স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

 

স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

 

স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

স্বদেশ বন্দনার কিছু গানে কবি নজরুল স্বদেশ মাতার অপরূপ রূপেরও বর্ণনা করেছেন। এর প্রকৃতি কতো মনোরম সুশোভিত, সবুজের মায়ায় এর চারিধার এমন করে বেষ্টিত যে এই বন্ধন ছেড়ে পৃথিবীর কোথাও গিয়ে সুখে থাকা সম্ভব হয় না। প্রকৃতিই বাংলার আসল সম্পদ। এই ঐশ্বর্যে এর রূপ কানায় কানায় পূর্ণ।

বাংলা মায়ের অপরূপ রূপের কবি যে সকল দেশবন্দনার গান রচনা করেছেন তা অত্যন্ত সফল এবং সর্বজন সমাদৃত। জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা সঞ্চার করা হয়েছে এই ধারার গানের মূল প্রেরণার উৎস-

“নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম

চির-মনোরম চির মধুর

বুকে নিরবধি বহে শত নদী

চরণে জলধির বাজে নূপুর ॥

১৯৩২ সালে অর্থাৎ ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পূর্বে এই গানটি রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশের রূপের মহিমাকে কবি এই গানে প্রণতি জানিয়েছেন বারংবার। বাংলাদেশের রূপ যে কতো মনোরম আর মধুর শোভায় আবৃত এর সবুজাভরণ, তাই ব্যক্ত করেছেন কবি এই গানে। মাথার উপর হিমালয় আশীর্বাদস্বরূপ মেঘবারি পাঠায়। এই বৃষ্টিকণায় সবুজে সবুজে পূর্ণ থাকে এর লীলাভূমি।

গ্রীষ্মের কালবৈশাখী রূপ বর্ষায় অন্য রূপ নেয় আবার শরতে শেফালি হেসে মাতাল করে চারিধার। হেমন্তের শিশির আর শীতের পাতাঝরা সবকিছুকে ছাপিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতিতে ঋতুর পরিবর্তন এখানে স্পষ্ট পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। তাই কবি এই মাটির, এই আকাশের কাছে ঋণী থেকেই স্বপ্ন সুখের বাসা বেঁধে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চান এই বাংলার মাটিতেই।

নজরুলের আরো একটি অসাধারণ স্বদেশের গান যেখানে প্রকৃতি বন্দনায় নিমগ্ন কবি শ্যামলা মায়ের গুণকীর্তন করেছেন নানা মহিমায়। এই গান কালোত্তীর্ণ গৌরব অর্জন করেছে। বাংলার অপূর্বরূপের মহিমাটি কবি অত্যন্ত সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গানে-

“শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের

রূপ দেখে যা আয়রে আয়।

গিরি-দরী-বনে-মাঠে-প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায় ॥

এই গানটিতে অত্যন্ত সুন্দর ও নিখুঁতভাবে গ্রামবাংলার রূপের বর্ণনা করেছেন। খেতের বাঁকে বাঁকে হেঁটে চলার ছন্দ অত্যন্ত মনোরম। কালো দীঘির পদ্মফুলের শোভা থেকে শুরু করে ঝড়ের রাতে সাপের নাচন, নদীর স্রোতে নুড়ী পাথরের নড়াচড়ার শব্দকেও কবি এড়িয়ে যাননি। এমন নিখুঁত বর্ণনা স্বদেশপর্বের খুব কম গানেই দেখা যায়।

সবিশেষ বাংলার ঐতিহ্য লোক গানের সুর ভাটিয়ালি-বাউলের কথা উল্লেখ করে কবি স্বাক্ষর রেখেছেন যে সংস্কৃতির প্রতিটি ধারাতেই আমরা পরিপূর্ণ। এমনই আরো একটি গানের উদাহরণ পাই একি অপরূর রূপে মা তোমায়’ গানটিতে। এখানেও ফুল, ফসল, কাদা-মাটি জল সকল কিছুর অপার লাবণ্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গান। বাংলার প্রকৃত সৌন্দর্য এর পল্লী গ্রাম।

 

স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

 

বৈশাখের প্রখরতায় আম-কাঁঠালের সুঘ্রাণ শেষ না হতেই বর্ষার কেতকী- -কদম- যুথিকার গন্ধে হৃদয় আকুল করে। বাংলার প্রকৃতিতে ঋতুগুলো যেন হাত ধরাধরি করে চলে। অঘ্রাণে আমন ধানের গন্ধে কৃষাণ-কৃষাণীর মুখের হাসি ফুটে ওঠে, শরতের আগমনী বার্তার আবেশ শেষ না হতেই। হাসি-আনন্দে যেন এখানে ভাই-বোন, তারা হাত ধরাধরি করে নেচে নেচে বেড়ায় এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে।

সারি-ভাটিয়ালি গানে শীতের রাতে কীর্তনের আসরে বাংলা মায়ের কাছে, ঈশ্বরের কাছে, কৃতজ্ঞতায় চোখের কোণে জল জমে। সেই অশ্রু দু’হাত দিয়ে পৃথিবীকে রঙিন করে তোলে, বসন্তের নানা রঙের ফুলের বাহার। বাংলার মাটিকে কবি সোনার চেয়েও খাঁটি বলেছেন। কারণ এই মাটিতে ধন্য হতে কতো গুণি।

জ্ঞানীজন ভিড় জমায়। এই দেশের সংগ্রামের ইতিহাস, এর প্রকৃতির সৌন্দর্যতা রক্ষায় এর সন্তানের অবদান অনন্য স্মরণযোগ্য উদাহরণ। এই দেশের প্রকৃতির, মাটির গন্ধে যে সুখ তা অর্থবৈভব-বিত্তে নেই। কবি তাই দেশবন্দনার গানে স্বদেশের চেতনাকে ত্বরান্বিত করতে রচনা করেছেন এ ধারার কয়েকটি গান—

ক. “আমার দেশের মাটি ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি।

এই দেশেরই মাটি জলে, এই দেশেরই ফুলে ফলে,

তৃষ্ণা মিটাই, মিটাই ক্ষুধা পিয়ে এরি দুধের বাটি

খ. “এই ভারতে নাই যাহা তা’ ভূ-ভারতে নাই।

মানুষ যাহা চায় স্বর্গে গিয়ে, আমরা হেথায় পাই ॥

কবি নজরুল দেশচেতনার এই সকল গানের ভিতর দিয়ে স্বদেশের প্রকৃতির রূপের বর্ণনার সাথে এর মানুষ কি করে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাও ব্যক্ত করেছেন। বাংলার মানুষ সহজ সরল হৃদয়ের অধিকারী, ঠিক এক সবুজের গভীরতার মতো এদের দেহ-ভালোবাসার রূপটি। মাঠে-ঘাটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পূর্ণ করা খুশি এখানে নিত্য শাস্তির পরশে সাধারণ মানুষের ঘরে স্বর্গ খেলা করে। এই জাতি যেমন কোমল তেমনি সাহসী।

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

প্রকৃতির সাথে বেড়ে উঠবার কারণে হাঙর, কুমির, শার্দুল, সাপ মানুষের খেলার সাথীস্বরূপ। তাই এই জাতি সরল হতে পারে, কোমল হতে পারে কিন্তু ভীতু নয়। এই বাংলার ছেলেরা বিশ্বকে জয় করতে ডরে না। বীর প্রতাপসহ অসংখ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এ বাংলার বুকে জন্ম নেয়া দিগ্বিজয়ী বিজেতা বীরের। তাই কবি বারবার বুক চেতিয়ে উচ্চস্বরে গর্বভরে বলেছেন :

“এই আমাদের বাংলাদেশ এই আমাদের বাংলাদেশ

যে দিকে চাই স্নিগ্ধ শ্যামল চোখ জুড়ানো রূপ অশেষ।

যে সময়ে ভারতীয় মানুষের প্রধান সংগ্রাম ছিলো সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা, ঠিक সেই সময়টিতে নজরুলের দেশাত্মবোধক গান পরাধীন জনগণের মনে প্রলয়ের তুফান তুলেছিল। তাঁর অপরিমেয় দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ দেশ জুড়ে এক উদ্দাম গতির সঞ্চার করে। কারাগারে থেকে নজরুল থেমে থাকেননি। দেশের প্রতি তাঁর আবেগ ও ব্যথা তিনি সমগ্র দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন কথা আর সুরের সম্মিলনের ফল্গুধারায়।

 

স্বদেশের গানে প্রকৃতি বন্দনা

 

এ সকল গানে কখনো ব্যক্ত হয়েছে শিকল ভাঙার সুর, কখনো সাম্যবাদের উক্তিতে উদ্দীপনার জাগরণী বার্তা। এই সকল গানেই আবার ফুটে উঠেছে দেশমাতার অপরূপ প্রকৃতি ও মমতা যা বিশ্বমায়ের আঁচলে থেকে শ্রেষ্ঠ আশ্রয় বলে কবির কাছে প্রতীয়মান। কখনো আশা জাগানিয়া সুর, মাতৃস্নেহ, আবার কখনো শত্রুদের প্রতি বিদ্রূপের ব্যঙ্গাত্মক তীর্যক বাণী যা নজরুলের স্বদেশপ্রেমের গান রচনার একটি বিশেষ দিক।

আরও দেখুন :

Leave a Comment