আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় সাম্যবাদের গান
সাম্যবাদের গান
সাম্যবাদের গান
সাম্যবাদের কবি নজরুলের হৃদয়জুড়ে ছিলো কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। তাঁর দেশাত্মবোধক গানের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে সাম্যবাদের বাণী নিঃসৃত সুরের ঝঙ্কার। নারী- পুরুষ, ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলমানের ব্যবধান থেকে মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে তিনি বড় করে দেখেছেন সবসময়। কবি মানুষের হৃদয়ের পবিত্রতাকে মন্দিরের সাথে তুলনা করেছেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাই ব্যক্ত করেছেন সাম্যবাদী কবিতায়-
“মসজিদ এই মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
মানবতা ও সাম্যের এক অপূর্ব সমন্বয় কবির এই সাম্যবাদ কবিতাটি। মানবদরদী সাম্যবাদী এই কবি সকল শ্রেণির, সকল পেশার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। যেমন-
‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা সাম্যবাদী’। কবিতাটি কয়েকটি উপ-শিরোনামে বিভক্ত। মানবতাবাদ ও সাম্যবাদের অপূর্ব সমন্বয়ে কবিতাটি ব্যঞ্জিত। মানুষের প্রতি এমন গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভবত দুর্লক্ষ্য। জাতি-ধর্ম, ধনী-নির্ধন, কৃষক শ্রমিক, কুলি-মজুর, চোর-ডাকাত, পাপী-তাপী সকল মানুষের প্রতিই কবির অনুষ্ঠ ভালোবাসা।
তত্ত্বগত বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের এত কাছাকাছি নজরুল ছাড়া সেকালের অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিক যেতে পারেননি। এ কারণেই তিনি সাম্যবাদী কবির আখ্যা পেয়েছেন। কবি নজরুলের জন্মভূমি চুরুলিয়া বেশ অনুন্নত ছিলো। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতো বাড়ির পাশেই। দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বহুবিধ অভাব-অনটন, বঞ্চনা আর দুঃখ-কষ্টকে খুব কাছ থেকেই অবলোকন করেছেন কবি।
তাই ছোটবেলা থেকেই সকল স্তরের মানুষের প্রতি একটা মমত্ববোধ নিয়েই কবি বেড়ে উঠেছেন। একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হয়ে উঠেছেন। কখনোই কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে তিনি বড় করে দেখেননি। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে যে ‘মানব ধর্ম’ তাই তিনি ঘোষণা করেছেন বারংবার তাঁর সকল সৃষ্টিতে।
মানুষেরই জন্য সকল ধর্ম। তাই নজরুলের সংগীতে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সর্বার্থে প্রকাশ পায়। গণমানুষের কবি ছিলেন নজরুল। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সম্মান প্রদর্শন তাঁর কাছে প্রথম ধর্ম। সাম্যবাদের বাণীর মাধ্যমে এই মানুষে মানুষে সকল ভেদাভেদ ঘুচাতে চেয়েছেন কবি। কবির ভাষায়:
“মোরা একই বৃত্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ
যদিও এই গানের বাণী আজ নিভৃতে কাঁদে। কারণ কবি নজরুল দেশমাতাকে মানবদেহের সাথে তুলনা করে মুসলিমকে নয়ন-মণি আর হিন্দুকে তাঁর প্রাণ কল্পনা করে যে সম্প্রীতি আর সৌহার্দের কথা বলে গেছেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সে সাম্যবাদ আজ সহসাই হুমকির মুখে পড়ে কতিপয় উগ্রবাদীর আগ্রাসনের কারণে। অথচ এরই বিরুদ্ধে গিয়ে কবি শত বছর আগে রচিত গানে ধর্ম-বর্ণ জাতের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন মানুষের সত্তাকে।
ধর্মের আচারনিষ্ঠতা যেন মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন না করে তার প্রকাশ পাই কবির ‘মানুষ’ কবিতাসহ অসংখ্য গানে। একই দেশের মাটিতে জন্ম, বেড়ে ওঠা। কেবলই মৃত্যুর পরে ঠাঁই কারো শ্মশানে, কারো গোরস্থানে। একই ভাষায় কথা বলা, একই নাড়ির টান। কবি একই বৃত্তের দুটি কুসুম বলে তুলনা করেছেন হিন্দু-মুসলমানকে। এমন করে স্বদেশের গানে সাম্যবাদের কথা বলা নজরুলের গানেই তা কেবল সম্ভব।
তাই স্বদেশের মানুষ যখন ধর্ম সংক্রান্ত যেকোনো সংকটে বাংলার মানুষের সম্প্রীতি নষ্ট করবার চক্রান্ত চালাতে থাকে তখন নজরুলের এই সাম্যবাদী গান হাতিয়ার হয়ে ধরা দেয়। প্রতিটি বাঙালির প্রাণে যদি এই গানের বাণী সমস্বরে বাজে তবে কোনো উগ্রপন্থির ঠাঁই এই বাংলায় সম্ভব নয়। এমনই সম্প্রীতিহানিকর পরিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কবি রচিত অনেক স্বদেশপর্বের গান রয়েছে যেখানে সাম্যবাদ মূখ্য ভূমিকায় থাকে। কবির ভাষায়:
“সঙ্ঘ শরণ তীর্থযাত্রা পথে এসো মোরা যাই।
সঙ্ঘ বাঁধিয়া চলিলে অভয় সে পথে মৃত্যু নাই ॥
যখন সকল ধর্মের মানুষ, বর্ণের মানুষ এক হয়ে পথে নেমে সত্য সন্ধানের উদ্দেশ্যে মুক্তির প্রত্যাশায় তখন জয় সুনিশ্চিত। কারণ সেখানে কোনো ছোট-বড় ভেদাভেদ থাকে না, থাকে শুধু একটিই সংকল্প সকলের প্রাণে। তাই কবি এই গানের একাংশে বলেছেন, ভারতে তেত্রিশ কোটি মানুষ সত্ত্বেও কেবল ঐক্য না থাকার কারণে, ধর্ম-বর্ণের এত ভেদাভেদের কারণে আজ পরাধীন।
ঐক্যের শক্তিতে সকল দুর্জয়কে জয় করা যায়। অজেয়কে জয় করা সহজ হয়ে যায়। তাই সাম্যবাদকে নজরুল তাঁর গানে- কবিতায় তথা সামগ্রিক রচনায় এতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। নিজেকে প্রকাশ করেছেন এক অনির্বাণ সাম্যবাদী কবি হিসেবে। হিন্দু-মুসলিমের আত্মিক রেষারেষিকে কবি অনুভব করেছিলেন বাঙালিত্বের এক নিগূঢ় সমস্যা হিসেবে। কারণ দেশের থেকে যখন ধর্ম বড় হয়ে যায় তখন ভ্রাতৃত্ববোধে বিঘ্ন ঘটে, বাধে বিপত্তি।

তাই কবি বারংবার হিন্দু-মুসলিম এই দুই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভাই বলে, একই মায়ের সহোদর বলে ব্যক্ত করেছেন :
“হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই।
এক বৃত্তে দু’টি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই
সৃষ্টিকর্তা একজনই। একই আমাদের রক্তের রং। অথচ ধর্ম ধর্ম করে এই রক্ত ঝরাতে কুণ্ঠাবোধ করে না মানুষ। তাই যখন বিধাতা শাস্তি দেন দুই ধর্মই সমান সাজা পায়। কেউ কম কেউ বেশি নয়; দেশে মড়ক লাগলে যেমন দুই জাতির মানুষই মারা যায়, তেমনি বন্যাতে দুই জাতির ঘরই ভেসে যায়। আবার বিধাতার ভালোবাসাও দুই জাতির প্রতি সমান। দুইজনের শস্য ক্ষেতেই তিনি সমান বৃষ্টি দেন এবং মাঠ সোনার ফসলে ভরে ওঠে।
চাঁদের আলোয় সকলকে সমানভাবে মোহিত করে। কারো ঘরে বেশি, কারো কম নয়। কবি বারবার এই তফাৎকে ঘুচাতে চেয়েছেন তাঁর লেখনিতে। কারণ তিনি জানতেন বাইরের কোনো শক্তিই আমাদের পরাহত করতে পারবে না যদি আমাদের মাঝে ঐক্য থাকে। তাই কবি হিন্দু ও মুসলিম এই দুই ধর্মের ভ্রাতৃত্ববোধকে সংঘবদ্ধ করতে একই ধারায় কয়েকটি গান রচনা করেছেন। যেমন-
ক. “ভারতের দুই নয়ন-তারা হিন্দু-মুসলমান।
দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান হিন্দু-মুসলমান
খ. “ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায় টেনে নে না তারে কোলে।
মুছিয়ে দে তার নয়নের জল সে যে আপন মায়ের ছেলে ॥ Men
গ. “হিন্দু-মুসলমান দুটি ভাই ভারতের দুই আখি তারা।
এক বাগানে দুটী তরু-দেবদারু আর কদমচার
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নজরুল জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ ইন্তেকাল করেন ১৯০৮ খ্রি. নজরুলের বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। নজরুলের স্বদেশ আমরা জানি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মেছিলেন ধর্মভীরু, রক্ষণশীল এক মুসলিম পরিবারে। যৌথ পরিবারে সদস্য সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে সংসারে নানারকম অভাব লেগেই ছিলো পিতা কাজী ফকির আহমেদের।
পিতার মৃত্যুর পর ১০ বছর বয়স থেকেই সংসার চালানোর জন্য নজরুলকে মক্তবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করতে হয়। মাজার শরীফের খাদেম হিসেবেও কাজ করেন। আবার কখনো করতে হয়েছে মসজিদে ইমামতি। নজরুলের স্বদেশ অর্থাৎ নিগূঢ়ভাবে ইসলাম ধর্মকে জানা একজন অন্য ধর্মের প্রতি এমন শ্রদ্ধাশীল হওয়াটাই প্রকৃত ধর্মের উদ্দেশ্য। জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে নজরুল পেয়েছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
ধর্মনিষ্ঠ নজরুল দারিদ্রোর সাথে সংগ্রাম করতে করতে শেখেন সকল ধর্মের মানুষের ক্ষুধাই সমান। কষ্টগুলোও একই রকম। ঘরের চালা ফুটো থাকলে বৃষ্টির পানি যেমনি সকলের ঘর সমানভাবে সিক্ত করে, নজরুলের স্বদেশ তেমনি চাঁদের আলো সেই ফুটো দিয়েই সকলের ঘরকে সমানভাবে আলোকিত করে। সেখানে কোনো ছোট- বড়, হিন্দু-মুসলমানের ব্যবধান নেই। কারণ বিধির বিধান সকলের জন্য সমান ও সত্য। তাই কবি বলেছেন-
“পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর,
বিধির বিধান সত্য হোক !
নজরুলের স্বদেশপ্রেমের এই গানটির মধ্যে কবি ব্যক্ত করেছেন জাতের চেয়ে মানুষ সত্য। প্রাণশক্তিই সকল চিন্তার কেন্দ্র। খ্রিষ্ট, বুদ্ধ, কৃষ্ণ, মোহাম্মদ আর রাম-এঁরা সকলেই মানুষ ছিলেন এবং মানুষকেই তাঁরা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় এঁরা প্রত্যেকেই মানুষের সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন। তাঁদের ব্যতিক্রম ভাবনায় মানুষের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
তাঁরা প্রত্যেকেই পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। প্রত্যেকের বক্তব্যও একই ছিলো মানবের কল্যাণ সাধন। বিধির বিধানও তাই। তাই কবি বিধির বিধানকে সত্য করবার প্রার্থনা রেখে গেছেন বারবার। ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়… নজরুলের এই গানটির মধ্যেও একই দেশে জন্ম প্রত্যেককে পরম আত্মীয় মনে করেন কবি।
কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের গড়া পুঁথিগত নিয়মের কারণে এতকাল ধরে চলে আসা সুন্দর ভাই ভাই সম্পর্ক সে বাঙালিত্বের অহংকার ছিলো তা যেন নষ্ট হয়ে না যায়। কারণ একজনের বিপদে পাশের প্রতিবেশীই এগিয়ে আসবে সে হিন্দু না মুসলমান সে ভাবনায় বসে থাকলে হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। তাই দেশমাতৃকার সকল সন্তানকে ভাতৃরূপে গণ্য করতে কবির আহ্বান।
জাত-পাত ভুলে ধর্মজ্ঞানের পরম সত্য যে মানুষের কল্যাণ সাধন, এই ভাবনায় নিজেকে দীক্ষিত করে সকলকে বুকে টেনে নিতে বলেছেন কবি। কর্ম-ধর্ম হোক সবার সমান। দেশের ঊর্ধ্বে কিছু নয়। সাম্যবাদের মর্মবাণীতে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে দেশমাতাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, নিজের জন্ম সার্থক করতে হবে। একই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে দুর্বার গতিতে।
“হোক প্রবুদ্ধ সঙ্ঘবদ্ধ মোদের মহাভারত
হোক সার্থক নাম।
হোক এই জাতি ধর্মে এক, কর্মে এক মর্মে এক-
এক লক্ষ্যে মধুর সখ্যে, পূর্ণ হউক পূর্ণ হউক আৰ্য্যাবৰ্ত্তধাম ॥
আরও দেখুন :