Site icon Arts and Culture Gurukul [ শিল্প ও সংস্কৃতি গুরুকুল ] GOLN

সামরিক সংগীত রচনায় নজরুল

সামরিক সংগীত রচনায় নজরুল

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সামরিক সংগীত রচনায় নজরুল

সামরিক সংগীত রচনায় নজরুল

 

সামরিক সংগীত রচনায় নজরুল

স্বদেশসংগীত বা দেশাত্মবোধক গান রচনায় নজরুল একটি স্বর্ণখচিত নাম। দেশপ্রেমবোধে যে কিশোর লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে, কেবল ভবিষ্যতে দেশমাতাকে রক্ষায় রণকৌশল শিখে নিজেকে প্রস্তুত করতে, সাহিত্যে বা সংগীতে এমন উদাহরণ বিরল। তাই কবি নজরুলের স্বদেশভাবনা শুধু গৃহকোণে বসে লেখনির যাদুমন্ত্র নয়, তাঁর কাছে দেশপ্রেম মানে জ্বলে ওঠা।

স্বদেশের যেকোনো সংকটে, আহ্বানে স্বশরীরে গর্জে ওঠা। বাংলার প্রতিটি ঘরের টগবগে দামাল ছেলের মতো। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বের পরে স্বদেশি গান রচনায় একটি চরম শূন্যতার সময় চলছিল। কেবল মুকুন্দ দাস তাঁর স্বদেশি গানের তরবারি প্রায় একাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন-এর অকালপ্রয়াণ, অতুলপ্রসাদ সেনের স্বদেশি গান থেকে প্রেমের গান রচনার প্রতি ঝুঁকে পড়া, রবীন্দ্রনাথের নানা কারণে স্বদেশি গান রচনার পথ থেকে সরে দাঁড়ানো-এ সকল কারণেই হয়তো আন্দোলনের ধারা বদলে যাওয়ার লক্ষণ। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে অনেকেই মনেপ্রাণে সমর্থন করতে না পেরে সরাসরি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।

আত্মজাগরণ আর স্বদেশ বন্দনার গানে ইংরেজ বিতাড়ন সম্ভব নয় জেনে শুরু হয় সশস্ত্র বিপ্লব। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বললেও একে ভুল বলা হবে না। গানে অনুনয় আর আবেদনের সুর যখন যথেষ্ট নয় ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজকে হটাতে তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিদ্রোহীচিত্তের।

“১৯০৮ সালে প্রফুল্লচাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর আত্মদানের মাধ্যমে সেই বিপ্লব এক রক্তাপুত পর্যায়ে উন্নীত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের নির্দয় দমনকারী কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড তখন বিহারের মজফফরপুরে। অতর্কিত আক্রমণে তাকে হত্যা করতে গেলেন প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম। কিন্তু তাঁদের নিক্ষিপ্ত বোমা ভ্রমক্রমে কিংসফোর্ডকে আঘাত না করে মিসেস ও মিস কেনেডিকে আঘাত করলে তারা মারা যান। কিছুতেই ধরা দিলেন না।

প্রফুল্ল চাকী। নিজের গুলিতে নিজেই শহীদ হলেন ১৯০৮ সালের ১লা মে তারিখে। গ্রেফতারকৃত ক্ষুদিরাম ফাঁসির মঞ্চে প্রাণদান করলেন ১১ই আগস্ট। এই ঘটনায় জাতীয় জীবনে সৃষ্ট আবেগের কিয়দংশ প্রতিফলিত হয়েছে বাঁকুড়ার পীতাম্বর দাস রচিত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটিতে। এমনি আক্রমণ ও আত্মোৎসর্গের ঘটনা ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে সশস্ত্র বিপ্লবকে প্রসারিত করে তোলে। ”

সশস্ত্র বিপ্লবের এই চরম সময়ে গর্জে ওঠে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ। কারার লৌহ কপাট যে লাথি দিয়ে ভাঙতে চায়, সেই বিদ্রোহী রণক্লান্ত অতীত গৌরব থেকে বর্তমানের সংকট মোকাবেলার ত্যেজে দীপ্ত, শিকল পরার ছলে শিকল বিকল করার মন্ত্রে আত্মহারা কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব হয় তেমনি উত্তেজনার একটি অভূতপূর্ব সময়ে। যার সূত্রপাত ঘটে সেনাবাহিনীর ব্যারাকে থাকাকালীন সময়ে।

ভারতবর্ষকে মুক্ত করবার সুগভীর প্রত্যয় নিয়ে কবি কাঠখোট্টা সৈন্যদলে থেকে নিরলসভাবে চালিয়ে গেছেন তাঁর সাহিত্য সাধনা। গীতিকবি জীবনের প্রথম রচিত গানটিও ছিলো তাঁর স্বদেশপ্রেমের এবং করাচির ব্যারাক থেকে পাঠানো। করাচি থাকাকালীন সময়টিতে কবি নজরুলের কাব্য ও সংগীতচর্চার অভূতপূর্ব সুযোগ ঘটে।

চুরুলিয়া ও শিয়ারসোলে শেখা ফারসিকে তিনি আরো মনোযোগের সাথে আয়ত্তে আনেন বাঙালি পল্টনের একজন পাঞ্জাবি মৌলবির কাছ থেকে। ফারসি গজল রচনার ধারা তাঁর থেকেই শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। করাচি সৈন্যদলে থাকাকালীন নজরুল যে একটি অসামান্য সাঙ্গীতিক পরিবেশ পান তার উল্লেখ পাই প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা কবি সহচর ও বন্ধু শম্ভুরায়ের পত্র থেকে।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের কাজী নজরুল গ্রন্থে (পৃ. ২৮৯-৯৯) করাচি ব্যারাকে কবির সংগীতচর্চার চিত্রটি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে :

“করাচিতে গান বাজনার সমস্ত ব্যবস্থাই ছিলো। বেঙ্গল রেজিমেন্টে বেঙ্গলী ভলান্টিয়ার কমিটির দৌলতে আইনসম্মত কোনো জিনিসেরই অভাব ছিলো না। ভাঁজ করা অরগ্যান (এটি কাজীর বড় প্রিয় ছিলো) থেকে আরম্ভ করে ব্যাঞ্জো, ক্ল্যারিওনেট, বেহালা প্রভৃতি সবরকম বাজনাই ছিলো। আর এসব বাজনাই জমা থাকত কোয়ার্টার মাস্টার নজরুলের জিম্মায়। গাইয়ে বাজিয়েদের অভাব ছিলো না রেজিমেন্টে।

বেপরোয়া ডানপিটে বাঙালি ছেলেরা জীবন-মরণ তুচ্ছ করে গুলি-বারুদের পিছনে উন্মাদ হয়ে ছুটেছে জীবন-মরণ খেলতে। তাদের মধ্যে প্রতি সন্ধ্যাবেলা নজরুলের ঘরের সামনে কী আনন্দ কী হুল্লোড়ই না হতো। জীবন-মরণ খেলায় আত্মভোলা সাত হাজার তরুণ ছেলে করাচির নৈশ আকাশ-বাতাসকে সুরতরঙ্গে যেমন মাতিয়ে তুলতেন, তার সঙ্গে আনন্দের বেগ সামলাতে না পেরে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে”,

“চালাও পানশি বেলঘরিয়া’ আরও নানা শব্দ আন্দোলিত করে তুলতেন নজরুল। এই উদ্দামতায় নজরুলের ডানপিটে সাথী ছিলেন মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। নজরুলের জন্য এ-ছিলো এক বিরাট সুযোগ। গানপাগল নজরুল তাই শুরু থেকেই সৈন্যদলে থেকেও আপন ভুবনে মত্ত থাকতে পেরেছেন। নতুন নতুন গান রচনা ও তাতে সুর বসিয়ে নিজেই গেয়ে শুনিয়ে সকলকে আনন্দে বিভোর করে রাখতেন। লেখাপড়াতেও পিছিয়ে ছিলেন না।

সেখানে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে মাসিক পত্রিকাসমূহ যেমন সেই সময়ে আলোচিত পত্রিকা প্রবাসী, ভারতী, মানসী, মর্মবাণী প্রভৃতি নিয়মিত পড়তেন। এছাড়াও মনের গভীরে যে দেশমুক্তির মন্ত্র লুকানো ছিলো তাকে জাগ্রত রাখতে বিদ্রোহী বাংলার বিপ্লবীদের নিয়মিত খোঁজখবর নেবার জন্য সেডিসাস কমিটির রিপোর্টও পড়তেন। করাচি ব্যারাক থেকেই তিনি প্রথম দেশাত্মবোধক গান রচনাসহ সামরিক সংগীত রচনা করতে শুরু করেন।

 

 

সামরিক সংগীত রচনার আবহ সৃষ্টি করতে যে সকল বাদ্যযন্ত্রাদির প্রয়োজন তার সবটাই ছিলো করাচি ব্যারাকে। এখানে অরগ্যান, বার্নেট, ক্ল্যারিওনেট ব্যান্ড প্রভৃতি যন্ত্র বাজানো শেখেন কবি তাঁর সহকর্মী নিত্যানন্দ দে, গোপী ও মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এখানে সামরিক সংগীত এবং মার্চ সংগীত রচনার সূত্রপাত ঘটে এবং পরবর্তীকালেও এ সংগীত রচনায় বিশেষ আগ্রহী হন ও সুনাম অর্জন করেন। যেমন-

১. ঝাড়-বাঞ্ছায় ওড়ে নিশান

২. জাগো দুস্তর পথে নবযাত্রী

৩. চলরে চপল তরুণ দল

৪. কলকল্লোলে ত্রিংশ কোটি বাণী উঠেছে গান

৫. দুরন্ত দুর্গত প্রাণ অফুরাণ

৬. বীরদল আগে চল

৭. শঙ্কাশূন্য লক্ষকণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ঐ প্রভৃতি।

আরও দেখুন :

Exit mobile version