবিলে খাচ্ছি খানা

করণ সে সাহেবিয়ানা: খাই-বা যদি

শাক-চচ্চড়ি টেবিলেতে খেতেই হবে।

ইউরেশিয়ান ছেলেমেয়ে তৈরি মোরা হচ্ছি ক্রমে,

এদিকেও সংখ্যায় বাড়ছি বিনা কোনো পরিশ্রমে;

জানি না কী হবে শেষে কোথায় বা চলছি ভেসে;

মাঝিশূন্য নৌকার উপর ভেসে যাচ্ছি ভবাণ্যবে।

১১ . ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে গাও উচ্চে রণজয়গাথা।

রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে গুণ ঐ ডাকে ভারতমাতা:

কে বল করিবে প্রাণে

মায়া যখন বিপন্ন জননী জায়া?

সাজ সাজ সকলে রণসাজে শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে!

চল সমরে দিব জীবন ঢালি জয় মা ভারত। জয় মা কালী !

সাজে শয়ন কি হীন বিলাসে শত্রু বিদগ্ধ যখন পুরপল্লী?

অরাতি-চরণ-বিচিহ্নিত বক্ষে সাজে প্রেয়সীর ভুজবল্লী?

কোষ নিবদ্ধ রবে তরবারি যখন বিলাঞ্ছিত ভারত-নারী?

সাজ সাজ সকলে রণসাজে জননী বঙ্গভাষা এন ঘন ঘন রণভেরী বাজে!

চল সমরে দিব জীবন ঢালি জয় মা ভারত! জয় মা কালী ।

সমরে নাহি ফিরাইব পৃষ্ট-শত্রুকরে কভু হব না

বন্দী ডরি না থাকে যাই অদৃষ্টে-অধর্ম সঙ্গে করি না সন্ধি ।

রব না হব মা শত্রুর ভৃত্য সম্মুখ সমরে জয় বা মৃত্যু-

সাজ সাজ সকলে রণসাজে শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে।

চল সমরে দিব জীবন ঢালি জয় মা ভারত! জয় মা কালী ।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশচেতনার গান

 

ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে শত্রুসৈন্যদল করিব বিভিন্ন পুণ্য

সনাতন আর্যাবর্তে রাখিব না রিপুদল পদচিহ্ন।

অরাতি-রক্তে করিব স্নান করিব বিরঞ্জিত হিন্দুস্থান ।

সাজ সাজ সকলে রণসাজে জন ঘন ঘন রণভেরী বাজে!

চল সমরে দিব জীবন ঢালি জয় মা ভারত। জয় মা কালী!

আরও দেখুন :

Leave a Comment